মঙ্গলবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭, ১০:৩৮:২৮

‘ব্লগার রাজীবের মাথা আলাদা করতে ঘাড়ে কোপ দেয় দীপ’

‘ব্লগার রাজীবের মাথা আলাদা করতে ঘাড়ে কোপ দেয় দীপ’

শেখ সাবিহা আলম : ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল ২০১৫ সালে জানুয়ারির মাঝামাঝিতে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অনুসরণ করে রিদওয়ানুল আজাদ রানাই তাদের প্রথম শিকার ঠিক করেন। গঠিত হয় ‘ইন্টেল’ ও ‘এক্সিকিউশন’ নামের দুটি দল। ঘটনার দিন রাজীবের মাথা আলাদা করতে তার ঘাড়ে কোপ দেয় দীপ।

রাজীবকে খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তার সাজাপ্রাপ্ত আসামি মাকসুদুল হাসান অনিক আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এসব তথ্য দেন। হত্যাকাণ্ডের ১৭ দিন পর ২০১৩ সালের ২ মার্চ মো. মাকসুদুল হাসান অনিককে তার বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। মাকসুদুল হাসান তার দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। পাঠকদের জন্য মাকসুদুলের জবানবন্দি তুলে ধরা হলো:

‘২০১০ সালের শেষের দিকে এসে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ছাত্র নকি সেকেন্দার আলী, রিদওয়ানুল আজাদ রানা ও সাইফ কবিরের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রার্থনা কক্ষে জোহরের নামাজের আগে পরিচয় হয়। ওই পরিচয়ের সূত্র ধরে জুনন, রুম্মান, দীপ, নাফিস, সাদমান এবং ইরাদের পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয়। রানা একসময় বাংলাদেশ ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। নকি ও রানা দুজনেই ইসলামিক বিষয়ে ভালো বক্তৃতা ও ওয়াজ করত। আমাকে ইসলামিক ওয়াজ শোনাত। নকি ও রানা আমাকে জিগাতলা হাতিমবাগ মসজিদের ইমাম জসিমউদ্দিন রাহমানির খুতবা শোনার জন্য পরামর্শ দেয়।

‘এর কয়েক দিন পর আমি খুতবা শোনার জন্য হাতিমবাগ মসজিদে যাই। সাধারণ আলোচনা বাদ দিয়ে তিনি জিহাদি আলোচনা বেশি করেন। উনার খুতবা শুনে আমি অনুপ্রাণিত হই। রানা ও নকির পরামর্শে ইরাদ তাইসিয়ার রচিত ‘ড্র সোর্ড অ্যাগেইনস্ট দোজ হু ইনসাল্টস প্রফেট’ নামে বইটি পাঠ করি। এ বইটি পাঠ করে জানতে পারি যে মহানবী (সা.)-এর অবমাননাকারীকে হত্যা করা অবশ্যকর্তব্য। ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে রানা আমাকে আল্লাহ ও রাসুল সম্পর্কে বিভিন্ন ব্লগারদের অবমাননাকর লেখা বিষয়ে অবহিত করে এবং ডাউনলোড করে বিভিন্ন কপি দেয়। ২০১৩ সালের জানুয়ারির মাঝামাঝির দিকে রানা “থাবা বাবা” নামে এক ব্লগার সম্পর্কে আমাকে ধারণা দেয়। আমি ফেসবুক থেকে থাবা বাবার বিভিন্ন লেখা পড়ি।

‘এরপর রানা সবার সঙ্গে আলোচনা করে দীপকে দায়িত্ব দেয় ফেসবুক এবং ব্লগ থেকে থাবা বাবাকে হত্যার পরিকল্পনা করি। কারণ, ফেসবুক থেকে ধারণা পাই যে সে ইসলাম ও মহানবী (সা.)-এর অবমাননাকারী। রানা ভাই-ই আমাদের ব্লগার রাজীবকে হত্যা করার জন্য বিভিন্নভাবে মোটিভেট করত। রানা আমাদের বলত, “ইসলাম ও মহানবী (সা.‍)-কে অবমাননাকারী রাজীবকে হত্যা করা আমাদের ইমানি দায়িত্ব।” আমরা তাকে শনাক্ত করার জন্য ইনটেল ও এক্সিকিউশন গ্রুপ নামে দুটি গ্রুপ তৈরি করি।

‘ইন্টেলের কাজ হলো তথ্য সংগ্রহ করা এবং এক্সিকিউশনের কাজ ছিল হত্যাকাণ্ড সংঘটন করা। আমিসহ ইন্টেল সদস্যরা মিলে ১০ ফেব্রুয়ারি শাহবাগ যাই। থাবা বাবাকে খোঁজ করি। একপর্যায়ে শনাক্ত করি। আমাদের ইন্টেল গ্রুপের রুম্মান শাহবাগ থেকে রাজীবকে অনুসরণ করে সাইকেলযোগে মিরপুর-১০ পর্যন্ত গেলেও প্রথম দিন বাসা শনাক্ত করতে পারেনি। এরপর ১২ ফেব্রুয়ারি পুনরায় তাকে অনুসরণ করে রাজীবের পল্লবীর পলাশ নগরের বাসা শনাক্ত করি। এরপর আমাদের ইন্টেল গ্রুপ রাজীবের অবস্থান সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করতে থাকে। ১৪ ফেব্রুয়ারি আমরা (আমি, রানা ও রুম্মান) সকাল সাড়ে সাতটা থেকে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত রাজীবের অবস্থান নির্ণয়ের জন্য তার বাসার সামনে ক্রিকেট খেলি। একপর্যায়ে অবস্থান নিশ্চিত করি।

‘১৫ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে ইন্টেলের সদস্য (রুম্মান, সাদমান, ইরাদ, নাফিস) রাজীবের বাসার সামনে অপেক্ষমাণ থাকি। বিকেলে রানা ও আমি চাপাতি, ছোরাসহ দীপের খিলগাঁওয়ের বাসায় যাই। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে ইন্টেলের কাছ থেকে তথ্য পেয়ে আমি, রানা ও দীপ বাসে করে রওনা দিয়ে পৌনে নয়টা নাগাদ ঘটনাস্থলে পৌঁছাই। একটা চাপাতি নিজে রেখে অন্যটা দীপের হাতে দিয়ে দিই। রাত আনুমানিক ৮টা ৫০ মিনিটের দিকে ইন্টেল গ্রুপের সদস্য রুম্মান মোবাইলে রাজীবের তার বাসার দিকে আসার কথা আমাদের জানালে আমরা রাজীবকে হত্যার প্রস্তুতি নিতে থাকি।

‘রাজীব তার বাসার কাছাকাছি পৌঁছানো মাত্র দীপ চাপাতি দিয়ে রাজীবের ঘাড় থেকে মাথা আলাদা করার উদ্দেশ্যে ঘাড়ে কোপ দিলে রাজীব আহ করে পড়ে যায়। দীপ আরও দুটি কোপ দিলে রাজীব চিত হয়ে পড়ে যায়। আমি ছোরা দিয়ে রাজীবকে আঘাতের চেষ্টা করলেও লাগেনি। দীপ রাজীবকে আরও একটা কোপ দিলে তা আমার পায়ের কেডসে লাগে। এরপর দীপ চাপাতি দিয়ে রাজীবকে আরও দুটি কোপ দেয়।

‘একপর্যায়ে দূর থেকে “মানুষ খুন করছে” এমন আওয়াজ করে চিৎকার শুরু হলে আমরা যে যার মতো করে পালিয়ে যেতে থাকি। রুম্মান নাফিসের মেসে চলে যায়। পরদিন সকালে রানা ও রুম্মানের সঙ্গে আমার দেখা হয়। রানা সবাইকে দূরে কোথাও চলে যেতে বলে। কিন্তু আমি বাসাতেই ছিলাম। গত ২ মার্চ পুলিশ আমাকে গ্রেপ্তার করে। আমি আমার কাজের জন্য অনুতপ্ত।’ প্রথম আলো

২১ ফেব্রুয়ারি,২০১৭/এমটিনিউজ২৪/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে