রবিবার, ১৮ অক্টোবর, ২০১৫, ০২:৪৪:২৯

যে চারটি চ্যালেঞ্জের মুখে সরকার

যে চারটি চ্যালেঞ্জের মুখে সরকার

জুলকার নাইন : টানা দ্বিতীয় মেয়াদের দুই বছরের কাছাকাছি এসে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকে প্রধান চারটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। প্রথম চ্যালেঞ্জ দেশের অভ্যন্তরে আইনের শাসন নিশ্চিত করা, দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ বহির্বিশ্বে ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার, তৃতীয় চ্যালেঞ্জ দলের শৃঙ্খলা রক্ষা বা মন্ত্রী-এমপি ও তাদের আত্মীয়স্বজনদের লাগাম টেনে রাখা এবং চতুর্থ চ্যালেঞ্জ হলো উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিকভাবে শক্ত অবস্থানে থাকলেও সাম্প্রতিক কয়েকটি ইস্যু সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। যদিও তাৎক্ষণিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সফলতার পরিচয় দিয়েছে সরকার। বিশিষ্ট নাগরিকদের অভিমত : ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি নিয়ন্ত্রণে নিতে হবে কার্যকর ভূমিকা। না হলে জনবিস্ফোরণ ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না কোনোমতেই। জানা যায়, সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সবার আগে প্রয়োজন আইনের শাসন। সমাজের শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে আইনের শাসনের বিকল্প নেই। কিন্তু দেশে আইনের শাসনের পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে। দায়িত্বশীল পুলিশ ও প্রশাসনের কাছে জনসাধারণের বঞ্চনার খবর হরহামেশাই উঠে আসছে। দোষী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না। আবার অনেক নির্দোষ ব্যক্তিকে আটকের নামে বাণিজ্য চালানো হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের লেবাস গায়ে থাকলে দোষ করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন অনেকে। আবার অর্থ ও ক্ষমতা অনেক ক্ষেত্রেই আইনের লঙ্ঘন ঘটাচ্ছে। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নামে দেশের বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাস ও খুনোখুনি করছে সুযোগসন্ধানী দুর্বৃত্তরা। আবার স্বাভাবিক উপায়ে হচ্ছে না পুলিশ ও প্রশাসনের বদলি-পদায়নও। সাধারণ নিয়মের যোগ্য হতেও তাদের অনৈতিক উপায়ের আশ্রয় নিতে হচ্ছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেছেন, বর্তমানে বাংলাদেশে বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি বাসা বেঁধেছে। অর্থ, পেশিশক্তি এবং রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে আইনের শাসনের অবনতি হয়েছে। বৈষম্য বাড়ার কারণে মানুষের মানবিক মূল্যবোধ কমে যাচ্ছে, ফলে মানুষ অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। রাজনৈতিক দলের আশ্রয়ে থাকলে তাকে আর আইন স্পর্শ করতে পারে না। এই বিচারহীনতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এখন মেধার চেয়ে আনুগত্য প্রাধান্য পাচ্ছে। রাজনীতিবিদরা এ পরিস্থিতির দায় এড়িয়ে যেতে পারেন না। তিনি বলেন, যখনই একটি রাষ্ট্রে বা সমাজে আইনের শাসনের অবনতি ঘটে, তখনই শাসন দুর্বল বা ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। যেখানে বিচারহীনতার সংস্কৃতি বাসা বাঁধে, সেখানেই কিন্তু এমন অমানবিক ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পায়। তারই একটি উদাহরণ আমরা বর্তমানে পর্যবেক্ষণ করছি। এ অবস্থায় মূল্যবোধের অবক্ষয় ঠেকিয়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা জরুরি বলে জানান মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান। দ্বিতীয়ত. মাত্র পাঁচ দিনের ব্যবধানে ঢাকায় ইতালির নাগরিক সিজার তাভেলা ও রংপুরে জাপানের নাগরিক হোশি কোনিও হত্যাকাণ্ড, পরপর বিভিন্ন দেশের বাংলাদেশে ভ্রমণ সতর্কতা এবং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসের কথিত বিদেশি নাগরিক হত্যার দায়স্বীকারের ঘটনা বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। যার কিছু সাময়িক প্রভাব ইতিমধ্যেই পড়েছে বাংলাদেশের রপ্তানি বাজার ও পর্যটনশিল্পে। এই ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার সরকারের জন্য আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. আমেনা মহসিন বলেছেন, অবশ্যই এ ধরনের ঘটনা দেশের ভাবমূর্তির জন্য নেতিবাচক। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের অস্থিতিশীল পরিবেশের বার্তাই বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। আমি মনে করি না এই অপরাধ দেশের বাইরে থেকে আসা কোনো জঙ্গি গোষ্ঠী ঘটাচ্ছে। বরং দেশের মধ্যে থাকা গোষ্ঠীগুলো যারা ব্লগার হত্যার মতো অপরাধ করছে তাদেরই কোনো অংশ এসব কাজে লিপ্ত থাকতে পারে। তাই দোষারোপের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে দায়িত্বশীল অবস্থান নেওয়ার সময় এসেছে। খুন হলেই বিএনপি-জামায়াত করেছে বলে দোষ চাপিয়ে সত্যিকার দোষীদের আড়াল হতে দেওয়ার আর কোনো সুযোগ নেই। সুশাসনের এ বিষয়ে সরকারকে সত্যিকার জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে। সেই সঙ্গে দেশের ভাবমূর্তির ইস্যু সামনে আসায় পররাষ্ট্র দফতরের মাধ্যমে সরকারের শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। আওয়ামী লীগের সামনে আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে দলের শৃঙ্খলা রক্ষা করা। কারণ দলের আইন প্রণেতারা একের পর এক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছেন। একজন এমপি রাতভর মাতাল হয়ে ঘুরে বেরিয়ে প্রায়শই যাকে তাকে গুলি করেছেন। আরেকজন মাদক সাম্রাজ্য পরিচালনা করছেন। অন্যজন র‌্যাবের হাত থেকে আসামি ছিনিয়ে নিয়েছেন। আরেক আইনপ্রণেতা হিন্দু ধর্মালম্বীদের বিঘার পর বিঘা জমি দখল করেছেন। শুধু তাই নয়, দেশজুড়ে দলীয় পরিচয়ে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ উঠছে প্রতিদিনই। সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের মধ্যে কাউকে গ্রেফতার করা হলে তাকে থানা থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আসার ঘটনাও ঘটেছে বেশ কয়েকবার। শুধু মন্ত্রী, এমপি বা দলীয় নেতারাই নন, অনেক ক্ষেত্রে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন তাদের আত্মীয়স্বজন ও মদদপুষ্টরাও। সর্বশেষ ঢাকার এক আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক এমপির ভাতিজা মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালিয়ে দুই রিকশাচালক ও দুই আরোহীকে মারাত্মক আহত করলেও সেই ভাতিজাকে পুলিশ নিরাপত্তা দিয়ে বাসায় পৌঁছে দিয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে নেওয়া হয়নি কোনো ব্যবস্থা। আওয়ামী লীগ নেতার এই দাপট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে তুলেছে আলোড়ন। এসব ঘটনায় সমালোচনা আছে খোদ আওয়ামী লীগের ভিতরেও। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের এক সদস্য এ প্রসঙ্গে গতকাল প্রতিবেদককে বলেছেন, এসব বিব্রতকর কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার পরিবর্তে অনেক ক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষকতা করা হচ্ছে। কিন্তু দল বা দলের শীর্ষ নেতৃত্ব কখনোই এদের প্রশ্রয় দেওয়ার পক্ষে নয়। তারপরও এসব হচ্ছে। এটা আওয়ামী লীগ ও সরকারের জন্য আত্মঘাতী। যত দ্রুত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে এবং প্রয়োজনীয় দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষা করা হবে ততই ভালো। না হলে অন্যরাও এ ধরনের আইন উপেক্ষা করার মতো কর্মকাণ্ডে উৎসাহিত হবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সর্বশেষ নির্বাচন নিয়ে সমালোচনার প্রেক্ষাপটে উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়া সরকারকে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষার বিকল্প নেই। ইতিমধ্যেই ঢাকায় বেশ কিছু ফ্লাইওভার ও হাতিরঝিলের মতো দৃষ্টিনন্দন প্রকল্প বাস্তবায়ন ও পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করে উন্নয়নের ক্ষেত্রে সরকার বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেছে। এই ধারাবাহিকতা রক্ষার মাধ্যমে ইতিমধ্যেই নেওয়া অন্যান্য বড় উন্নয়ন প্রকল্প দুর্নীতি ছাড়া যথাসময়ে বাস্তবায়ন করাই হবে এখন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।-বিডিপ্রতিদিন ১৮ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে