রবিবার, ১৮ অক্টোবর, ২০১৫, ১২:২২:৪৬

নয়া কৌশল নিয়ে ভাবছে বিএনপি

নয়া কৌশল নিয়ে ভাবছে বিএনপি

কাফি কামাল : কৌশল নিয়ে ভাবছে বিএনপি। দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচনের সরকারি সিদ্ধান্ত নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে বিএনপির অভ্যন্তরে। তৃণমূল পর্যায়ের নির্বাচনকে দলীয় রূপ দেয়া ও ডিসেম্বর থেকে মার্চ সময়সীমার মধ্যে নির্বাচন আয়োজনে সরকারের এ সিদ্ধান্তের উদ্দেশ্য বোঝার চেষ্টা করছে দলটির নেতারা। যদিও প্রাথমিকভাবে দলের তরফে সরকারের এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ ও তা বাতিলের দাবি জানানো হয়েছে। দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনে সরকারি সিদ্ধান্তের পর এটাকে ‘মহাদুরভিসন্ধিমূলক’, ‘একদলীয় ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করার উপায়’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে বিএনপিসহ ২০ দল। তবে সরকারের তরফে সিদ্ধান্তটি আসার পর নিজেদের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক আলাপ-আলোচনা শুরু করছেন বিএনপির কেন্দ্রীয়, জেলা পর্যায়ের নেতা ও ২০দলীয় জোটের শুভাকাঙ্ক্ষীরা। এতে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পক্ষে-বিপক্ষে উঠে আসছে নানা মতামত ও যুক্তিতর্ক। নির্বাচনমুখী দল হিসেবে প্রতিপক্ষকে খালি মাঠে গোল দেয়ার সুযোগ দিতে নারাজ নেতাকর্মীদের একাংশ। আবার দলীয় প্রতীকে বর্তমান সরকারের অধীনে স্থানীয় নির্বাচনের নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরছেন অন্য অংশ। তবে সবাই বর্তমান পরিস্থিতি ও বিগত জাতীয় নির্বাচনকেই ধরছেন তাদের যুক্তিতর্কের উৎস হিসেবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে চেয়ারপারসন ও নীতিনির্ধারণী ফোরামের সহায়ক ভূমিকা পালনে নেতারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছেন। সেখানে সরকারের কৌশলের পাল্টা কৌশল নিয়েও কথাবার্তা হচ্ছে। নেতারা জানান, বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে সরকারের তরফে সিদ্ধান্তটি আসার পর থেকে বিভিন্ন ফোরামে নিজেদের মধ্যে আলাপ চলছে। তবে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও জাতীয় নীতিনির্ধারক ফোরামের। চিকিৎসা শেষে চেয়ারপারসন দেশে ফেরার পর সিদ্ধান্ত নেবে বিএনপি। বিএনপি নেতারা মনে করছেন, তিনটি কারণে সরকার দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণগুলো হচ্ছে- আগাম জাতীয় নির্বাচনের দাবিকে ধামাচাপা দেয়া ও এরপক্ষে গড়ে ওঠা জনমত নষ্ট করা, তৃণমূলে বিএনপির সাংগঠনিক শক্তিকে তছনছ ও আন্দোলন দমনে তৃণমূলেও দলীয় নিয়ন্ত্রণ পাকাপোক্ত করা এবং নানা অপকৌশলের মাধ্যমে ফলাফল পক্ষে নিয়ে দেশে-বিদেশে সরকারের জনপ্রিয়তার প্রমাণের চেষ্টা এবং কূটনৈতিক চাপ সহনীয় করে তোলা। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, জাতীয় নির্বাচনের দাবিকে পাশ কাটানো, ৫ই জানুয়ারি পূর্তির প্রতিবাদে কর্মসূচি ঠেকানো এবং গ্রামগঞ্জে সাধারণ মানুষের সৌহার্দ্যপূর্ণ অবস্থানকে বিভক্ত করে অপরাজনীতির বীজ ছড়িয়ে দেয়াই সরকারের এ সিদ্ধান্তের নেপথ্যে কৌশল। প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে বিএনপিকেও পাল্টা কৌশল নিতে হবে। বিএনপি চেয়ারপারসন দেশে ফেরার পর সিদ্ধান্ত হবে। নির্ধারণ হবে পাল্টা কৌশল। এদিকে বিএনপির নির্বাচনপন্থি অংশের নেতারা বলছেন, বিগত দু’দফা ব্যর্থ আন্দোলনের পর তৃণমূলে স্থবিরতা নেমে এসেছে। মামলা-হামলায় জর্জরিত অনেক নেতাকর্মী এখনও আত্মগোপনে। সেক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে দলের সাংগঠনিক গতিশীলতা ফিরবে। তৃণমূল পুনর্গঠনেও গতি আসবে। নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেতে তৃণমূল নেতাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা সৃষ্টির পাশাপাশি সম্ভাব্য প্রার্থীরা তাদের সমর্থন নিশ্চিত করতে নিষ্ক্রিয় নেতাকর্মীদের সক্রিয় করার উদ্যোগ নেবেন। নেতারা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনে দলের প্রভাব জোরালো থাকলেও স্থানীয় নির্বাচনে তৃণমূল নেতাদের অংশগ্রহণ হয় সর্বাধিক। সরকারের সিদ্ধান্তের পর ইতিমধ্যে অনেকেই নির্বাচন করবেন বলে প্রস্তুতিও নিতে শুরু করেছেন। দল দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হলে মামলা-হামলায় অতিষ্ঠ ও ন্যূব্জ তৃণমূল নেতাকর্মীরা ঠিকে থাকার স্বার্থে দলের সিদ্ধান্ত পাশ কাটিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে। সেটা দলের সাংগঠনিক ভিত্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। দলের নীতিনির্ধারক ফোরামকে এটা বিবেচনায় নিতে হবে যে, ৯ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে বিএনপি। কর্মী-সমর্থকরা দীর্ঘ এ সময় ধরেই বিপর্যয়ের মধ্যদিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। তাদের আর ধৈর্যের পরীক্ষা নেয়া উচিত হবে না। এছাড়া গণতান্ত্রিক পদ্ধতির রাজনীতিতে সময়ের তাগিদ বুঝতে হয়। সময়ের প্রয়োজন অনুধাবনে ব্যর্থ হলে দীর্ঘমেয়াদি খেসারত দিতে হয়। এছাড়া নানা বিরোধিতা সত্ত্বেও অতীতে সবক’টি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিয়েছে বিএনপি। সর্বশেষ ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থী দিয়েছে বিএনপি। এক্ষেত্রে বিএনপি সরকারি নির্বাচনে অংশ না নিলেও নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকতে পারে। দলের পদ-পদবীধারী নেতা ছাড়াও স্থানীয় পর্যায়ে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের সমর্থন দিতে পারে বিএনপি। নির্বাচনপন্থি নেতারা বলছেন, উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোর অনেকেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় প্রতীকেই করে। তবে এটা সত্য যে- নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও সরকারের আচরণের দিক থেকে উন্নত দেশ ও বাংলাদেশের চিত্র বিপরীতমুখী। বর্তমান সরকারের অধীনে যে কোন নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবুও প্রার্থী নির্বাচনে দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে পারলে এবং ঐক্যবদ্ধভাবে জোরালো প্রচেষ্টা চালালে বিএনপির প্রার্থীদের ব্যাপক জয় সরকার ঠেকাতে পারবে না। সেটা করতে সক্ষম হলে সরকারের জনপ্রিয়তা যে তলানিতে অবস্থান করছে সেটা আবারও প্রমাণিত হবে। অপরদিকে সরকার কারচুপি করলে আবারও প্রমাণ হবে, এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। এতে সরকারের ওপর নানামুখী চাপ বাড়বে। নেতাদের কেউ কেউ বলছেন, দলীয়ভাবে নির্বাচন হলে ২০ দলীয় জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামী অংশ নিতে পারবে না। বিষয়টিকে বিএনপির জন্য ইতিবাচক হতে পারে। বিগত উপজেলাসহ অন্যান্য স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ে যে বেগ পেতে হয়েছিল এক্ষেত্রে সেটা হবে না। নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ না থাকায় জামায়াত নেতাকর্মীরা বিএনপির প্রার্থীর পক্ষে কাজ করবে। নির্বাচনপন্থি নেতা বলছেন, ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ না করায় সরকারের পাশাপাশি ক্ষতি হয়েছে বিএনপিরও। রাজনৈতিক স্বার্থে বিরোধিতা করলেও এ ক্ষতিকে অস্বীকার করতে পারছে না দলের নীতিনির্ধারক মহল। কারণ নির্বাচনমুখী দল হিসেবে বিএনপিকে সবাই সব ধরনের পরিস্থিতিতে নির্বাচনে চায়। এর ব্যত্যয় দলের অভ্যন্তরে যে ক্ষতির কারণ হয় ঠিক তেমনি ক্ষতির কারণ হয় আন্তর্জাতিক মহলে। বিএনপিকে বিবেচনায় রাখতে হবে বর্জনের মাধ্যমে নয়, অংশগ্রহণের মাধ্যমেও ক্ষমতাসীনদের প্রতিবাদ করা যায়। দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পক্ষের নেতারা যুক্তি দেখিয়ে বলছেন, এই স্থানীয় নির্বাচনে সরকার খুব কমই প্রভাব বিস্তার করতে পারবে। কারণ এই ধরনের নির্বাচনে এলাকায় ব্যক্তিগত প্রভাব থাকায় কারচুপির বিষয়টি কঠিন হবে। তবে নির্বাচনে অংশ নিলে জয়-পরাজয় যাই থাকুক না কেন তা দলের জন্য ইতিবাচক হবে বলেও ধারণা তাদের। অন্যদিকে দলীয় সরকারের অধীনে এবং দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের বিরোধী বিএনপি নেতারা বলছেন, সর্বস্তরে সরকারি দলের নিয়ন্ত্রণ সুসংহত করার উদ্দেশ্যেই দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচনের সিদ্ধান্তটি এসেছে। এখানে পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের জন্য যে সময়টি বেছে নেয়া হয়েছে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ এবং উদ্দেশ্যমূলক। বিএনপি ইতিমধ্যে দল পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। নানামুখী প্রতিকূলতার মধ্যেও প্রক্রিয়াটি একটি পরিণতির দিতে যাচ্ছে। এতে ডিসেম্বর নাগাদ দল গুছিয়ে আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে বিএনপি। বিশেষ করে ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের দ্বিতীয় বছর পূর্তিকে ঘিরে যাতে বিএনপি কোন কর্মসূচি দিয়ে মাঠে নামতে না পারে, সেজন্য বিরোধী জোটকে নির্বাচনের ব্যস্ত রাখতে চায় সরকার। পাশাপাশি মামলা-হামলায় জর্জরিত বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্র্মীদের এলাকা ছাড়া করতে সহায়ক হবে এ নির্বাচন। নেতারা বলছেন, সরকারের দমন-নিপীড়নের কৌশলে বিএনপির হাজার-হাজার নেতাকর্মী ঘরছাড়া ও কারারুদ্ধ। সরকার বিরোধী রাজনীতিকে ন্যূনতম গণতান্ত্রিক সুযোগ দেয়া হচ্ছে না। এমনি এক প্রেক্ষাপটে বিরোধী দলের পক্ষে সমান সুযোগ নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়া দুরূহ। সরকার সেই সুযোগটিকেই কাজে লাগিয়ে রাজনীতির এক অসমান্তরাল ময়দানে ফাঁকা মাঠে গোল করার হীন প্রচেষ্টা নিয়ে এগুচ্ছে। এটা একটি অসৎ পরিকল্পনা ছাড়া অন্য কোন কিছুই নয়। তারা বলছেন, সর্বমহল থেকে জাতীয় নির্বাচনের চাপ রয়েছে, এটি গণদাবি। অথচ সরকার সেই দাবি উপেক্ষা করে কম গুরুত্বপূর্ণ স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ছে। এটি জাতীয় দাবিকে আড়াল করার সরকারের অপকৌশল মাত্র। সরকার মেরে-কেটে তথাকথিত সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করবে। যা ২০১৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার যুক্তি হিসেবে উপস্থাপন করবে দেশে-বিদেশে। ওদিকে সরকার স্থানীয় সরকার নির্বাচন সংক্রান্ত যে পাঁচটি আইন অনুমোদন করেছে- তা সাংঘর্ষিক। জাতীয় সংসদের ক্ষেত্রে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে বা শপথ নেয়ার আগপর্যন্ত এমপিরা পদে বহাল থাকতে পারলেও মেয়াদোত্তীর্ণ হলে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে প্রশাসক নিয়োগের বিধান রাখা হয়েছে। বিএনপির একাংশের নেতারা বলছেন, এতে স্থানীয় সরকারে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি থাকার ধারাবাহিকতাও ক্ষুণ্ন হবে। দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচন হলে সরকারের হস্তক্ষেপ আরও বেড়ে যাবে। বিগত সময়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো বিভিন্ন মার্কায় হয়েছে, দলীয় প্রতীকের ভিত্তিতে হয়নি। তারপরও ওইসব নির্বাচনে বিএনপি ও বিরোধী দলের অনেক নেতা বিজয়ী হয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, যেসব প্রার্থী মেয়র-কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন স্থানীয় সরকারের আইনের মাধ্যমে তাদের বেশির ভাগ নির্বাচিত মেয়র ও চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানদের অপসারিত ও বরখাস্ত করা হয়েছে। এ অবস্থায় দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হলে বিএনপি থেকে কেউ নির্বাচিত হলে তাদের বের করে দেয়া সহজ হবে। এ অংশের নেতারা আরও বলছেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তারা বিগত সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে নিরপেক্ষতার ন্যূনতম প্রমাণ রাখতে পারেনি। ফলে নির্বাচনে অংশ গ্রহণের পক্ষে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিলে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবি তুলতে হবে। এছাড়া ফলে নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে আলোচনা করতে করতে হবে। তবে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচনকে সরকারের ফাঁদ হিসেবে আখ্যায়িত করে সতর্কতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেয়ার পক্ষে সবাই।-এমজমিন ১৮ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে