মুরাদ হুসাইন: শিক্ষা খাতের উন্নয়নে সরকার নানা কর্মসূচি গ্রহণ করলেও ঝরেপড়া রোধ করতে পারছে না। যার প্রমাণ মিলছে পাবলিক পরীক্ষায়। জানা গেছে, বিনামূল্যে বই বিতরণ, উপবৃত্তি, বাল্যবিবাহ নিরুৎসাহী, ইংরেজি, বিজ্ঞান ও গণিতের অতিরিক্ত ক্লাসেও কমছে না ঝরেপড়া।বরং প্রতি বছর দীর্ঘ হচ্ছে ঝরেপড়াদের মিছিল।
জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা থেকে এসএসসিতে অংশ নিতে গত দুই বছরে ঝরে গেছে প্রায় আড়াই লাখ শিক্ষার্থী। এজন্য অর্থনৈতিক সমস্যা, শিক্ষা বৈষম্য, সামাজিক অবক্ষয়কে দায়ী করছেন শিক্ষাবিদরা। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক এলিয়াছ হোসেন বলেন, শিক্ষার্থীদের ধরে রাখতে উপবৃত্তি চালু করা হয়েছে।
দুর্বল শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ ক্লাস এবং বাল্যবিবাহ নিরুৎসাহের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এসব উদ্যোগের কারণে দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে আগের চেয়ে শিক্ষার্থী ঝরেপড়া অনেক কমেছে। ২০১৪ সালে জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষায় ১৮ লাখ ৪৫ হাজার ৭৩২ পরীক্ষার্থী পাস করে। তারাই এবারের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে।
মঙ্গলবার দুপুরে সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ জানান, এবারের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ১৬ লাখ ৭ হাজার ১২৪ নিয়মিত শিক্ষার্থী অংশ নিচ্ছে। শিক্ষামন্ত্রীর দেয়া এ তথ্য অনুযায়ী দুই বছরে ঝরে পড়েছে ২ লাখ ৩৮ হাজার ৬০৮ শিক্ষার্থী। চলতি বছর এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে ১৬ লাখ ৯৫ হাজার ৪৬৭ শিক্ষার্থী নবম শ্রেণিতে নিবন্ধন করেছিল। কিন্তু এসএসসির ফরম পূরণ করে ১৪ লাখ ৭৪ হাজার ৯২৭ শিক্ষার্থী। এ হিসাবে ঝরে পড়েছে ২ লাখ ২০ হাজার ৫৪০ শিক্ষার্থী, যা নিবন্ধনের ১৩ শতাংশ। আর আগের বছর ১ লাখ ৮৭ হাজার শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে।
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মোসা. সুফিয়া খাতুন বলেন, দারিদ্র্য এবং বাল্যবিবাহের কারণে প্রধানত এ স্তরের শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে। ঝরেপড়া ঠেকাতে অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। এছাড়া শিক্ষকদের পাশাপাশি রাষ্ট্রকেও সামাজিক সুরক্ষা দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের ঝরেপড়া বন্ধে সরকার বিনামূল্যে বই বিতরণ, উপবৃত্তি ও বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় মাধ্যমিক শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে ২০০৩ সাল থেকে সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইনভেস্টমেন্ট প্রজেক্ট (সেসিপ) নামে একটি প্রকল্প চালু করে।
এ প্রকল্পের মাধ্যমে ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞানে শিক্ষার্থীদের ভীতি দূর করতে প্রতি মাসে ১ ঘণ্টা করে অতিরিক্ত ১৮টি ক্লাস নেয়া হয়। এজন্য সারাদেশে এক হাজার স্কুলে ২৫ হাজার টাকা মাসিক বেতনে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু কিছুতেই যেন কাজ হচ্ছে না। সূত্রমতে, মাধ্যমিক স্তরে ঝরেপড়ার মূল কারণ সামাজিক এবং অর্থনৈতিক। মাধ্যমিকে ঝরেপড়া শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ মেয়ে। মাধ্যমিক স্তরে উপবৃত্তির নীতিমালায় কঠোর শর্তারোপের কারণে অনেক দরিদ্র পরিবারের মেয়েরা বৃত্তি পাচ্ছেন না।
বৃত্তি না পাওয়ায় লেখাপাড়া বন্ধ করে দিচ্ছে। মেয়েদের অনেকেই স্কুল ছেড়ে সংসার শুরু করেছে। আর ছেলেরা যোগ দিচ্ছে কাজে। কারণ পড়ালেখার চেয়ে কাজের মাধ্যমে আয় করাই লাভজনক বলে মনে করে পরিবার।বিশেষ করে চরাঞ্চল, হাওর ও পাহাড়ের চিত্র খুবই উদ্বেগজনক। দুর্গম এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দূরত্বও এ ক্ষেত্রে অনেকটা দায়ী।
শহর ও গ্রামের মধ্যে শিক্ষা বৈষম্যকে ঝরেপড়ার প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. একরামুল কবির। তিনি বলেন, অভাবের কারণে গ্রামের অনেক শিক্ষার্থী কাজে যোগ দেয়। মেয়েদের বাল্যবিবাহ হচ্ছে। সামাজিক অবক্ষয়ের কারণেও শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে। শিক্ষাবিদ ইমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, শিক্ষা উপকরণ থেকে শুরু করে কোচিং, গাইড, বই সবকিছু মিলিয়ে শিক্ষা এখন বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। অনেকের পক্ষেই এ ব্যয় বহন সম্ভব হচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, লেখাপড়ার সঙ্গে জীবিকার সম্পর্ক নেই। লেখাপড়া দিয়ে বেকারত্ব দূর হবে এমনটিও নিশ্চিতও নয়। ফলে সমস্যাটা অর্থনৈতিক। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন বলেন, শিক্ষার্থীর ঝরেপড়ার হার আগের চেয়ে কমেছে। তবে নানা উদ্যোগের পরও এ হার প্রত্যাশিত নয়। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, গ্রামের শিক্ষার্থীরা জেএসসি পাসের পর অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে। মেয়েদের বিয়ে দেয়া হচ্ছে। এসব কারণে ঝরেপড়া বন্ধ হচ্ছে না। ঝরেপড়া রোধে শিক্ষা মন্ত্রণালয় আরও কঠোর হবে বলে জানান তিনি।-জাগোনিউজ
০১ ফেব্রুয়ারি,২০১৭/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