শুক্রবার, ১৬ অক্টোবর, ২০১৫, ০২:৩৬:৫৫

দুই বিদেশী হত্যার রহস্য উন্মোচনের দ্বারপ্রান্তে

দুই বিদেশী হত্যার রহস্য উন্মোচনের দ্বারপ্রান্তে

তোহুর আহমদ: অবশেষে দুই বিদেশী নাগরিক হত্যাকান্ডের রহস্য উন্মোচিত হতে যাচ্ছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃংখলা বাহিনীর চৌকস যৌথ টিম চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছে। বলা যায়, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ হত্যা রহস্য উন্মোচনে এখন অনেকটা দ্বারপ্রান্তে রয়েছেন। আইনশৃংখলা বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র খুনের মোটিভ ও মূল পরিকল্পনাকারীকে চিহ্নিত করার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

সূত্রমতে, ইতিমধ্যে হত্যাকান্ডের মাস্টারমাইন্ডকে চিহ্নিত করা গেছে। কিলিং মিশনে ব্যবহৃত একাধিক আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারও হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত একাধিক কিলারও এখন গোয়েন্দা হেফাজতে রয়েছেন। যৌথ জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকান্ডের আদ্যোপান্ত খোলাসা করে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন খুনিরা। তাদের স্বীকারোক্তিতে যা বেরিয়ে এসেছে তার সারমর্ম হল- এ হত্যাকান্ড সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং দেশকে অস্থিতিশীল ও সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে করা হয়েছে। আর হত্যাকা-ের মূল পরিকল্পনাকারী হলেন সাবেক এক ছাত্রনেতা। ঘটনার পর থেকেই তিনি পলাতক রয়েছেন।

 


দুই বিদেশী খুনের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বৃহস্পতিবার তার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের জানান, হত্যাকান্ডে প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যেই এ সংক্রান্ত অগ্রগতি জানানো হবে। এদিকে মহানগর পুলিশের মিডিয়া সেন্টারে গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, ঘটনার মোটিভ সম্পর্কে তারা নিশ্চিত হতে পেরেছেন। তাভোর খুনিকে শনাক্ত করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এ হত্যাকান্ডের সঙ্গে একেবারেই জঙ্গি সম্পৃক্ততার কোনো ভিত্তি নেই।’

অর্থদাতা ও পরিকল্পনাকারী এক ছাত্র নেতা : গোয়েন্দা সূত্র জানায়, হত্যাকান্ডের মূল পরিকল্পনাকারীকে শনাক্ত করা গেছে। তিনি গুরুত্বপূর্ণ একটি রাজনৈতিক দলের সাবেক ছাত্র নেতা। কিলিং মিশন সফল করতে প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও অর্থের জোগানদাতাও তিনি। পেশাদার কিলার ভাড়া করে এ হত্যাকা- ঘটানো হয়েছে। একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, দু’জন বিদেশী নাগরিক হত্যার মিশন সফল করতে মোটা অংকের বাজেট নিয়ে মাঠে নামেন ওই ছাত্র নেতা। তবে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতে তিনি শুরু থেকেই পর্দার আড়ালে থাকার কৌশল বেছে নেন। অবশ্য শেষরক্ষা হয়নি।

রংপুরে জাপানি নাগরিক কুনিও হোশির খুনের তদন্ত করতে গিয়েই মূলত এই ছাত্র নেতার সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়। পরে তাভেল্লা হত্যাকান্ডের  সঙ্গে জড়িত সন্দেহে আটককৃত কয়েকজনের স্বীকারোক্তিতে তার সম্পৃক্ততার আদ্যোপান্ত বেরিয়ে আসে। তবে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এখনই ওই ছাত্র নেতার নাম প্রকাশ করতে রাজি নন।

একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ‘হত্যাকান্ডের সঙ্গে ওই ছাত্র নেতার জড়িত থাকার অকাট্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। তারপরও জনমনে-জনমতে যাতে কোনো বিভ্রান্তি ছড়াতে না পারে সেজন্য বিষয়টি প্রকাশ করার আগে আরও যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে। শতভাগ অনুসন্ধান ও যাচাই শেষ হলে তথ্য-প্রমাণসহ জড়িতদের গণমাধ্যমের সামনে হাজির করা হবে। দেশে ও বিদেশে সবার কৌতূহল মেটাতে খুব শিগগির এমন একটি সংবাদ সম্মেলন দেখা যাবে।’

সূত্র জানায়, ঘটনার পর থেকেই ওই ছাত্র নেতা পলাতক রয়েছেন। অথচ ঘটনার কয়েকদিন আগ পর্যন্ত তার সঙ্গে দলীয় নেতাকর্মীদের যোগাযোগ ছিল। কিন্তু রংপুরে সন্দেহভাজন এক কিলারকে রিমান্ডে নেয়ার পর থেকেই তিনি আড়ালে চলে যান। পুলিশ জানায়, ওই ছাত্র নেতার বিরুদ্ধে অন্তত দেড়শ’ মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এসব মামলায় তিনি ফেরারি ছিলেন। দীর্ঘদিন ধরেই আত্মগোপনে থেকে তিনি রাজনৈতিক কর্মকা-  পরিচালনা করছিলেন। সর্বশেষ চলতি বছরের জানুয়ারিতে তাকে প্রকাশ্যে দেখা যায়। এরপর থেকেই তিনি আত্মগোপনে আছেন। পুলিশ বলছে, আত্মগোপনে থাকা অবস্থাতেই তিনি দুই বিদেশী হত্যাকান্ডের ছঁক আঁকেন। দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা অনুযায়ী সাবেক এ ছাত্র নেতা বর্বরোচিত এ হত্যাকান্ড ঘটান। তাকে গ্রেফতারে সব ধরনের চেষ্টা করা হচ্ছে।

এক কিলারের স্বীকারোক্তি : সূত্র জানায়, ঘটনার পর গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সন্দেহভাজন হিসেবে আটককৃত কয়েকজনকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। নিবিড় জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে সন্দেহভাজন কিলারদের একজন ঘটনার সঙ্গে নিজের জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি ইতালীয় নাগরিক তাভেল্লাকে হত্যার আদ্যোপান্ত খোলসা করেন। কীভাবে কোথা থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করা হয়, মিশন শেষে অস্ত্রগুলো কোথায় রাখা হয়- এরকম নানা তথ্য তিনি দিয়েছেন অনেকটা সাবলীলভাবে। কিন্তু মূল পরিকল্পনাকারীর নাম বলতে গড়িমসি করেন। তবে জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে সন্দেহভাজন ওই কিলার মূল পরিকল্পনাকারী ও অর্থের জোগানদাতার নাম বলে দেন। এরপর তার স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে তাভেল্লা হত্যায় ব্যবহৃত দুটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তার দাবি, ওই কিলারের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে তাভেল্লার খুনিদের ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটিও উদ্ধার করা হয়। এদিকে রংপুরে জাপানি নাগরিক কুনিও হোশির খুনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতারকৃতদের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন বলে জানিয়েছে সূত্র। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জাপানি নাগরিক হত্যাকান্ডের পরিকল্পনাকারী হিসেবেও ওই ছাত্র নেতার নাম বলেছেন। পুলিশ দাবি করছে, কুনিও হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত কয়েকটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এখন কিলিং মিশনে খুনিদের ব্যবহৃত ‘প্রেস’ স্টিকারযুক্ত মোটরসাইকেলটি উদ্ধারের চেষ্টা করছে পুলিশ।

রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিদেশী হত্যা : আইনশৃংখলা বাহিনীর তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, দুই বিদেশী নাগরিকের হত্যাকা- মূলত রাজনৈতিক। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের অংশ হিসেবেই দুই বিদেশীকে হত্যা করা হয়। ইতিমধ্যে চিহ্নিত হওয়া ওই ছাত্র নেতা দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতেই বিদেশী নাগরিক খুনের সিদ্ধান্ত নেন। এ ক্ষেত্রে পর্দার আড়ালে থেকে কলকাঠি নাড়েন তিনি। মাঠপর্যায়ে কিলারদের কাছে তার নির্দেশনা ছিল ‘কয়েকটা বিদেশী লাশ চাই।’ এ নির্দেশনা পাওয়ার পর ‘বিদেশী লাশে’র মিশন বাস্তবায়ন করতে ভাড়াটে খুনিরা গুলশানের কূটনৈতিক পাড়ায় চলে যায়। সেখানে ইতালীয় নাগরিক তাভেল্লাকে হাতের নাগালে পেয়ে খুন করা হয়। এরপর খুনিরা দ্রুত গা ঢাকা দেয়। একইভাবে জাপানি নাগরিক কুনিও হোশিকে বিদেশী নাগরিকের র‌্যানডম স্যাম্পল হিসেবে বেছে নেয় ভাড়াটে খুনিরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উচ্চপদস্থ এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, “দুই বিদেশী খুনের পরিকল্পনাটি এককভাবে করেন ওই সাবেক ছাত্র নেতা। এ বিষয়ে তার দলীয় হাইকমা- কিছুই জানতেন না। তদন্ত করতে গিয়ে পরিষ্কার হয়েছে, বর্বরতম এ হত্যাকা- ঘটানোর পেছনে ন্যূনতম সাংগঠনিক সমর্থনও ছিল না। নিছক ব্যক্তিগত ইচ্ছা থেকেই বিদেশী খুনের ছক আঁকেন ওই ছাত্র নেতা। একপর্যায়ে নিজস্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তার কিলিং মিশন সফল করতেও সক্ষম হন। তবে ঘটনার পর সবার দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে খুনের দায় স্বীকারে ‘আইএস গেম’ খেলেন খুনের মাস্টারমাইন্ড। এ জন্য আইএসের নামে ভুয়া টুইটবার্তাও প্রকাশ করা হয়।

তাভেল্লার তিন কিলার শনাক্ত : ইতালির নাগরিক তাভেল্লার তিন খুনিকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে। অবশ্য অসমর্থিত একটি সূত্রের খবর হচ্ছে, তাভেল্লার তিন খুনিকে ইতিমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। গোয়েন্দা হেফাজতে রেখে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। - যুগান্তর।

১৬ অক্টোবর,২০১৫/এমটিনিউজ২৪/আসিফ/এআর

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে