শুক্রবার, ১৬ অক্টোবর, ২০১৫, ০৩:৩৩:৫০

দেশজুড়ে মন্ত্রী-এমপি'র স্বজনদের ক্ষমতার দাপট

দেশজুড়ে মন্ত্রী-এমপি'র স্বজনদের ক্ষমতার দাপট

মির্জা মেহেদী তমাল ও রফিকুল ইসলাম রনি : ১৩ এপ্রিল রাত ১২টা। রাজধানীর নিউ ইস্কাটনের রাস্তায় রিকশার সামান্য জট। ওই জটে আটকে যায় একটি কালো রঙের আলিশান প্রাডো গাড়ি। হঠাৎ গাড়ির ভিতর থেকে এক যুবক রিকশার জট লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। এতে নিরীহ দুই ব্যক্তি নিহত হন। গুলিবর্ষণকারী ওই যুবকটি ক্ষমতাসীন দলের সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি পিনু খানের পুত্র বখতিয়ার আলম রনি।
গত সোমবার ধনাঢ্য পরিবারের দুই কিশোর গুলশানের ব্যস্ত সড়কে কার রেসিংয়ে মেতে ওঠে। তাদের গাড়ি বিকট শব্দ তুলে ছুটছিল। তাদের একজনের বেপরোয়া গাড়ির চাপায় মারাÍক আহত হন চার ব্যক্তি। বেপরোয়া গতির এ গাড়িটি চালাচ্ছিলেন সাবেক এমপি এইচ বি এম ইকবালের ভাতিজা ফারিজ রহমান। এইচ বি এম ইকবাল ১৯৯৬ সালে ঢাকার রমনা-তেজগাঁও আসনে আওয়ামী লীগের এমপি ছিলেন।
দেশের তরুণসমাজ ধ্বংসকারী মাদক ইয়াবা চোরাচালানের ‘অঘোষিত গডফাদার’ নামে বহুল আলোচিত টেকনাফের (কক্সবাজার-৪) এমপি আবদুর রহমান বদি এবং তার পাঁচ ভাই। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর গোপন প্রতিবেদনে ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসেবে এদের প্রত্যেকের নাম রয়েছে শীর্ষস্থানে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বদি ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করেছে, যা বর্তমানে বিচারাধীন।
টানা দ্বিতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রীর ছেলে, স্ত্রী ও আতœীয়স্বজনদের ক্ষমতার এ দাপটের চিত্র এখন প্রায় সারা দেশের। তারা খুন-খারাবি থেকে শুরু করে সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্যসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছেন। জোড়া খুন থেকে শুরু করে সাত খুনেও এদের সরাসরি সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। কোথাও চলছে বাপ-বেটার শাসন। কেউ কেউ পরিণত হয়েছেন মূর্তিমান আতঙ্কে। কোনোভাবেই তাদের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। নানা গুরুতর অপরাধে জড়িয়ে পড়া এমপি-মন্ত্রীদের আÍীয়স্বজনের নামের তালিকা দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তাদের এ স্বেচ্ছাচারিতায় সাধারণ মানুষ যেমন আতঙ্কিত, তেমনি সরকার ও দলের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হচ্ছে চরমভাবে। এ অবস্থায় সরকারের নীতিনির্ধারক মহল এর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যেতে শুরু করেছে। গুলি করে শিশু জখম করার দায়ে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন।

সাম্প্রতিক সময়ে এমপি-মন্ত্রীদের আতœীয়স্বজনদের বেপরোয়া আস্ফালন আগেকার সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। আওয়ামী লীগের সংরক্ষিত আসনের এমপি ও মহিলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক পিনু খানের ছেলে বখতিয়ার আলম রনি, ধর্মমন্ত্রী প্রিন্সিপাল মতিউর রহমানের ছেলে মুহিত উর রহমান শান্ত, ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরীর জামাতা তারেক সাঈদ, যুব ও ক্রীড়া উপমন্ত্রী আরিফ খান জয়ের ভাই, ঠাকুরগাঁও-১ আসনের এমপি দবিরুল ইসলামের ছেলে সুজন, ঢাকার সাবেক এমপি এইচ বি এম ইকবালের ভাতিজা ফারিজ রহমান, টাঙ্গাইল-৩ আসনের এমপি আমানুর রহমান খান রানা ও তার ভাইসহ প্রায় দেড় ডজন এমপি-মন্ত্রী ও নেতার স্বজনদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠেছে।

