শনিবার, ২১ জানুয়ারী, ২০১৭, ০১:৩৮:১৯

বারাক হুসেইন ওবামা কেন অন্যরকম?

বারাক হুসেইন ওবামা কেন অন্যরকম?

মনিজা রহমান : আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতে না পারার জন্য যতগুলো দোষ থাকা দরকার, সবই তার ছিল। চামড়ার রঙ কালো, নামের মাঝে হুসেইন, আমাদের বাংলাদেশে যাকে বলি ‘বারেক’ বা ‘বারেইক্যা’, সেই বারাক শুধু আমেরিকার দুইবার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হলেন না, হলেন পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে থাকা সমস্ত সংগ্রামী স্বপ্নবাজ মানুষের অনুপ্রেরণা।

একজন মানুষের মনোছবি কিংবা লক্ষ্য সুস্পষ্ট হলে কোনো বাধাই যে আসলে বাধা নয়, তারই জ্বলন্ত উদহারণ তিনি। বিদায়, বারাক হুসেইন ওবামা। নতুন প্রেসিডেন্টের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে শুক্রবার সপরিবারে হোয়াইট হাউস ছাড়লেন তিনি। ওবামা এভাবেই একদিন ক্ষমতা নিয়েছিলেন জর্জ ডব্লিউ বুশের কাছ থেকে।

এটাকে কি বলা যায় ইতিহাসের পালাবদল? ২০০৯ সালে ওবামা যখন হোয়াইট হাউসে শপথ নিয়েছিলেন, তখন তিনি ছিলেন আমেরিকার সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট। এবার ঘটতে যাচ্ছে উল্টোটা। ইতিহাসের সবচেয়ে অজনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।

একটা বক্তৃতা ঘুরিয়ে দিয়েছিল ওবামার ভাগ্য। সেটা ছিল ২০০৪ সালে। ম্যাসাচুসেটসের রাজধানী বোস্টন শহরে অনুষ্ঠিত ডেমোক্রেট পার্টির জাতীয় সম্মেলনে তিনি মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন। সম্মেলনের আগে পর্যন্ত ওবামা জাতীয় পরিসরে  মোটামুটি অচেনাই ছিলেন। তার অসামান্য বক্তৃতাটির ফলে তিনি মুহূর্তেই জাতির কাছে পরিচিতি লাভ করেন। আমেরিকার প্রগতিশীল রাজনীতির ধারায় একজন উদীয়মান তারকা হিসেবে ওবামা আবির্ভূত হন।

কোন অভিজাত পরিবারের সন্তান ছিলেন না আমেরিকার ৪৪তম এই প্রেসিডেন্ট। হাওয়াই স্টেটের রাজধানী হনলুলুতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। তার বাবা একজন কেনিয়ান। তিনিও একদিক থেকে প্রথম। হাওয়াই-মানোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের একমাত্র  কেনিয়ান ছাত্র। কেনিয়ার লুও জাতির প্রতিনিধি তিনি। বারাক হুসেইন ওবামা সিনিয়র ছিলেন পেশায় একজন অর্থনীতিবিদ। ওবামার মা অ্যান ডানহ্যাম ইংরেজ-আইরিশ বংশোদ্ভূত আমেরিকান। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তাদের পরিচয় ও বিয়ে। ছোট্ট ওবামা যখন মাত্র দুই বছর, তখন ওর বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ ঘটে।

ওবামার মা আবারো বিয়ে করেন। প্রথম স্বামী ছিলেন কেনিয়ান মুসলমান, দ্বিতীয় স্বামী হলেন- ইন্দোনেশিয়ান মুসলমান। নাম লোলো সুতোরো। ওবামার শৈশবের অনেকটা সময় কেটেছে ইন্দোনেশিয়াতে। ১০ বছর বয়সে তিনি হাওয়াইয়ে তার নানা-নানীর কাছে চলে আসেন।
একাধিক জাতিসত্তা ও খ্রীষ্টান-মুসলমান দুই পরিচয়ে বেড়ে ওঠার কারণে বারাক ওবামাকে রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকে নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। বিখ্যাত নিউ ইয়র্ক টাইমস তাদের এক প্রবন্ধে প্রশ্ন তুলেছিলেন- বারাক ওবামা কি সত্যি সত্যি তার নিজের ধর্ম পরিচয় লুকাতে চাচ্ছেন? তবে কি তিনি অধার্মিক বাবা মায়ের ধার্মিক সন্তান? কিংবা তিনি সব সময় একজন খ্রীষ্টান ছিলেন বা সবসময় একজন মুসলিম ছিলেন? নাকি তার নিজস্ব উদ্ভাবিত কোনো ধর্ম আছে? তার মানে তিনি কি একই সঙ্গে একজন খ্রীষ্টান ও আবার মুসলিমও? ঘোর ইন্দ্রজাল আছে ওবামার ধার্মিক পরিচয় নিয়ে।

২০০৪ সালে ওবামাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘আপনি কি খ্রীষ্টান?’ উত্তরে তিনি বলেছিলেন, আমি আমার মায়ের কাছে লালিত পালিত হয়েছি। আমার মা খ্রীষ্টান ছিলেন। ২০০৭ সালে তিনি ঘোষণা দেন, কেবল বাবার দিক থেকেই আমার ইসলামের সঙ্গে সম্পর্ক আছে। কিন্তু আমি কখনও ইসলামের চর্চা করিনি। ২০০৯ সালে আবার সেই ওবামা সম্পূর্ণ ভিন্ন তথ্য দেন। ওবামা বলেন, আমি কোনো বিশেষ ধার্মিক পরিচয়ে বেড়ে উঠিনি। আমার বাবা ছিলেন মুসলমান। আমার দাদা-দাদী ছিলেন ব্যাপটিস্ট। শিকাগোতে আসার আগে আমি খ্রীষ্টান ছিলাম না। পরবর্তী ২০১০ সালে তিনি বলেন, আমি সবশেষে খ্রীষ্টান ধর্মকেই গ্রহণ করেছি।

ওবামার জীবনী ভিত্তিক বিখ্যাত বই ‘ড্রিমস ফ্রম মাই ফাদার’। সেই বইয়ের ৪০৭ পৃষ্ঠায় তার দাদার ধর্ম পরিবর্তন নিয়ে দাদার একটা লম্বা উক্তিও তুলে ধরেন। তার দাদার কথাটি ছিল- ‘খ্রীষ্টান ধর্মকে আমার কাছে মনে হয়েছে এক ধরনের বোকামি। কেবল নারীদের জন্যই সেটা গ্রহণযোগ্য। এজন্যই আমি ধর্মান্তরিত হয়েছি। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছি।’ জন্ম ও ব্যক্তিজীবন নিয়ে রাজনৈতিক জীবনের পুরোটা সময়ই নানা অপ্রীতিকর প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে বারাক ওবামাকে। আসলে তার পুরো জীবনটাই ছিল চ্যালেঞ্জিং। একের পর এক ভিন্ন পরিবেশে শৈশব থেকে খাপ খাওয়াতে হয়েছে। মায়ের জীবন সচ্ছল ছিল না। দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে।

তবে তার মা ছিলেন ওবামার প্রথম জীবনের শিক্ষক। যে কারণে ইন্দোনেশিয়াতে শৈশব কাটালেও ইংরেজি ভাষায় শিক্ষা ভুলে যাননি তিনি। জন্মদাতা পিতার ভালোবাসা সেভাবে পাননি বারাক। এ নিয়ে তার আক্ষেপ ছিল। কেনিয়ায় এক সড়ক দুর্ঘটনায় বাবার মৃত্যুতে আবেগপ্রবণ হতে দেখা গেছে ওবামাকে। অনেকে বারাক ওবামাকে আমেরিকার আরেক মহান প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের সঙ্গে তুলনা করেন। ক্রীতদাসরা আমেরিকার স্বাধীন, প্রথম শ্রেণির নাগরিক হয়েছিলেন লিংকনের ঘোষণায়।

সেই দ্বিখণ্ডিত সমাজ থেকে ক্রমে একটি সুন্দর সমাজে ফেরার সন্ধিক্ষণে ওবামার জন্ম। তিনি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। আগে যেখানে এখানে পড়ার সুযোগ ছিল না কোনো কৃষ্ণাঙ্গের। ওবামা কলম্বিয়া ও হার্ভার্ড দুই বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। লিংকন ও ওবামার দু’জনেরই পড়ার বিষয় ছিল আইন। যদিও লিংকনের কোনো আনুষ্ঠানিক ডিগ্রি ছিল না। কিন্তু ওবামা একজন লাইসেন্সপ্রাপ্ত এটর্নি।

তবে ওবামার জীবনে প্রধান অনুপ্রেরণা ছিলেন আব্রাহাম লিংকন নন, তিনি হলেন- মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র। ওবামা যখন তরুণ, সেই সময় মার্টিন লুথার কিং সিভিল রাইটস নিয়ে আন্দোলন তুঙ্গে। লুথার কিং আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। কিন্তু তার দেখানো পথে হেঁটে আমেরিকার সবচেয়ে ক্ষমতাধর মানুষ হয়েছেন ওবামা। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরে ওবামা পাবলিক সার্ভিসের ওপর অনেক গুরুত্ব দিয়েছেন। বিশেষ করে ওবামা কেয়ার ছিল এই দেশের মানুষের জন্য একটি বিশাল আশীর্বাদ।

ওবামা ও মার্টিন লুথার কিং উভয়ই শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। যদিও ওবামাকে ড্রোন হামলা, আরব দেশে অন্তর্দ্বন্দ্ব, আইএসএস’র উত্থানসহ নানা কাজের জন্য দায়ী করা হয়। এই সব ঘটনার পিছনে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ সিআইএ বহির্বিশ্বে কোনো কাজের ব্যাপারে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন বোধ করে না। সব কিছুর মধ্য দিয়ে জনগণের প্রেসিডেন্ট হিসেবে সবার মনে আজীবন থাকবেন বারাক হুসেইন ওবামা। এমজমিন

২১ জানুয়ারি ২০১৭/এমটিনিউজ২৪/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে