নিউজ ডেস্ক : পিতার মুখাগ্নি করলেন একমাত্র সন্তান। দাউ দাউ করে ছড়িয়ে পড়ে সে আগুন চন্দন কাঠে সাজানো চিতায়। যে চিতায় শুয়ে আছেন ভাটি-বাংলার সিংহপুরুষ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। ধোঁয়া হয়ে একটি ইতিহাস যেন আকাশের গায়ে ঠিকানা পাততে উড়ে চলেছে।
শেষকৃত্যের আগে সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নিজ নির্বাচনী এলাকা দিরাই এবং শাল্লায় দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। ভাটি বাংলা থেকে উঠে এসে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রায় সব সংসদে প্রতিনিধিত্ব করা এই জননায়কের শোকাতুর বিদায় শোকে মুহ্যমান ভাটির প্রকৃতিও। গতকাল সন্ধ্যায় দিরাই পৌর সদরের আনোয়ারপুরে নিজ বাসার আঙিনায় নির্মিত অস্থায়ী চিতায় দাহ করা হয় সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে। ৬টা ৩২ মিনিটে মুখাগ্নি করেন তার একমাত্র সন্তান সৌমেন সেনগুপ্ত। ছেলের চোখের জল তখন ছড়িয়ে পড়ে উপস্থিত সকলের চোখেই।
এর আগে বিকাল সাড়ে ৩টায় সুরঞ্জিতের মরদেহবাহী হেলিকপ্টার দিরাইয়ে অবতরণ করে। তখন সেখানে শোকাবহ পরিবেশের সৃষ্টি হয়। কান্নায় ভেঙে পড়েন নেতা কর্মী সমর্থকরা। ধর্মীয় আচারাদি সম্পন্ন করার জন্য এরপর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় দিরাই মধ্যবাজারের জগন্নাথ জিউড় আখড়ায়। সেখান থেকে মরদেহ নিয়ে আসা হয় তার বাসায়। পুলিশের সশস্ত্র অভিবাদনের পর মরদেহ আনা হয় স্থানীয় বালুর মাঠে নির্মিত মঞ্চে সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। সেখানে দলীয় নেতাকর্মী, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, উপজেলা প্রশাসন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, প্রেস ক্লাব, সামাজিক সংগঠনের নেতারা ফুল দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানান।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন মহিবুর রহমান মানিক এমপি, আবদুল মজিদ এমপি, সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান, সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী, সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার এনামুল কবির ইমন, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাবেক উপ-কমিটির সদস্য আজিজুস সামাদ ডন। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে মরদেহ নিয়ে আসা হয় আবার সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বাড়ির আঙিনায়। নিজের হাতে লাগানো চন্দন গাছের কাঠে সাজানো চিতায় তোলা হয় সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মরদেহ।
এর আগে সকালে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য হেলিকপ্টারযোগে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মরদেহ সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নিয়ে আসা হয়। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে চিরবিদায় জানাতে গতকাল সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার হয়ে উঠেছিল লোকারণ্য। ফুলে ফুলে ঢেকে দেয়া হয় প্রিয় নেতার মরদেহ রাখা কফিন। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে দাপট দেখানো ‘দাদা’র নিরব-নিস্তব্ধ মুখখানি দেখে চোখের জল ফেলেছেন দীর্ঘ দিনের রাজনৈতিক সহকর্মীরা।
সকাল ৯টা থেকেই শহীদ মিনারে শোকার্ত জনতার ভিড় জমতে থাকে। ফুলের মালা সবার হাতে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে কালো কাপড়ের মঞ্চ তৈরি করে রাখা হয়েছিল আগেই। ১০টা বাজার একটু পরেই সিলেটের আকাশে ঘুরতে থাকলো মরদেহবাহী হেলিকপ্টার। সাড়ে ১০টায় সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে হেলিকপ্টারটি। সেখানে আগে থেকে অবস্থান করছিলেন সিলেটের সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান ও সাবেক এমপি শফিকুর রহমান চৌধুরী, মহানগর সম্পাদক আসাদউদ্দিন আহমদ, উপজেলা চেয়ারম্যান আশফাক আহমদ।
তারা হেলিকপ্টার থেকে কফিন নামিয়ে নিয়ে তুলেন লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সে। পরে বিশাল মোটর শোভাযাত্রা সহকারে সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নিয়ে আসা হয় সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মরদেহ। রাখা হয় শোকের মঞ্চে। বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত মরদেহে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন সিলেটবাসী। জাতিসংঘ মিশনের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি ড.একে আবদুল মোমেন, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, এডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, কেন্দ্রীয় সদস্য ও মহানগর সভাপতি বদরউদ্দিন আহমদ কামরান, সিলেট জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এডভোকেট লুৎফুর রহমান, সাবেক এমপি ও সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী, মহানগর সভাপতি আসাদউদ্দিন আহমদ সহ নেতাকর্মীরা বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের লাশবাহী কফিনে ফুলেল শ্রদ্ধা জানান।
এরপর একে একে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক, পেশাজীবী সংগঠনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এ সময় জাতিসংঘ মিশনের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি ড. একে আবদুল মোমেন বলেন- সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তার কর্ম ও অবদানের জন্য বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ, বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে চিরঞ্জীব হয়ে থাকবেন। আবেগ আপ্লুত ছিলেন সিলেটের সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরানও। তিনি বলেন- একজন যোগ্য অভিভাবককে হারিয়ে ফেললাম। তার উপদেশ, তার নির্দেশ আমাদের রাজনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে। আজ গোটা জাতি তার এক সূর্য সন্তানকে হারিয়ে শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েছে।
সিলেটের সাময়িক বরখাস্ত হওয়া মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছিলেন শহীদ মিনারে। তিনিও ছিলেন শোকাহত। বললেন- একজন অভিভাবক ছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তার মৃত্যুতে গোটা সিলেটবাসী শোকাহত। তার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন এদেশের রাজনীতি ও সমৃদ্ধিকে প্রসারিত করেছে। ব্যারিস্টার আরশ আলী, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আনম শফিক, মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাউদ্দিন আহমদও ছিলেন শোকাহত। উপস্থিত ছিলেন সিলেট পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান আফম কামাল।
এদিকে- সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যখন সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কফিনে শেষ শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছিল তখন শহীদ মিনারে পাশে থাকা আরেকটি মঞ্চে গিয়ে বক্তব্য রাখেন, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন ও অ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ। দুপুর ১২টায় সিলেটের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মরদেহে লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সযোগে নিয়ে যাওয়া হয় ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। সেখান থেকে হেলিকপ্টারে করে লাশ নিয়ে যাওয়া হয় সুনামগঞ্জে।
বেলা ১টার দিকে সিলেট থেকে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মরদেহ সুনামগঞ্জে নিয়ে আসা হয়। জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সম্মুখে স্থাপিত মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধে তার প্রতি ফুলেল শুভেচ্ছা জানান বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার হাজারো মানুষ। নির্ধারিত সময়ের দুই ঘণ্টা পরে সুরঞ্জিত সেনের লাশ সুনামগঞ্জে এলেও তার জন্য হাজারো মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। মানুষের ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতে হয় আইনশৃঙ্ক্ষলা বাহিনীকে। শ্রদ্ধা নিবেদনের শুরুতে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সুরঞ্জিত সেনকে পুলিশের একটি দল গার্ড অব অনার প্রদান করে। পরে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ, অর্থ প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, হুইপ সাহাব উদ্দিন, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মতিউর রহমান, সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নূরুল হুদা মুকুট, পৌর মেয়র আয়ুব বখত জগলুল। সুনামগঞ্জ থেকে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় তার নির্বাচনী এলাকা শাল্লা উপজেলায়। সেখানে প্রিয় নেতাকে শ্রদ্ধা জানান হাজারো শোকার্ত ভক্ত-অনুসারী। শাল্লা থেকে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় ‘জন্মভিটা’ দিরাইয়ে। যেখান থেকে একদিন উঠে এসেছিলেন রাজনীতির এই বরপুত্র।
অর্থমন্ত্রীর শোক: বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এমপি’র মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এমপি। এক শোকবার্তায় অর্থমন্ত্রী বলেন, সুরঞ্জিত আপাদমস্তক একজন বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ ছিলেন। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে এই পর্যন্ত প্রত্যেকটি পার্লামেন্টে তিনি নির্বাচিত সংসদ সদস্য হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ, অতঃপর একাধারে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এককথায়, আজীবনই দেশপ্রেমকে বুকে লালন করে এদেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন যৌবনকে উৎসর্গ করে জাতীয় নেতার আসনে নিজেকে অধিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে জাতীয় সংসদের প্রাণশক্তি উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, তার মৃত্যুতে বাংলাদেশ একজন স্পষ্টবাদি, বিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান, আওয়ামী লীগ একজন ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতা এবং বৃহত্তর সিলেটবাসী একজন প্রিয় নেতা ও রাজনীতির প্রবাদ পুরুষকে হারালো। সুরঞ্জিত সেনের মৃত্যুর শূন্যতা সহজে পূরণ হবার মতো নয়।
ড. এ কে মোমেনের শোক : জাতিসংঘ বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের সাবেক প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত, প্রফেসর ইমেরিটাস, বিশিষ্ট অর্থ ও কূটনীতিবিদ ড. এ কে আবদুল মোমেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ, জাতীয় নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। এক শোক বার্তায় তিনি বলেন, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে থেকেই অর্থাৎ, ছাত্র জীবন থেকেই আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা। দীর্ঘ পথচলায় সুরঞ্জিত সেনকে একজন তুখোড় রাজনীতিবিদ, একজন ভালো মানুষ, একজন স্পষ্টবাদী, যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞ পার্লামেন্টেরিয়ান হিসেবে দেখেছি। তার চিন্তা চেতনায় সকল সময়ই ছিল দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণ করা। সুরঞ্জিত সেন আজীবনই একজন সংগ্রামী নেতা ছিলেন।
ড. মোমেন সুরঞ্জিত সেনের তিরোধানে গভীর শোক প্রকাশ করে বলেন, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তার কর্ম ও অবদানের জন্য বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ, বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে চিরঞ্জীব হয়ে থাকবেন। তিনি মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে তার বিদেহী আত্মার শান্তি ও কল্যাণ কামনা করে শোকসন্তপ্ত পরিবার পরিজনসহ সকলের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানান। এমজমিন
০৭ ফেব্রুয়ারি,২০১৭/এমটিনিউজ২৪/এসবি