তারুণ্যের প্রেম ও সুফল-কুফল
ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান : তথ্য প্রযুক্তির যুগে কম্পিউটার, মোবাইল ও ইন্টারনেট মানুষের দ্রুত যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম। শিশু-কিশোর, যুবক-যুবতী, আবাল-বৃদ্ধ সবাই এ গুলো ব্যবহার করছেন। এ ছাড়া যেন কারো দিন চলছে না। জীবনেরই যেন একটা অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে আজকের নিবন্ধের আলোচ্য বিষয় তারুণ্যের প্রযুক্তিপ্রেম ও বাস্তবতা। এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার আগে আমরা একটু পেছনে ফিরে যাই।
প্রাচীনকালে মানুষই মানুষের যোগাযোগের মাধ্যম ছিল। তখন লোক মারফত সব ধরনের খবর আদান প্রদান হতো। বিশেষ প্রয়োজনে তাদের প্রতিনিধি পাঠিয়ে খবর আদান-প্রদান করতেন। ব্যক্তিগত, কী সামাজিক উভয় ক্ষেত্রেই এই যোগাযোগ মাধ্যমটি ছিল বেশ কার্যকর ও জনপ্রিয়। পরবর্তীতে এটি রাষ্ট্রীয়ভাবেও ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে সেটার আধুনিক রূপ অ্যাম্বেসেডর।
প্রসঙ্গত, আশির দশকে কিশোর বয়সে আমাদের মা-বাবা ও আত্মীয় স্বজনরা এভাবেই যোগাযোগের কাজটি করতেন। প্রসঙ্গত আমরা যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করি, তখন বিশেষ প্রয়োজনে মামা-ফুফু-খালার বাড়িতে আমাদের দিয়ে খবর পাঠানো হতো। এ কাজটি আমাকে প্রায়ই করতে হতো।
আজও স্মরণে আছে, খালা ও ফুফুর বাড়িতে বাবা-মা কিংবা নানা-নানীর কথা পৌঁছে দিতাম, আবার ফেরার পথে ফুফু কিংবা খালার দেয়া খবর বাড়িতে এসে পৌঁছাতাম। এভাবে ছোটকালে কত যে দূতের কাজ করেছি, এর কোনো ইয়ত্তা নেই। প্রত্যন্ত গ্রাম বাংলার কোথাও কোথাও হয়তো এ রেওয়াজ এখনো সীমিত আকারে চালু আছে। কিন্তু সেটা চোখে পড়ার মতো নয়। কারণ মোবাইলের বাটন চাপলেই যেখানে মুহূর্তের মধ্যে খবর আদান-প্রদান হয়, গ্রামবাংলার গৃহবধুরাও যখন সেলফোনে ভিডিও কল করে প্রিয়জনদের সাথে যোগাযোগ করছেন।সেখানে কে এই সনাতন পদ্ধতির আশ্রয় নিবে?
এরপর ছোটকালে দেখতাম চিঠিপত্রও ছিল মানুষের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম। চিঠির মাধ্যমে মানুষ দূরদূরান্তের খবর আদান-প্রদান হতো। কয়েক বছর আগেও এটি বেশ জনপ্রিয় ছিলো। গ্রামবাংলা ও শহরের ডাকঘরগুলো ছিল বেশ জমজমাট। সকাল হলেই রানার চিঠি নিয়ে ছুটতেন গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে। অনেকেই অপেক্ষায় থাকতেন এই চিঠির জন্য। প্রসঙ্গত, যুবক-যুবতীর প্রেম নিবেদন, ভাব বিনিময়ও করতেন এর মাধ্যমেই। ফলে তখন কতই না কদর ছিল এর।
আজ নতুন আবিষ্কার আর প্রযুক্তির প্রভাবে এই দুটি মাধ্যমই হারিয়ে যাচ্ছে। যদিও সমাজে এখনো চিঠিপত্রের রেওয়াজ কিছুটা রয়েছে। ডাকঘরগুলো কোনো মতে টিকে আছে। তবে এতে মানুষের আগের মত আগ্রহ নেই। এখন চিঠির পরিবর্তে মোবাইল, ইন্টারনেট, ই-মেইল- ফেসবুককে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছেন। বিশেষ করে তরুণ সমাজের কাছে এটা বেশ জনপ্রিয়।
যদিও এটা দোষের কিছু নয়, বরং সমাজের উন্নয়ন অগ্রগতির প্রতীক। কিন্তু এরপরও এটি সমাজে তরুণদের মাঝে কতটা ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে তা নিয়ে ভাবনা শুরু হয়েছে। অনেকেই এটাকে খুবই অগ্রগতির মাধ্যম হিসেবে দেখছেন। অন্যদিকে তরুণ সমাজের নীতি-নৈতিকতার অবক্ষয়, শিক্ষা লাভে অমনোযোগিতা, অযথা সময় ব্যয় ও কর্মবিমূখতা ইত্যাদিতে প্রযুক্তির নেতিবাচক প্রভাব হিসেবে দেখছেন।
তবে এই প্রযুক্তির প্রভাব সমাজে কতটা ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে সম্প্রতি তা নিয়ে বেশ বিতর্ক চলছে। এই অগ্রগতি সত্যিই কী আমাদের সমাজের সার্বিক উন্নয়নের প্রতীক, না কোনো কোনো ক্ষেত্রে অগ্রগতির প্রতিবন্ধকতা হয়েছে, তা ভেবে দেখার সময় এসেছে।
সম্প্রতি জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া এইচএসসি পাসের আগে শিক্ষার্থীদের হাতে মোবাইল ফোন না দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এর পেছনে যুক্তি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘মোবাইলের কারণে অনেক সময় ছাত্রীরা যৌন হয়রানি শিকারসহ নানা হয়রানির ঘটনাও ঘটে।’
তিনি এও বলেন, ‘যুগে যুগে সমাজ বিনির্মাণের পুরোধা হচ্ছে যুবকরা। কিন্তু এই যুবকদের সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে চারিত্রিক দৃঢ়তা, সাহসিকতা ও আত্মনির্ভরশীলতা প্রয়াজন।’
তিনি হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘আসলে আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে কিনা তা নিয়েই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।’
এছাড়া সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত দুটি সংবাদ উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। এক. ইন্টারনেটের একটি সফটওয়্যার দিয়ে পুলিশের আইজির ব্যবহৃত মোবাইল ফোন নম্বর ক্লোন করে ফোন করে থানা থেকে ৩ কোটি টাকা আত্মসাতের এক আসামিকে ছাড়িয়ে নেয়া হয়েছে।এমন ধারার আরও কয়েকটি প্রতারণার ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। এরপর আর কী ঘটাতে না পারবে ওরা?
দুই. ভয়ংকর সংবাদ- চলতি বছরের এইচএসসি পরীক্ষায় ফলাফল বিপর্যয়ের পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে শিক্ষাবিদরা চিহ্নিত করেছেন শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার চেয়ে ইন্টারনেটে জনপ্রিয় সামাজিক গণযোগাযোগ সাইট ফেসবুকে বেশি সময় প্রদান করাকে। প্রসঙ্গত, ফেসবুক এখন আর ঘরে ঘরে নয়, মানুষের হাতে হাতে। তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় প্রদত্ত তথ্যে দেখা গেছে, দেশে প্রতি ১২ সেকেন্ডে নতুন একটি অ্যাকাউন্ট খোলা হচ্ছে! অর্থাৎ ফেসবুক ব্যবহারকারী ১৩ কোটি মোবাইল সেট ব্যবহারকারীর সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে!
ফেসবুক শুধু শিক্ষার্থীদের পাঠ-সময়ই হরণ করছে না, তারুণ্যের এই নেশা আরও অনেক সামাজিক সমস্যার জন্ম দিচ্ছে। বিশেষ করে মেয়েদের অশ্লীল ছবি ও ভিডিও ইন্টারনেটে আপলোডের কারণে তৈরি হচ্ছে সামাজিক অস্থিরতা।
দেশকে ডিজিটাল করা নিয়ে আমাদের সরকার দলীয় মন্ত্রী-এমপিরা যেখানে প্রতিনিয়ত বাগাড়ম্বরপূর্ণ কথা বলছেন সেখানে ডেপুটি স্পিকার এবং শিক্ষাবিদদের এমন মন্তব্যে হয়তো অনেকে হতবম্ব। বিশেষ করে তরুণদের মনোক্ষুন্ন করতে পারে।
বিষয়টি যেভাবেই দেখা হোক না কেন, তাদের মন্তব্যটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা, কম্পিউটার- মোবাইল ইন্টারনেট যেমন সমাজের অগ্রগতি তরান্বিত করেছে, তেমনি বেশ কিছুক্ষেত্রে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাবও ফেলেছে। ইতিবাচক প্রভাবগুলো নগদ ও বেশী দৃশ্যমান থাকায় আমরা নেতিবাচক প্রভাবগুলো তেমন গণনায় নিচ্ছি না।
বিশেষ করে তরুণ সমাজের উপর এর নেতিবাচক প্রভাবের ফলে সমাজে নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে। অনেকের মতে, মোবাইল-ইন্টারনেট আসক্তি এখন মাদকাসক্তির চেয়েও বেশী নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। কিশোর-কিশোরীরা এটি ব্যবহারের ফলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটি ব্যাধি হিসেবেও দেখা দিয়েছে।
একজন কিশোর-কিশোরী পড়ার টেবিলে এমন কী ক্লাশে বসেও সহজেই এই ব্যাধির শিকার হচ্ছে। এক্ষেত্রে শিক্ষক কিংবা অভিভাবকের পক্ষে তাদের কার্যক্রম বুঝার উপায় থাকছে না। এই ব্যাধি এখন সমাজে এতই ব্যাপকতা লাভ করেছে যে, এর প্রভাবে বাল্য বিবাহ বৃদ্ধি, শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠা, তরুণদের নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটছে।
এ প্রসঙ্গে ছোট একটি গল্প না বললেই নয়, একটি পরিবারের সঙ্গে আমার বেশ সখ্যতা ছিল। পরিবারটি ছিলো বেশ ধার্মিক প্রকৃতির। মেয়েরা ইসলামী বেশ ভুষা ছাড়া বাইরে বের হতেন না। পরিবারে স্বল্প বয়সী একজন সদস্য ছিলেন। এসএসসি পাস করার পর ওই সদস্য দাবি তোলে কম্পিউটার আর মোবাইলের। বাবা-মা সরল বিশ্বাসে তার দাবি পূরণ করেন। ওই সদস্যটি এসএসসি-এইচএসসি পাসও করে জিপিএ ৫ নিয়ে। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেল এগুলোর প্রভাবে ওই তরুণ সদস্য এমন এক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছল যে, কী শিক্ষা, কী নৈতিকতা, কী আদব কায়দা, কী বাবা মার আনুগত্য সব কিছুতেই তার অবক্ষয় ঘটলো।
নিজের সব অপকর্ম ঢাকতে প্রতি নিয়ত মিথ্যাচারিতার আশ্রয় নিতে থাকলো। এ্সএসসি ও এইচএসসিতে এত ভাল ফল করা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয় পড়াতো দূরের কথা পাস নম্বরও পেল না। অন্যদিকে মোবাইল ইন্টারনেট কালচারের কারণে ভাবাবেগে এমন প্রেমে জড়িয়ে পড়লো যে, তাকে সে পথ থেকে ফেরানোই কষ্ট সাধ্য হয়ে পড়লো অভিভাবকের। এমন পর্যায়ে অভিভাবক তার সন্তানের মোবাইল-ইন্টারনেট ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। কিন্তু এরই মধ্যে যা ক্ষতি হওয়ার তা তো হয়েই গেল।
এটা শুধু একটি পরিবারের চিত্র নয়, বলা যায় আমাদের সমাজে বেশীর ভাগ পরিবারেই এমন সমস্যা দেখা দিয়েছে। ফলে এ নিয়ে সবার মাঝে ভাবনা শুরু হয়েছে।
ডেপুটি স্পিকারের এমন মন্তব্যে- বলা যায়, অনেক পরে হলেও দায়িত্বশীল পর্যায়ে এ নিয়ে টনক নড়েছে। তারা এই তরুণ সমাজকে অবক্ষয় থেকে রক্ষার উপায় নিয়ে ভাবছেন।
এ ক্ষেত্রে ডেপুটি স্পিকার ছোট আকারের মাত্র দুটি বাক্য উচ্চারণ করলেও এর মর্মার্থ অনেক ব্যাপক ও সূদূর প্রসারী। ওনার বক্তব্য শুনে আমার মনে হয়েছে, তাঁর আরো কিছু কথা অব্যক্ত থেকে গেছে, বলতে চাইলেও হয়তো সেগুলো ব্যক্ত করতে পারেননি।
ব্যক্তিগতভাবে আমি তরুণদের কম্পিউটার, মোবাইল-ইন্টারনেট ব্যবহারের বিপক্ষে নই, তবে এর হতে হবে সঠিক ব্যবহার।
ফলে সময় এসেছে আমাদের নতুন করে চিন্তা করার। আমরা যদি এখনই এ সমস্যার সমাধান না করতে পারি, তবে আমাদের তরুণ সমাজ ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে ধাবিত হবে। তখন সে অবস্থান থেকে আমাদের বের হওয়া কঠিন হবে। শিক্ষার মান নিয়ে আরো বেশী করে প্রশ্ন উঠবে।
তাই সবার একটাই লক্ষ্য হওয়া উচিত কোমলমতি শিশু কিশোরদের ভবিষ্যত বিনির্মাণ, এ জন্য আমাদের যা যা করার দরকার তাই করা। ছেলেমেয়েদের অবক্ষয় থেকে রক্ষা করা। তাই আজ মনে পড়ে গেল প্রখ্যাত লেখক যাযাবর এর সেই কথা। তিনি অনেককাল আগে লিখেছিলেন, বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ। প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞান আবেগ কেড়ে না নিলেও বিড়ম্বনার জন্ম কম দেয়নি। সভ্যতার জন্য বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ হবে, তা মূলত নির্ভর করে ব্যবহারকারীর ওপর। এ যুগের আবিষ্কার ইন্টারনেটের কারণে আমাদের মতো মধ্যম আয়ের দেশও অনেক উপকৃত হচ্ছে। সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নত হচ্ছে। তবে এটাও অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, এ প্রযুক্তির অনেক অপব্যবহারও হচ্ছে।
লেখক: শিক্ষা ও সমাজবিষয়ক গবেষক এবং কলাম লেখক। ই-মেইল:
[email protected]