মাহবুব হাসান ও হাবিবুর রহমান খান : আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রায় দুই বছর আগেই নানা প্রস্তুতি শুরু করেছে দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। এরই মধ্যে নির্বাচনী ইশতেহার তৈরির প্রাথমিক কাজ এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব মেটাতে নানা তৎপরতা চালাচ্ছে দল দুটি।
৫ জানুয়ারির ‘নির্বাচন’র বিষয়টি যাতে আগামী নির্বাচনের ওপর কোনো ধরনের নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে, তা সামনে রেখেই আগাম প্রস্তুতি আওয়ামী লীগের। আর এ লক্ষ্যেই গণসংযোগ বাড়ানো, জেলা-উপজেলায় রাজনৈতিক কর্মসূচির আয়োজন ও সেখানে কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়মিত উপস্থিতি এবং জনগণের সামনে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরছেন ক্ষমতাসীনরা।
অন্যদিকে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে আগামী নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে বিএনপি। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় না থাকায় এবং হামলা-মামলায় জর্জরিত হতাশাগ্রস্ত নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করতে দলের সব স্তরে পুনর্গঠনসহ আগাম নির্বাচনী প্রস্তুতির অংশ হিসেবে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে দলটি।
কোনো ঝুঁকি নিতে চায় না আওয়ামী লীগ : ‘নির্বাচনী মিশন’-এ নেমেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রায় দু’বছর বাকি থাকলেও দলটি শুরু করেছে ব্যাপক গণসংযোগ। চলছে নেতাদের সাংগঠনিক সফর। পাশাপাশি দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধ মেটাতে শুরু হয়েছে নানা তৎপরতা।
নেতারা শুধু রাজনৈতিক কর্মসূচিতেই নয়, অংশ নিচ্ছেন বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানেও। নিজ নির্বাচনী এলাকা ছাড়াও জেলা-উপজেলায় নিয়মিত উপস্থিতি বেড়েছে কেন্দ্রীয় নেতাদের। এসব অনুষ্ঠানে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরছেন তারা। এর মাধ্যমে কার্যত আগামী নির্বাচনের মাঠ গুছিয়ে আনছে ক্ষমতাসীনরা।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ‘একতরফা নির্বাচন’-এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ টানা দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসে। এতে দেশের ভেতর-বাইরে দলটি বেশ সমালোচিতও হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ধীরে ধীরে প্রতিকূল অবস্থা কাটিয়ে উঠেছে বলে মনে করছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। তাদের মতে, বহির্বিশ্বের সঙ্গেও আশানুরূপ সম্পর্ক উন্নয়ন করতে সমর্থ হয়েছে বর্তমান সরকার। এরপরও যাতে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের কোনো নেতিবাচক প্রভাব আগামী নির্বাচনে না পড়ে, তা সামনে রেখেই আগাম প্রস্তুতি শুরু করেছে ক্ষমতাসীনরা।
পাশাপাশি আগামী নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হলে ‘আগের রাজনৈতিক সংস্কৃতি’ অনুযায়ী ক্ষমতাসীন হওয়ায় আওয়ামী লীগের বিপক্ষে ফল যেতে পারে বলেও আশংকা কোনো কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষকের। এ বিষয়টিও আগাম প্রস্তুতির ক্ষেত্রে বিবেচনায় রয়েছে দলটির। অর্থাৎ নির্বাচনের ফল নিজেদের পক্ষে রাখতে কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে চায় না আওয়ামী লীগ। যে কারণে জনসমর্থন আদায়ে সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত রাখবে দলটি।
গত ১৪ জানুয়ারি দলের একটি সভায় আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী প্রস্তুতি নিতে নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘আমরা তিন বছর পূর্ণ করে চার বছরে পা দিয়েছি। টানা আট বছর। কাজেই এখনকার পথ হবে আরও কঠিন। এখন থেকেই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে হবে।’ নির্বাচনে দলের ইশতেহারের কাজ শুরু হয়েছে বলেও জানান তিনি। এর আগে দলের ২০তম জাতীয় সম্মেলনেও শেখ হাসিনা সব নেতাকর্মীকে আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর পাশাপাশি সরকারের গৃহীত ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তিনি জনগণের সামনে তুলে ধরার নির্দেশ দেন।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম যুগান্তরকে বলেন, তারা নির্বাচনকে সামনে রেখেই গণসংযোগ বাড়িয়েছেন। বিভিন্ন এলাকা সফর করছেন। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডগুলো নিজেরা তদারকি করছেন। এসবের মাধ্যমে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর কাজটিও হচ্ছে। সার্বিকভাবে বলতে গেলে আমরা নিজেদের নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করছি।
দলীয় সূত্র জানায়, চলতি জানুয়ারি থেকে আওয়ামী লীগের প্রতিটি কর্মকাণ্ড নির্বাচনমুখী। শুরু হয়েছে সাংগঠনিক সফর। ৮টি বিভাগীয় টিমে ভাগ হয়ে জেলা-উপজেলায় যাচ্ছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। যেখানেই যাচ্ছেন, সমাবেশ, জনসভা ও প্রতিনিধি সম্মেলনের পাশাপাশি সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন তারা। তুলে ধরছেন দেশের উন্নয়ন এবং সরকারের অর্জনগুলো। যদিও এ প্রবণতা শুরু করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে।
ডিসেম্বরে হযরত শাহজালাল (রা.) মাজার জিয়ারত করে আনুষ্ঠানিক নির্বাচনী সফর শুরু করার কথা থাকলেও তখন জেলা পরিষদ নির্বাচন থাকায় শুধু সরকারি কর্মসূচিতেই সফর সীমাবদ্ধ রাখেন শেখ হাসিনা। কিন্তু জানুয়ারি থেকেই তার অভ্যন্তরীণ সফরে যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। তিনি গত ২৬ জানুয়ারি গোপালগঞ্জ সফরে যান। সেখানে সরকারি কর্মসূচি শেষে তিনি গোপালগঞ্জ শহরে তার পৈতৃক বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে বসেন প্রথমবার।
সেখানে নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন তিনি। ঢাকায় ফিরে একদিন পরেই তিনি যান চট্টগ্রামে। সেখানে তিনি ইন্সটিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স (আইইবি)-এর চট্টগ্রাম কেন্দ্রের ৫৭তম জাতীয় কনভেনশনে যোগ দেন। চলতি ফেব্রুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী আরও কয়েকটি জেলা সফর করবেন বলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্র জানায়। সফরের ক্ষেত্রে তিনি অনেক দিন যেসব জেলা-উপজেলায় যাননি এমন স্থানগুলোকে গুরুত্ব দেবেন। এ ছাড়া প্রতিটি সফরেই একটি করে জনসভায় তিনি জাতির উদ্দেশে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দেবেন বলেও অনানুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত রয়েছে।
সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে আগাম নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছেন শেখ হাসিনা। তার ধারাবাহিকতায় চলছেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও। তিনি ইতিমধ্যে চট্টগ্রামে দুই দফা, কুষ্টিয়া, যশোর, ময়মনসিংহ, রংপুর, নোয়াখালীসহ বেশ কয়েকটি জেলায় রাজনৈতিক-সামাজিক কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। এমনকি ঢাকায় যুবলীগের একটি ওয়ার্ড সম্মেলনেও প্রধান অতিথি হিসেবে অংশ নেন। বসে নেই দলের অন্য শীর্ষ নেতারাও। প্রেসিডিয়াম সদস্য মতিয়া চৌধুরী, মোহাম্মদ নাসিম, কাজী জাফর উল্লাহ, ড. আবদুর রাজ্জাক, কর্নেল (অব.) ফারুক খান নিয়মিতই যাচ্ছেন নিজ নির্বাচনী এলাকাসহ অন্যান্য জেলাতেও।
গত ১২ নভেম্বর এবং ২৫ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম সফর করেন ওবায়দুল কাদের। প্রথম দফায় নিজের সংবর্ধনা উপলক্ষে গেলেও দ্বিতীয় দফায় তিনি সেখানে যান দলের কোন্দল মেটাতে। চট্টগ্রামের বর্ষীয়ান জননেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর বাসায় গিয়ে তিনি সেখানকার আরেক নেতা ও চট্টগ্রামের মেয়র আ জ ম নাছিরের মধ্যে সৃষ্ট দূরত্ব কমানোর উদ্যোগ নেন। ছাত্রলীগের বিবদমান দুই গ্রুপের নেতাদের মধ্যেও দ্বন্দ্ব মিটিয়ে ফেলতে নির্দেশ দেন তিনি। এ ছাড়া নিজ জেলা নোয়াখালীতে তিনি এরই মধ্যে একাধিকবার সফর করেছেন। গিয়েছেন দলের আরেক নেতা মাহবুবউল আলম হানিফের জেলা কুষ্টিয়াতেও। সম্প্রতি যশোর কবি মধুসূদন দত্তের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে মধু মেলায় যোগ দেন।
ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে দুই যুগ্ম সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ, জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য এসএম কামাল হোসেন প্রমুখ বৃহত্তর রংপুর সফর করেন। তারা গত ২৭, ২৮ ও ২৯ জানুয়ারি গাইবান্ধা ও রংপুরে একটি শোকসভা, বিভাগীয় প্রতিনিধি সম্মেলন এবং সমাবেশে অংশ নেন। সড়কপথে রংপুরে যাওয়ার পথে সিরাজগঞ্জে পথসভা এবং বগুড়ায় একটি সমাবেশেও অংশ নেন নেতারা।
এ দৌড়ে শামিল হয়েছেন অন্য শীর্ষ নেতা এবং বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকরাও। দলের অন্যতম নীতিনির্ধারক প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ১৪ দলের দেশব্যাপী কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেয়ার পাশাপাশি নিজ নির্বাচনী এলাকায় নিয়মিত সফর করছেন। গত ১৭ জানুয়ারি নিজ নির্বাচনী এলাকায় তিনি দলের আরেক শীর্ষ নেতা আমির হোসেন আমুকে নিয়ে সমাবেশ করেন।
আবার গত ৫ ফেব্রুয়ারি তার সঙ্গে সিরাজগঞ্জ সফরে যান দলের অন্যতম সিনিয়র নেতা তোফায়েল আহমেদও। এরই মধ্যে মোহাম্মদ নাসিম বরিশালও সফর করেছেন। ওই সফরে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের বরিশাল বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। তিনি বলেন, বৃহত্তর বরিশালে পর্যায়ক্রমে শীর্ষ নেতাদের অনেকেই সফর করবেন।
সফরে পিছিয়ে নেই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফও। তিনি খুলনা, রংপুর, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহসহ অনেক জেলাতেই বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। আরেক যুগ্ম সম্পাদক আবদুর রহমান গত ১৯ জানুয়ারি তার দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভাগ খুলনায় প্রতিনিধি সম্মেলন করেছেন। নিয়মিতই যাচ্ছেন নিজ জেলা ফরিদপুরে। ইতিমধ্যে দলের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক একেএম এনামুল হক শামীম চাঁদপুর জেলা সফর করেছেন।
সেখানে তিনি ২টি সমাবেশে যোগ দেয়ার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ বিরোধ মেটাতে তৃণমূল নেতাদের সঙ্গেও কথা বলেন। ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সফলতার পর এখন কথা বলছেন জেলা-উপজেলা নেতাদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ঢাকায় এখন পর্যন্ত মানিকগঞ্জে একটি সফর হয়েছে। পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন জেলাতেও কর্মসূচি নেয়া হবে।
আওয়ামী লীগের ময়মনসিংহ বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ জানান, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহবুবুল হক শাকিলের স্মরণসভাকে কেন্দ্র করে সেখানে দলের নেতাদের বড় একটি জমায়েত হয়। দলের শীর্ষ পর্যায়ের অনেক নেতা সেখানে যোগ দেন।
সিরাজ জানান, তিনি এরই মধ্যে দুই দফা ময়মনসিংহ সফর করেছেন। প্রতিটি জেলায় বর্ধিত সভা এবং বিভাগীয় প্রতিনিধি সম্মেলন করার পরিকল্পনা জানান তিনি। দলে নতুন দায়িত্ব পেয়ে বন ও পরিবেশ সম্পাদক দোলোয়ার হোসেন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের পর সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে অন্তত ৬টি জেলা সফরে অংশ নিয়েছেন।
এদিকে গত কিছুদিন সারা দেশে কর্মসূচি পালন করেছে ১৪ দলও। জোটের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিমের নেতৃত্বে নেতারা উত্তরবঙ্গে শীতবস্ত্র বিতরণ করেন। গাইবান্ধায় সাঁওতাল পল্লী এবং নাসিরনগরে সংখ্যালঘু হামলার ঘটনার পর ২টি স্থানই সফর করে জোট।
গণসংযোগ এবং প্রচারণার পাশাপাশি দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধ মেটাতেও তৎপর হয়েছে আওয়ামী লীগ। ওবায়দুল কাদের যেখানেই যাচ্ছেন দলের বিভেদের বিরুদ্ধে হুশিয়ারি উচ্চারণ করছেন। বিরোধ মেটাতে কাজ করছেন সাংগঠনিক সম্পাদকরা। বিরোধপূর্ণ এলাকায় গিয়ে কিংবা তাদের সঙ্গে ফোনে কথা বলে দ্বন্দ্ব মেটানোর চেষ্টা করছেন তারা। নেতারা প্রকাশ্যে বক্তব্যেই বলছেন, আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ থাকলে কেউই তাদের হারাতে পারবে না। তাছাড়া বিরোধ কমে গেলে বিদ্রোহী প্রার্থীর হাত থেকেও রেহাই পাওয়া যাবে বলে মনে করছেন দলটির শীর্ষ নেতারা।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ বলেন, যদিও নির্বাচনের এখনও দু’বছর বাকি। কিন্তু একটি নির্বাচনের পরদিন থেকেই আসলে পরবর্তী নির্বাচনের দিকে তাকাতে হয়। আমরা তাই করছি। দলকে সুসংগঠিত করতে কাজ করছি। জনগণের কাছাকাছি থাকতে চেয়েছি। দেশের উন্নয়ন ও অর্জনে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে চেয়েছি। নিজেদের ঐক্য সুদৃঢ় করছি। একমাত্র নির্বাচনই যেহেতু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকার পরিচালনার সুযোগ করে দিতে পারে, আমরা সেই নির্বাচনী বিজয়ী হওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছি।
চাপের মুখেও দল গোছাচ্ছে বিএনপি : আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ঘরোয়াভাবে প্রস্তুতি শুরু করেছে বিএনপি। এ লক্ষ্যে একটি কর্মপরিকল্পনাও তৈরি করছে দলটির হাইকমান্ড। এরই অংশ হিসেবে পুরোদমে চলছে দল পুনর্গঠনের কাজ। নির্বাচনে ইতিবাচক ফল আনতে ঢেলে সাজানো হচ্ছে সব উইং।
এরই মধ্যে প্রায় অর্ধেক সাংগঠনিক জেলার নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। মূল দলের পাশাপাশি অঙ্গসংগঠনের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিগুলোও পুনর্গঠন করা হচ্ছে। পাশাপাশি সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা, নির্বাচনী ইশতেহার তৈরিসহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর প্রাথমিক কাজ শুরু করেছেন দলটির সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া সম্ভাব্য প্রার্থীদের অনেকে হাইকমান্ডের ‘সবুজ সংকেত’ পেয়ে নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় নিয়মিত যাওয়া-আসা শুরু করেছেন।
দলীয় সূত্র জানায়, হামলা-মামলাসহ নানা চাপের মুখে পড়ে বাধ্য হয়ে ঘরোয় প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেছে বিএনপি। এরপরও সব দুর্বলতা ও ভুলত্রুটি শুধরে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে আগামী নির্বাচনী মাঠে নামতে চায় দলটি। এক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে দল গোছানোকে। তারা মনে করেন, নির্বাচনে ইতিবাচক ফলের জন্য শক্তিশালী সংগঠনের বিকল্প নেই। বিগত সরকারবিরোধী দুই দফা আন্দোলনে তৃণমূলের সাংগঠনিক অবস্থা তছনছ হয়ে পড়ে। হামলা, মামলা ও ক্ষমতাসীনদের নানা নির্যাতনে অনেক এলাকায় নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়ে দলটি।
সাংগঠনিক দুর্বলতার চিত্র বিগত স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও ফুটে উঠে। সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে পরাজয়ের পেছনে অন্যতম কারণ মনে করা হচ্ছে সাংগঠনিক দুর্বলতা। সংগঠন শক্তিশালী না থাকায় সরকারবিরোধী ভোট টানতে ব্যর্থ হয় দলটি। সাংগঠনিক দুর্বলতার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিয়েও চিন্তিত দলটির হাইকমান্ড। তাই কোন্দল নিরসন করে সংগঠনকে শক্তিশালী করার দিকেই নজর হাইকমান্ডের। এ লক্ষ্যে পুরোদমে চলছে তৃণমূল পুনর্গঠনের কাজ।
দলটির নেতারা মনে করেন, বিএনপির মতো বড় দলে পদের চেয়ে নেতার সংখ্যা বেশি। তাই যে কোনো কমিটি ঘোষণার পর একটি অংশের বিদ্রোহ দেখা যায়। নির্বাচনের আগে আগে এসব কমিটি করা হলে সময় স্বল্পতার কারণে কোন্দল নিরসন করা সম্ভব হতো না। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ত জাতীয় নির্বাচনে।
এ বিষয়টি মাথায় রেখে দুই বছর আগে থেকেই দল গোছানোর কাজে হাত দেয়া হয়েছে। নতুন কমিটি ঘোষণার পর পরিস্থিতি যাতে সামাল দেয়া যায়। বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনগুলোর পুনর্গঠনের কাজ শেষ হলেই আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী প্রচারে নামবে দলটির হাইকমান্ড। নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ থাকলে সাধারণ ভোটারদের মধ্যেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বিএনপির এক নীতিনির্ধারক জানান, নির্বাচনের এতদিন আগে ইশতেহার তৈরির পেছনেও যথেষ্ট কারণ রয়েছে। আগামী নির্বাচনের আগে এমন একটি ইশতেহার দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে যা সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য হয়। তাই এখন থেকেই ইশতেহারের খসড়া তৈরি করা হচ্ছে। এগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাছাই-বাছাই শেষে তৈরি করা হবে চূড়ান্ত ইশতেহার। কথার গল্পমালায় না সাজিয়ে বাস্তবতার আলোকেই ইশতেহার তৈরি করা হবে বলে জানান ওই নেতা।
জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, বিএনপি একটি নির্বাচনমুখী দল। আমরা সম সময় নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত আছি। নির্বাচনের মাধ্যমেই আমরা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যেতে চাই। অতীতে আমরা বেশ কয়েকবার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছি। তাই যে কোনো সময় নির্বাচন হলে বিএনপি এতে অংশ নেয়ার মতো ক্ষমতা রাখে। তিনি বলেন, নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার ও স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের অধীন আমরা নির্বাচন চাই। যাতে সব দল অংশগ্রহণ করতে পারে এবং ভোটাররা নির্ভয়ে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন।
বিএনপির নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের অন্যতম শর্ত হচ্ছে একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন। সেই কমিশন গঠনকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপের পর অনেকটা আশাবাদী হলেও সার্চ কমিটি ঘোষণায় হতাশ ও ক্ষুব্ধ হন তারা। কিন্তু তবুও হাল ছাড়ছেন না। নির্বাচন কমিশন গঠনের আগে ক্ষমতাসীনদের চাপে রাখা সম্ভব হলে ন্যূনতম গ্রহণযোগ্য একটি ইসি গঠনে সরকারকে বাধ্য করা যাবে।
ন্যূনতম গ্রহণযোগ্য ইসি গঠন হলেও আপাতত বড় ধরনের আন্দোলনে যাবে না দলটি। এরপর তারা নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার গঠনের ওপরই জোর দেবে। দলটির নেতারা মনে করেন, নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার নিরপেক্ষ না হলে ইসি যতই শক্তিশালী হোক তাদের পক্ষে অবাধ নির্বাচন করা সম্ভব হবে না। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পূর্বশর্ত হচ্ছে- নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার। তাই অনেক কিছু ছাড় দিয়ে হলেও তারা সহায়ক সরকার বাস্তবায়নেই গুরুত্ব দেবে। তাই আগামী কয়েক মাসে দলটি এমন কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত নেবে না যাতে নির্বাচনের সার্বিক পরিবেশ নষ্ট হয়ে যায়।
তাদের মতে, নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন হলে বিএনপি বিপুল ভোটে জয়লাভ করবে। দলীয় ভোটের পাশাপাশি সরকারবিরোধী বড় একটি অংশের ভোটও তাদের বাক্সে পড়বে। তাই যে কোনো মূল্যে সব দলের অংশগ্রহণে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনই তাদের মূল লক্ষ্য। এ লক্ষ্যে সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে সর্বস্তরে দল গুছিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা।
সম্প্রতি তৃণমূল পুনর্গঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা মোহাম্মদ শাহজাহানসহ সংশ্লিষ্টদের ডেকে কথা বলেন দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। সেখানে তৃণমূল পুনর্গঠনের সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে চাওয়া হয়। মোহাম্মদ শাহজাহান পুরো বিষয়টি চেয়ারপারসনকে অবহিত করেন। এরপর খালেদা জিয়া তাকে দ্রুত বাকি জেলা কমিটিগুলোর পুনর্গঠন শেষ করার নির্দেশ দেন। চেয়ারপারসনের এমন নির্দেশনা পাওয়ার পর মোহাম্মদ শাহজাহান বাকি কমিটি শেষ করতে দ্রুত কাজ করে যাচ্ছেন।
পুনর্গঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক নেতা বলেন, দল গোছানোর পাশাপাশি তাদের কিছু নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। পুনর্গঠনের পাশাপাশি প্রতিটি সংসদীয় আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে বলা হয়েছে। যারা আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পেতে ইচ্ছুক তাদের জেলা বা উপজেলায় গুরুত্বপূর্ণ পদ না দিতে হাইকমান্ডের পরোক্ষ নির্দেশনা রয়েছে।
জানতে চাইলে মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, তৃণমূল পুনর্গঠনের কাজ পুরোদমে চলছে। ক্ষমতাসীন দলের বাধাসহ কিছু জটিলতার কারণে নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করা যাচ্ছে না। তারপরও আমরা থেমে নেই। আশা করি, দ্রুত সময়ের মধ্যে সব ইউনিটের কমিটি গঠন শেষ করা সম্ভব হবে। আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পর্কে তিনি বলেন, বিএনপির মতো একটি বড় দলের সব সময় নির্বাচনের প্রস্তুতি থাকে। নির্বাচনের জন্য সংগঠনের বিকল্প নেই। আমরা এখন সংগঠন গোছানোর দিকেই নজর দিচ্ছি।
মূল দলের পাশাপাশি অঙ্গসংগঠনগুলো পুনর্গঠনের কাজ পুরোদমে চলছে। ইতিমধ্যে স্বেচ্ছাসেবক দল, যুবদল, মহিলা দলের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। কৃষক দল, তাঁতী দলসহ অন্য কমিটিগুলোরও কাজ চলছে। ঢাকা মহানগরীতে গতি আনতে দুই ভাগে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। দ্রুতই ঘোষণা করা হবে উত্তর ও দক্ষিণের নতুন কমিটি। সংগঠন গোছানোর পাশাপাশি সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা তৈরির কাজও শুরু করেছে দলটি। ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে দল থেকে যাদের মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল ওই তালিকার ওপর ভিত্তি করেই কাজ করা হচ্ছে।
ওই দুই নির্বাচনে যারা মুত্যুবরণ করেছেন বা দলে নিষ্ক্রিয় তাদের বাদ দেয়া হচ্ছে। প্রতিটি সংসদীয় আসনে কমপক্ষে তিনজন করে সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ছাড়া গোপনে জরিপ চালিয়েও একটি তালিকা তৈরি করবে হাইকমান্ড। দুই তালিকা থেকে সমন্বয় করে মনোনয়ন চূড়ান্ত করা হবে। এলাকায় গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে মাঠে ছিলেন এবং দলের প্রতি আনুগত্য রয়েছে এমন যোগ্যতা বিবেচনায় নিয়েই করা হচ্ছে এসব তালিকা। এ লক্ষ্যে কেন্দ্রীয়ভাবে জেলা ও উপজেলা বিএনপি কমিটির ‘সুপার ফাইভ’ নেতাদের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে।
সূত্র জানায়, সম্ভাব্য প্রার্থীদের অনেকে সবুজ সংকেত পেয়ে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছেন। ঢাকা মহানগরের সিনিয়র এক নেতা রাজধানীর একটি আসনে নিয়মিত স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। সম্প্র্রতি ওই নেতাকে এর কারণ জানতে চাইলে তিনি যুগান্তরকে জানান, চেয়ারপারসন তাকে রাজধানীর ওই আসন থেকে আগামী নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। তার নির্দেশেই প্রতি সপ্তাহে একদিন সেখানে যাচ্ছি।
জানা গেছে, সবকিছু ঠিক থাকলে ২০ দলের ব্যানারেই আগামী নির্বাচনে যাচ্ছে বিএনপি। জামায়াত নির্বাচন করতে না পারায় এবার আসন ভাগাভাগি নিয়ে জটিলতা কম হবে। জামায়াত ছাড়া অন্য দলগুলোর কয়েকটিকে কিছু আসন ছাড় দিলেই তারা খুশি হবেন। সর্বোচ্চ ৪০ থেকে ৫০টি আসন জোটের শরিকদের ছাড় দেয়া হতে পারে। সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকার পাশাপাশি আগামী নির্বাচনের ইশতেহার তৈরির লক্ষ্যে ঘরোয়া প্রস্তুতি শুরু করেছে দলটি। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ কয়েক নেতার পাশাপাশি পেশাজীবীদের সম্পৃক্ত করা হয়েছে এ কাজে।
খাত অনুযায়ী কাজ করতে অভিজ্ঞদের দায়িত্বও দিয়েছেন দলের চেয়ারপারসন। ‘ভিশন ২০৩০’-এর আলোকেই তৈরি করা হবে আগামী নির্বাচনী ইশতেহার। জানতে চাইলে বিএনপির চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান শামীম বলেন, আমরা আন্দোলন ও নির্বাচনের লক্ষ্যে দল গোছানোর কাজ করছি। তৃণমূলে নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরও নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে। উৎসবমুখর পরিবেশে যোগ্য প্রার্থীকে তারা ভোট দিতে মুখিয়ে আছে। জনগণের সেই ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেয়ার লক্ষ্যেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
কুষ্টিয়া-৩ আসনের বিএনপি দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যক্ষ সোহরাবউদ্দিন বলেন, সরকারের হামলা-মামলা উপেক্ষা করেও নেতাকর্মীদের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি, এখনও করছি। সংগঠন গোছানোর পাশাপাশি নির্বাচনেরও প্রস্তুতি নিচ্ছি। - যুগান্তর
৪ ফেব্রুয়ারি,২০১৭/এমটিনিউজ২৪/এসবি