রবিবার, ১৮ অক্টোবর, ২০১৫, ০২:১৬:৪৬

তাবেলা হত্যায় ফাঁসছে বিএনপি!

তাবেলা হত্যায় ফাঁসছে বিএনপি!

সাখাওয়াত হোসেন : ইতালির নাগরিক তাবেলা সিজার হত্যা মিশনে সরাসরি অংশ নেয়া তিন খুনি এখন গোয়েন্দা হেফাজতে। তাদের দেয়া তথ্য পর্যালোচনা করে এ হত্যাকাণ্ডের মদদদাতা হিসেবে এক বিএনপি নেতাকে চিহ্নিত করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন গোয়েন্দারা। পাশাপাশি খুনের মোটিভও এখন পরিষ্কার বলে তারা জানান। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে এসব বিষয় উল্লেখ করে আদালতে চার্জশিট দেয়া হবে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ডিবির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দাবি করেন, তাবেলা হত্যাকাণ্ড পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তে হত্যা মিশনের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে রাজধানীর গুলশান-বাড্ডা এলাকার বিএনপির মধ্য সারির একজন প্রভাবশালী নেতার নাম বেরিয়ে এসেছে। তিনি বিদেশে আত্মগোপনে থাকলেও সেখানে বসেই গোটা মিশনের কলকাঠি নেড়েছেন। নিরাপত্তার আস্থা সংকটে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট টিম বাংলাদেশ সফর স্থগিত করার সুযোগে দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতেই বিদেশি খুনের এ ছক কষা হয়েছে বলেও গোয়েন্দাদের দাবি। এ ঘটনার সঙ্গে বিএনপির প্রথম সারির আরো বেশ কজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার জড়িত থাকার সন্দেহও ঘনীভূত হচ্ছে বলে জানান ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা। তবে তদন্তের স্বার্থে হত্যা মিশনের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে চিহ্নিত ওই বিএনপি নেতার নাম তিনি বলতে চাননি। তবে তদন্তে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, ঢাকা মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক এম এ কাইয়ুম ওরফে কাইয়ুম কমিশনার (ঢাকা সিটি করপোরেশন ২১ নাম্বার ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার) তাবেলা হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা বলে গোয়েন্দাদের দাবি। তাদের বক্তব্য তার নীলনকশা অনুযায়ীই তিন ভাড়াটে খুনি এ খুনের ঘটনা ঘটায়। বিদেশে বসেই তিনি বিভিন্ন চ্যানেলে খুনিদের অর্ধ কোটি টাকা পরিশোধ করেন। আর দেশে যারা খুনিদের নানাভাবে সহায়তা করেছেন তাদের মধ্যে বিএনপির প্রথম সারি এবং মাঠপর্যায়ের ৫ জন নেতা রয়েছেন। এদের একজনকে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা গেলেও বাকি চারজনের গতিবিধি নজরদারিতে রেখে তাদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে। এছাড়াও হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ক্ষুদ্র আগ্নেয়াস্ত্রটি উদ্ধারে গোয়েন্দারা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে। ওই কর্মকর্তা বলেন, তাবেলার খুনি এবং হত্যার নির্দেশদাতাদের বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত হওয়ার জন্য সব ধরনের তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করা হচ্ছে। অস্ত্রটি উদ্ধার করা গেলে তার ব্যালেস্টিক পরীক্ষা সম্পন্ন হবে। ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া গুলির খোসার সঙ্গে তা মিলিয়ে দেখা হবে। সব তথ্যপ্রমাণ হাতে পাওয়ার পর পুরো বিষয়টি মিডিয়ার সামনে আনা হবে। তদন্ত কমিটির প্রধান গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উপকমিশনার (ডিসি-পূর্ব) মাহাবুব আলম বলেন, তাবেলা হত্যাকাণ্ডের তদন্ত অনেক দূর এগিয়েছে। তিন খুনিকে গোয়েন্দা হেফাজতে নেয়া হয়েছে। তাদের সূত্র ধরেই মূল পরিকল্পনাকারীর মুখোশ উন্মোচন করা হবে। এদিকে তিন খুনিকে গোয়েন্দা হেফাজতে নেয়ার বিষয়টি ডিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা স্বীকার করলেও তাদের নাম-পরিচয় জানাতে চাননি। এমনকি তাদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে কিনা তা-ও কেউ পরিষ্কার করেননি। তবে নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রে জানা গেছে, তিন খুনিকে আটক করে নিরাপত্তা হেফাজতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তাদের দেয়া প্রতিটি তথ্য পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করে তদন্ত এগুচ্ছে। এর 'সাম-আপ' অনুযায়ী হত্যাকাণ্ডের মোটিভ এবং মূল পরিকল্পনাকারী ও অর্থদাতাকে শনাক্ত করা হচ্ছে। তবে কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাকে আদালতে হাজির করার আইন থাকায় তাদের আড়ালে রাখা হয়েছে। রাজধানীর উত্তরাংশের একটি গোয়েন্দা 'সেফ হোমে' তিন খুনিকে কখনো পৃথকভাবে আবার কখনো সামনাসামনি দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বলে সূত্রটি দাবি করেছে। যদিও তিন খুনি আটকের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সূত্রটি কোনো অকাট্য প্রমাণ দিতে পারেনি। এদিকে তাবেলা সিজার হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে বিএনপির মধ্য সারির একজন প্রভাবশালী নেতাকে ফাঁসানোর বিষয়টি পূর্বপরিকল্পিত বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপি শীর্ষ নেতারা। তাদের ভাষ্য, রাজধানীর গুলশানে ইতালির নাগরিক এবং রংপুরে জাপানি নাগরিক খুনের পর থেকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ হত্যাকাণ্ডের জন্য লন্ডনে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার যোগসাজশের ইঙ্গিত করে আসছেন। একই সঙ্গে তার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ও দাবি করেছেন দুই বিদেশি নাগরিক খুনে বিএনপি-জামায়াতের অবশ্যই মদদ রয়েছে। লন্ডন বিএনপির ভেতর থেকেই একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র তাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। তাদের এসব বক্তব্য তদন্তকে প্রভাবিত করেছে বলে অভিযোগ তোলেন বিএনপি নেতারা। তারা বলেন, দুই বিদেশি খুনে বিএনপি নেতাদের ফাঁসানোর জন্য গোয়েন্দারা এখন উঠেপড়ে লেগেছেন। আর সরকার তাতে ইন্ধন দিচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, সাবেক সেনাপ্রধান মাহবুবুর রহমান শনিবার সন্ধ্যায় প্রতিবেদককে বলেন, তদন্ত হওয়ার আগেই সরকারি মহল থেকে নানামুখী বক্তব্য এসেছে। অমুকে হত্যা করেছে, অমুক দল দায়ী ইত্যাদি বলে ঢালাও অভিযোগ করা হচ্ছে। এতে তদন্ত প্রভাবান্বিত হচ্ছে। এ ধরনের 'বেস্নইম গেম'-এ কোনো লাভ হবে না দাবি করে তিনি বলেন, এতে প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যাবে। যা আগামীতে দেশের জন্য ভয়ঙ্কর হয়ে দাঁড়াবে। এটি জাতীয় সমস্যা এবং তা মোকাবেলার জন্য জাতীয় ঐক্য প্রয়োজন। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পর্যবেক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও দুই বিদেশি নাগরিক খুনের তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই সরকারপ্রধানসহ নীতিনির্ধারক পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গের এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের খড়গ তোলার পরিণতি সুখকর হবে না বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তাদের ভাষ্য, জজমিয়া নাটকের পুনরাবৃত্তি হলে বিদেশিরা বিষয়টি ভালোভাবে নেবে না। এমনিতেই দুই বিদেশি খুনের পর দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অর্থনৈতিক বিভিন্ন বিষয়ে মন্দা দেখা দিয়েছে। এর ওপর কোনো 'পাতানো' তদন্ত করে প্রকৃত অপরাধীদের রেহাই দিয়ে একে রাজনৈতিক খেলায় পরিণত করা হলে এবং তা পরবর্তীতে ফাঁস হলে দেশের জন্য ভয়ঙ্কর ক্ষতির বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। এদিকে তাবেলা খুনের পরিকল্পনাকারী হিসেবে যে বিএনপি নেতাকে ফাঁসানো হচ্ছে বলে শোনা গেছে সেই আলোচিত নেতা কাইয়ুম কমিশনারের সঙ্গে শনিবার বিকালে এ প্রতিবেদকের ভাইবারে দুদফায় কথা হয়েছে। তিনি গোটা ঘটনাকে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র দাবি করে এই প্রতিবেদককে বলেন, 'আমি তো সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর থেকে ছয় মাস ধরে দেশের বাইরে আছি। আমি কি বিদেশ থেকে কিলার পাঠিয়েছি।' ইতালির নাগরিক তাবেলা গুলশানে নাকি বনানীতে খুন হয়েছেন তা-ও জানেন না দাবি করে কাইয়ুম কমিশনার বলেন, 'এগুলো রাজনীতির নোংরা খেলা। আমি এর মধ্যে নেই। এসব একেবারেই ফালতু অভিযোগ।' বিদেশ থেকে ভিন্ন চ্যানেলে খুনিদের টাকা পাঠানোর অভিযোগ প্রসঙ্গে কাইয়ুম বলেন, 'আমি এত পাগল হয়ে যাইনি যে কিলারদের কাছে টাকা পাঠাব। এসব নোংরামির মধ্যে আগেও কখনো ছিলাম না, এখনো নেই।' এদিকে দুই বিদেশি খুনের ঘটনায় বিএনপিকে জড়ানোর ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে শনিবার বিএনপির মুখপাত্র ড. আসাদুজ্জামান রিপন এক বিবৃতি দিয়েছেন। বিএনপির সহ-দপ্তর সম্পাদক মো. আব্দুল লতিফ জনি স্বাক্ষরিত ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে 'সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার প্রতি ইঙ্গিত করে 'বিদেশে বসে ষড়যন্ত্রের' অভিযোগ বারবার করার মধ্যদিয়ে বিএনপি আশঙ্কা করছে দুজন বিদেশি খুনের সঙ্গে বিরোধী দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার একটি অসৎ দুরভিসন্ধি রয়েছে। জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সভাপতি হাবিব-উন-নবী খান সোহেলের ছোট ভাই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি রাশেদুন নবী বিপ্লবকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়েই দল আশঙ্কা করেছিল হাবিব-উন-নবী খান সোহেলকেও হয়তো হয়রানি করা হতে পারে। দেশে দুজন বিদেশির মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের কুলকিনারা হওয়ার দাবি বিএনপি করে আসছে উল্লেখ করে আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, এর রহস্য-বৃত্তান্ত ন্যায়ানুগ তদন্ত হওয়া উচিত এবং এ ধরনের জঘন্য পৈশাচিক ঘটনায় যারা জড়িত তাদেরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি জরুরি। তবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানি করার অসৎ টার্গেটে যেন তদন্ত পরিচালিত না হয়। দেশে দুজন বিদেশি হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে যে ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার প্রতিকার জরুরি বলে দাবি করেন তিনি। কিন্তু প্রকৃত দোষীদের আইনের আওতায় না এনে যদি কোনো 'কল্পকাহিনী' প্রচার করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে আঘাত করার কৌশল হিসেবে বিদেশি খুনে কোনো কানেকশনের আজগুবি তথ্য দেয়া হয় তা হবে দুঃখজনক এবং সত্য উদঘাটনের পরিবর্তে সত্যকে ধামাচাপা দেয়ার শামিল বলে মন্তব্য করেন আসাদুজ্জামান রিপন।-যায়যায়দিন ১৮ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে