সালমা বেগম : সুমি আক্তার। দুই বছর বয়সে হারিয়েছেন বাবাকে। বাবার ছবিও দেখেননি কোনোদিন। নেই কোনো স্মৃতিও। জানেন না দেখতে কেমন ছিলেন বাবা। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সুমি তৃতীয়। দশ বছর আগে সুমি ও তার ভাই শাহাদাতকে কেরানীগঞ্জ থেকে আজিমপুরের স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানায় নিয়ে আসেন তাদের মা শিউলি। সাত বছর বয়স থেকে এখানেই আছেন সুমি।
সুমি জানান, প্রথমদিকে খুব কষ্ট হতো। নিজেকে গুছিয়ে নিতে বেশ সময়ও লেগেছে। ২০১৬ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিও-৫ পেয়েছেন সুমি। বর্তমানে ইডেন মহিলা কলেজে পড়ছেন। স্বপ্ন বিসিএস ক্যাডার হওয়ার। সুমি জানান, এখানে না আসলে হয়তো এমন স্বপ্ন তিনি দেখতেন না। গ্রামের অন্য সমবয়সী মেয়েদের মতো হয়তো তাকেও বিয়ে দেয়া হতো। পড়ালেখা করে স্বপ্ন দেখার চিন্তাও করতেন না তিনি। তাই নিজেকে খুবই ভাগ্যবতী ভাবছেন সুমি।
তিনি বলেন, এখানে আমরা যা পাচ্ছি তা বাইরের অনেকেই পায় না। আর আমার কাছে এই জায়গাকে কখনো এতিমখানা মনে হয়নি। বড় একটি পরিবার মনে হয়েছে সবসময়। যেখানে সবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক এবং একসঙ্গে থাকি। আর আমাদের মায়ের অভাব পূরণ করার জন্য আছেন হোস্টেল সুপার সালেহা বেগম। যিনি কখনো মায়ের মতো আবার কখনো বন্ধুর মতো আমাদের সঙ্গে থাকেন। আমাদের ভালোবাসেন এবং সব চাহিদা মেটান। যেটা হয়তো আমার মা ইচ্ছে করলেও করতে পারতেন না।
সুমি জানান, কলেজে পড়ার সময় সব শিক্ষক একটু বাড়তি নজর দিতেন তার দিকে। এতিমখানায় থেকেও বাড়তি কোনো কোচিং ছাড়াই বরাবরই পরীক্ষায় ভালো করেছেন। তিনি জানান, অবসর সময়ে গল্প, উপন্যাস পড়তে ভালোবাসেন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা মেজদিদি এবং সমরেশ মজুমদারের সাতকাহন, হুমায়ূন আহমেদের হিমু, কৃষ্ণপক্ষ সবই সংগ্রহে আছে সুমির। নীলক্ষেত থেকে পুরনো বই কিনে পড়াই তার শখ। এছাড়াও প্রতিবছর এতিমখানার আয়োজনে পিকনিকে যাওয়া এবং খেলাধুলার আয়োজন বেশ উপভোগ করেন সুমি।
দীর্ঘদিন ধরে এই এতিমখানাতেই আছেন তানজিলা। বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজে একাদশ শ্রেণিতে পড়ছেন। স্বপ্ন দেখছেন ব্যাংকার হওয়ার। ভালোবাসেন কবিতা পড়তে। আবৃতিও করেন তিনি। ছোটবেলার কোনো স্মৃতি নেই তানজিলার মনে। বাবা মাহবুব আলম মারা যাওয়ার পরই ঘরছাড়া হয়েছেন তারা। তানজিলা বলেন, বাবার দুইটি ছবি দেখেছি। কিন্তু এক ছবির সঙ্গে অন্য ছবির কোনো মিল খুঁজে পাইনি। মা যদি তখন আমাদের এই জায়গায় না নিয়ে আসতেন হয়তো জীবনটা এমন সুন্দর হতো না। স্বপ্ন দেখতে শিখেছেন এখানে এসে।
তানজিলা বলেন, কলেজে সহপাঠীদের প্রায় সবাই ফেসবুক ব্যবহার করেন। মোবাইলফোন ব্যবহার করলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সম্পর্কে খুব বেশি ধারণা কিংবা আগ্রহ নেই তানজিলার। শুধুমাত্র নিজের পড়ালেখা ঠিক রাখতে চান তিনি। তানজিলা বলেন, এতিমখানায় প্রথম আসার পর খুব একটা কষ্ট হয়নি তার। খুব সহজেই নিজেকে এই পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছেন তিনি। তবে সুবিধা হয়েছে সঙ্গে ছোটবোন থাকায়। অবসরে হাতের কাজ এবং সেলাই করতে ভালোবাসেন তানজিলা। পড়াশুনার বাইরে নিজের সঙ্গে থাকা অন্য মেয়েদের জামাও সেলাই করে দেন তিনি।
চার বছর আগে মো. সাব্বির শেখ সলিমুল্লাহ এতিমখানায় আসেন। ফরিদউদ্দীন সিদ্দিক উচ্চ বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছেন। ছোট ভাই মো. হেলাল শেখও থাকেন একই এতিমখানায়। দুই বছর বয়সেই বাবাকে হারান সাব্বির। তখন ছোট ভাই হেলাল সদ্য জন্ম নিয়েছেন। তবে সবই শুনেছেন মা হাফিজা বেগমের কাছে। বাবার কথা মনে নেই তার। সাব্বির বলেন, এখানে যদি না আসতাম তাহলে পড়ালেখা কি বুঝতাম না। ফরিদপুরে আমাদের পড়ালেখা হতো না। কিন্তু এখানে এসে বড় ভাইদের পড়তে দেখে আমার পড়ার আগ্রহ বেড়েছে।
এখন আমি ছোটভাইকেও পড়াই। আর এতিমখানার ভেতরের ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা ভালো বলে স্কুলের শিক্ষকরাও খুব আদর করেন। অবসরে ছবি আঁকতে ভালোবাসেন সাব্বির। সবচেয়ে ভালো লাগে গ্রামের দৃশ্য এবং মুক্তিযুদ্ধের ছবি আঁকতে। নিজের আঁকা অনেক ছবিই রেখে দিয়েছেন সাব্বির। বড় হয়ে সরকারি চাকরি করার ইচ্ছা তার। প্রতিসপ্তাহে মা আসেন দেখা করতে। সাব্বির বলেন, মা আসার সময় অনেক কিছু নিয়ে আসেন। আমার পছন্দের এবং প্রয়োজনীয় জিনিস থাকে। মায়ের হাতে তৈরি আচার এবং পিঠা খেতে ভালোবাসি আমি। তাই প্রতিবার আসার সময়ই মা এসব নিয়ে আসেন। এছাড়াও ফল খেতে ভালো লাগে।
আট বছরের ছোট্ট সাজ্জাদ সরকার। বড় বোন মিলির সঙ্গে সলিমুল্লাহ এতিমখানায় এসেছেন দুই বছর আগে। সাজ্জাদ ফরিদ উদ্দীন সিদ্দিক উচ্চ বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়েন। তিন ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট সাজ্জাদ। এই ছোট্ট শিশু জানান, খেলাধুলা এবং পড়াশুনা করতে ভালোলাগে তার। এতিমখানায় থাকতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। একদিন পর পর বড় বোনের সঙ্গে দেখা করেন। সাজ্জাদ বলেন, এখানে সবার সঙ্গে থাকতে ভালোলাগে। সবাই একসঙ্গে খায় এবং ঘুমায়। বিকালে ফুটবল আর ক্রিকেট খেলতে ভালো লাগে। প্রতি সপ্তাহে শুক্রবার মা ডলি বেগমের সঙ্গে দেখা হয় তার। সবমিলিয়ে ভালো আছে ছোট্ট এই শিশু।
স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানার ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক মোহাম্মদ নাজমুস সাদাত বলেন, বর্তমানে এতিমখানায় দুইশ’ নব্বই জন এতিম শিশু আছে। এরমধ্যে ১৪৩ জন মেয়ে। এদের বয়স ৬-১৮ বছরের মধ্যে। তবে এতিমখানা গঠনতন্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী যারা লেখাপড়ায় ভালো আঠারো বছরের বেশি হলেও সবধরনের সুযোগ দেয়া হয়।
নাজমুস সাদাত বলেন, এতিমখানার নিজস্ব দোকান এবং বাড়ি ভাড়ার টাকাই মূলত নির্ধারিত আয়। যার মাধ্যমেই চলছে এতিমখানার খরচ। প্রতিমাসে প্রায় তের লাখ টাকা নিজস্ব আয় হয় এতিমখানার। এছাড়াও সাধারণ মানুষের দান থেকেও কিছু টাকা আসে। গড়ে এতিমখানায় প্রতিমাসে প্রায় ১৪ থেকে ১৮ লাখ টাকা খরচ হয়। ১৯০৯ সালে ১৮ বিঘা জমির উপর গড়ে উঠে স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানা। -এমজমিন
১৮ জানুয়ারি ২০১৭/এমটিনিউজ২৪/এসবি