এ ছাড়া একজন প্রভাবশালী প্রেসিডিয়াম সদস্য ও মন্ত্রীর ছেলের বিরুদ্ধে নিয়োগ ও পদায়ন বাণিজ্য করার গুরুতর অভিযোগ খোদ আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড ও সরকারপ্রধানের কাছে জমা পড়েছে। মহিলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক পিনু খান এমপির ছেলে বখতিয়ার আলম রনি ১৩ জুন রাতে রাজধানীর ইস্কাটনে নিজের লাইসেন্সকৃত পিস্তল থেকে এলোপাতাড়ি গুলি করে দুই নিরীহ ব্যক্তিকে খুন করেন। এ ঘটনায় দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। জানা গেছে, প্রায় প্রতি রাতেই মাতাল হয়ে বন্ধুদের নিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়াতেন রনি।

আগে-পিছে গাড়ির বহর নিয়ে হুটার (সাইরেন) বাজিয়ে রাতের ঢাকায় ছড়াতেন আতঙ্ক। মাঝেমধ্যেই তিনি গাড়ির জানালা দিয়ে পিস্তল বের করে গুলি চালিয়ে আনন্দ উল্লাস করতেন। দুজন নিরীহ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়ার ঘটনার আগেও গভীর রাতে রাজধানীর হাতিরপুল ও সংসদ ভবনের সামনে দুই দফা ফাঁকা গুলি ছুড়েছিলেন রনি। তবে সেসব ঘটনায় কেউ হতাহত হয়নি। এমপির স্টিকার থাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তার গাড়ি থামাতেন না।

গত সোমবার বিকালে ধনাঢ্য পরিবারের দুই কিশোর কার রেসিংয়ে মেতে উঠেছিল গুলশানের ব্যস্ত সড়কে। এ সময় আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি এইচ বি এম ইকবালের ভাতিজা ফারিজ রহমানের বেপরোয়া গাড়িচাপায় চারজন গুরুতর আহত হন। এইচ বি এম ইকবাল ১৯৯৬ সালে ঢাকার রমনা-তেজগাঁও আসনে আওয়ামী লীগের এমপি ছিলেন। ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমানের ছেলে মুহিত উর রহমান শান্ত ময়মনসিংহ শহরের এক আতঙ্কের নাম। জেলা আওয়ামী লীগের কোনো পদে না থাকলেও তিনি জেলা আওয়ামী লীগের নেতা পরিচয় দিয়ে বেড়ান বলে অভিযোগ রয়েছে। বাবা মন্ত্রী হওয়ায় মন্ত্রণালয়ের অনেক কাজও শান্ত দেখভাল করে থাকেন। হজযাত্রীদের ব্যাগ তৈরি, সরকারিভাবে হজযাত্রীদের তালিকা তৈরি, পূজা ও ঈদের বিশেষ বরাদ্দে তিনি প্রভাব খাটান বলে জানা গেছে। ময়মনসিংহ শহরের রাজনীতিতে প্রভাব রাখতে যুবলীগ নেতা শাহানুর ও শহর ছাত্রলীগের সভাপতির বাড়িতে কয়েক দফায় হামলা চালিয়েছেন শান্ত। জেলায় জমি দখলের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

এর আগে দেশব্যাপী আলোচিত নারায়ণগঞ্জে সেভেন মার্ডারের ঘটনার সময় আলোচনায় আসেন ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার জামাতা লে. কর্নেল তারেক মোহাম্মদ সাঈদ। নারায়ণগঞ্জের আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডে ক্ষমতাসীন দলের ভাবমূর্তিকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে বর্তমান ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী মায়ার পরিবার। বর্তমানে মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ এক সিনিয়র মন্ত্রীর ছেলের বিরুদ্ধে ওই মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ বাণিজ্য, পদায়ন এবং প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ সরকারপ্রধানের কাছে জমা দিয়েছে কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা। অভিযোগ রয়েছে, ওই মন্ত্রী আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম

মেয়াদে (১৯৯৬-২০০১) কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালনকালে তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল। স্ত্রীর অপকর্মের কারণে ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ওই সিনিয়র নেতা অংশ নিতে পারেননি। এবার গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালনকালে তার ছেলে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে গুঞ্জন চলছে যে কোনো সময় দফতর বদল করা হতে পারে সেই মন্ত্রীর।

যুব ও ক্রীড়া উপমন্ত্রী আরিফ খান জয়ের এক ভাই অমিত খান শুভ্র রাজধানীর মতিঝিল এলাকার বিশেষ করে ক্রীড়াঙ্গনের সব ধরনের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। এ ছাড়া তার হুকুমে নানা ধরনের অপকর্ম ঘটছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তার আরেক ভাই নুরু খান মিঠু নেত্রকোনায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছেন।


শিশুকে গুলি করে পুলিশের হাতে গ্রেফতার মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন সুন্দরগঞ্জের এমপি হলেও এলাকার সবকিছুই দেখভাল করেন তার স্ত্রী সৈয়দা খুরশিদ জাহান স্মৃতি। নেতা-কর্মীদের অভিযোগ শোনা, বিচার, শালিসি সবই করেন তিনি। স্থানীয় স্কুল-কলেজ থেকে সব প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণও তার হাতে। তিনিই মূলত উপজেলা প্রশাসনে খবরদারি করেন। এমনকি উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির মিটিংয়েও তার সরব উপস্থিতি নানা আলোচনার জš§ দিয়েছে। ঠাকুরগাঁওয়ে চলছে বাপ-বেটার শাসন।


এমপি দবিরুল ইসলাম তার ছেলেকে দিয়ে হিন্দুদের জমি দখল করে নিয়েছেন। তার ছেলের দাপটে এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ। এ সরকারের মেয়াদে যশোর-৫ আসনের সাবেক এমপি খান টিপু সুলতানের বড় ছেলে হুমায়ূন সুলতানের বিরুদ্ধে স্ত্রীর হত্যার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়াও গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে রাজশাহী-৩ আসনের মেরাজ উদ্দিন মোল্লা হেরেছেন নতুন প্রার্থী আয়েন উদ্দীনের কাছে। এর আগে বিতর্কিত হওয়ায় তাকে দল থেকে মনোনয়নই দেওয়া হয়নি। জানা যায়, তার বড় ছেলে আবুল কালাম আজাদের নির্দেশে মোহনপুর থানা, মেজ ছেলে জালাল উদ্দীনের নির্দেশে পবা থানা চলত। আর ছোট ছেলে মোস্তাক ছিলেন ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ছেলেদের এসব অপকর্মের খেসারত দিতে হয়েছে মেরাজ উদ্দিন মোল্লাকে।

কুষ্টিয়া-১ আসনে আফাজ উদ্দীন আহমেদও খেসারত দিয়েছেন দুই পুত্রের অপকর্মের। আফাজ উদ্দীনের দুই ছেলের কাছে জিম্মি ছিল দৌলতপুরের মানুষ।

টাঙ্গাইল-৩ আসনের এমপি আমানুর রহমান খান রানা ও তার ভাইদের ক্ষমতার দাপটে অস্থির হয়ে উঠেছে গোটা এলাকার মানুষ। তিনি ও তার পরিবারের কয়েক সদস্যের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, জমি দখলের অভিযোগ পুরনো। এ পরিবার দলের এক নেতাকে খুন করে সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম হয়। টাঙ্গাইলের জনপ্রিয় নেতা ফারুক আহম্মেদ হত্যায় এমপি ও তার তিন ভাই- মুক্তি, বাপ্পা ও কাঁকনের নাম আসে। তাদের সম্পৃক্ততার কথা জানিয়ে জবানবন্দি দেন ফারুক হত্যায় গ্রেফতার ব্যক্তিরা। মাদক, জুয়া, হাউজি, দখল, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজির একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ এ পরিবারের হাতে। কয়েক বছরেই তারা বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন।

রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়নে তরুণদের ভূমিকাকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। অথচ এ তরুণদের ধ্বংসকারী মাদক ইয়াবা চোরাচালানের অঘোষিত গডফাদার আবদুর রহমান বদি এবং তার পাঁচ ভাই। কক্সবাজার-৪ আসন থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের এমপি বদির বিরুদ্ধে মানব পাচারেরও অভিযোগ রয়েছে। বদির বিরুদ্ধে সরকারি কর্মকর্তা ও সাংবাদিক লাঞ্ছনার অভিযোগও আছে। ১২ আগস্ট তিনি উখিয়া উপজেলার প্রকৌশলী (এলজিইডি) মোস্তফা মিনহাজের অফিসে ঢুকে তার কলার ধরে মারধর ও গালিগালাজ করেন। এর আগেও তিনি এমন বহু ঘটনা ঘটিয়েছেন।- বাংলাদেশ প্রতিদিন।

১৬ অক্টোবর,২০১৫/এমটিনিউজ২৪/আসিফ/এআর

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে