মঙ্গলবার, ২০ অক্টোবর, ২০১৫, ০৪:৩০:৩৭

বাসভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য

বাসভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য

শরিফুল হাসান : সরকার ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগের গ্যাসচালিত বাস-মিনিবাসে প্রতি কিলোমিটারে যাত্রীপ্রতি ১০ পয়সা ভাড়া বাড়ালেও আদায় করা হচ্ছে মালিকদের ইচ্ছানুযায়ী। স্বল্প দূরত্বেই কমপক্ষে দুই টাকা ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। কোনো কোনো দূরত্বে অতিরিক্ত নেওয়া হচ্ছে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলেছে, তাদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী ৮৭ শতাংশ বাস-মিনিবাসে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। ভাড়া বেড়েছে ৬০০ শতাংশ পর্যন্ত। তবে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল সোমবার বলেছেন, ৪০ শতাংশ বাস-মিনিবাসে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। বাড়তি ভাড়া আদায় ও বাসে তালিকা না টাঙানোর কারণে গত রোববার বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত এক পরিবহনশ্রমিককে এক মাসের কারাদণ্ড দেওয়ার প্রতিবাদে প্রায় সাত ঘণ্টা মিরপুরকেন্দ্রিক বাস চলাচল বন্ধ করে দেন মালিক-শ্রমিকেরা। যাত্রীদের পোহাতে হয় চরম দুর্ভোগ। পরে মালিক-শ্রমিকনেতাদের সঙ্গে বিআরটিএ ও মন্ত্রণালয়ের বৈঠকের পর ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়। বৈঠকে যাত্রীবাহী বাস থেকে পরিবহনশ্রমিকদের গ্রেপ্তার না করার দাবি জানান মালিক-শ্রমিকেরা। এ বিষয়ে আশ্বাস পাওয়ার কথাও জানিয়েছেন মালিক সমিতির নেতা। অবশ্য গতকাল বিআরটিসিতে বৈঠক করতে গিয়ে ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেছেন, সাময়িক জনভোগান্তি হলেও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান অব্যাহত থাকবে। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে ১ অক্টোবর থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরে বাস-মিনিবাসে প্রতি কিলোমিটারে ১০ পয়সা করে ভাড়া বাড়ায় সরকার। কিন্তু এ হার মানা হচ্ছে না। ঢাকায় দূরত্বভেদে দুই থেকে পাঁচ টাকা অতিরিক্ত নেওয়া হচ্ছে। ঢাকা থেকে মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, মাওয়া যেতে ২০ টাকা পর্যন্ত ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। ঢাকায় চলাচল করা বাস-মিনিবাসের ১৩০টি কোম্পানির অধিকাংশের বিরুদ্ধেই অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। সরকারি পরিবহন সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) বাসেও অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। যেসব বাসে তালিকা আছে, তা এমনভাবে করা, যা সাধারণ যাত্রীর পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। গতকাল বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ও যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে এ চিত্র পাওয়া গেছে। যাত্রীরা বলেছেন, বাসভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য চলছে। বাসমালিক-শ্রমিকদের কাছে তাঁরা জিম্মি হয়ে পড়েছেন। যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলেছে, গত তিন সপ্তাহে ১৭০টি পথে পর্যবেক্ষণ করে তারা দেখেছে, ঢাকায় প্রায় ৮৭ শতাংশ যানবাহন যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে। ৭০ থেকে ৬০০ শতাংশ পর্যন্ত ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে মাসে নিম্ন আয়ের মানুষের বাসভাড়া ৮০০ টাকা থেকে বেড়ে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত হয়েছে। যাত্রী ও পরিবহনশ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গুলিস্তান থেকে মিরপুরগামী বিভিন্ন মিনিবাসে ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ২৪ থেকে ২৫ টাকা। আগে নেওয়া হতো ২০ টাকা। আর গুলিস্তান থেকে ফার্মগেটের ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ১০ টাকা। আগে নেওয়া হতো ৮ টাকা। অবশ্য বাড়তি ভাড়া নিতে এখন গুলিস্তান-মিরপুর পথের বাস ‘সিটিং সার্ভিস’ করা হয়েছে। মাঝপথের যাত্রী না নেওয়ায় লোকজন ভোগান্তিতে পড়েছেন। মাঝপথের কোনো যাত্রী উপায় না পেয়ে এই মিনিবাসে উঠলে শেষ গন্তব্যের ভাড়া দিতে হচ্ছে। কিছু কিছু বাস দু-এক দিন এভাবে চলার পর এখন আবার দাঁড়িয়ে যাত্রী নিলেও ভাড়া নিচ্ছে বাড়তি হারেই। মতিঝিল-মিরপুরগামী বাসে ফার্মগেটের ভাড়া ১২ টাকা ও মিরপুরের ভাড়া ২৮ টাকা নেওয়া হচ্ছে। যেকোনো বাস-মিনিবাসে গুলিস্তান, মতিঝিল, পল্টন থেকে শাহবাগে গেলেও কমপক্ষে ১০ টাকা দিতে হয়। মেঘলা পরিবহনে গুলিস্তান থেকে পান্থপথ হয়ে কলাবাগানের ভাড়া আগে ১০ টাকা নেওয়া হলেও এখন আদায় করা হচ্ছে ১৫ টাকা। এভাবে দূরত্বভেদে ২, ৪, ৫, ১০ টাকা ভাড়া বেড়েছে। গতকাল দুপুরে শাহবাগে বাসের জন্য অপেক্ষায় থাকা নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্য আবদুর রশিদ প্রতিবেদককে বলেন, শাহবাগ থেকে বনানী পর্যন্ত বিআরটিসির বাসে আগে ৩০ টাকা ভাড়া ছিল, এখন নেওয়া হচ্ছে ৩৫ টাকা। কিলোমিটারে ১০ পয়সা বাড়লে এই দূরত্বে ৬০ পয়সা বৃদ্ধির কথা ছিল। এ যেন যাত্রীদের জিম্মি করা। একই কথা বললেন তাঁর পাশের যাত্রী ইয়াকুব আলী। তাঁরা বললেন, বাসের কাউন্টার কিংবা বাসে ভাড়ার তালিকা টাঙানো হয়নি। শাহবাগে বিআরটিসির টিকিট বিক্রেতা আমিনুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, যেখানেই নামেন, আগের চেয়ে ভাড়া পাঁচ টাকা বেশি লাগবে। ৩০ থেকে ৩৫ জন যাত্রী বলেন, গুলিস্তান থেকে মাওয়া, বঙ্গবাজার থেকে মানিকগঞ্জ, গাজীপুরসহ বিভিন্ন পথে ২০ থেকে ২৫ টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী এই প্রতিবেদককে বলেন, সরকার যে পরিমাণ ভাড়া বাড়ায়, তার তুলনায় চালক ও মালিকেরা কয়েক গুণ অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করেন। ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালালে তাঁরা ধর্মঘট করেন। সব মিলিয়ে মানুষ জিম্মি। পরিবহনমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ প্রতিবেদককে বলেন, এই পর্যন্ত যতবার বাস ভাড়া বেড়েছে, প্রতিবারই সেটি নিয়ে কিছু সমস্যা হয়েছে। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে গেছে। এবারও তাই হবে। আমরা ঢাকার ১৩০টি বাস কোম্পানির সব মালিককে ডেকে বলেছি, কেউ যেন অতিরিক্ত ভাড়া আদায় না করেন। আমরা নিজেরাও পর্যবেক্ষণ করছি। এ পর্যন্ত ২০-২২ জনকে সতর্কও করেছি। ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযানের সময় যদি কোনো শ্রমিককে হাতকড়া পরান, তা হলে সমস্যা হয়। রোববার এ নিয়ে সংকট হয়েছিল। তবে আমরা বৈঠকে বসে সমাধান করেছি, কেউ অতিরিক্ত ভাড়া নিলে জরিমানা করা হোক, কিন্তু যাত্রীবাহী বাস থেকে কাউকে গ্রেপ্তার বা হেনস্তা যেন না করা হয়। বৈঠকে এ বিষয়ে আমরা আশ্বাস পেয়েছি। আশা করছি, এ ধরনের ধর্মঘট আর হবে না। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সচিব শওকত আলী বলেন, মালিকদের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমরা তাঁদের ভাড়ার তালিকা দিয়ে দিয়েছি। বেশি ভাড়া নেওয়ার সুযোগ নেই। আমাদের অভিযান চলবে। কেউ বেশি ভাড়া নিলে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রধান উপদেষ্টা সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, সরকার নিজে থেকে যেহেতু ভাড়া বাড়িয়েছে, কাজেই এটা তদারকি করা তাদের দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে বাসমালিক বা শ্রমিকদের সঙ্গে আপস করার কোনো সুযোগ নেই। এই মুহূর্তে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন বাসস্টপেজে ভাড়ার তালিকা বিলবোর্ডের মতো টাঙিয়ে দেওয়া উচিত।-প্রথমআলো ২০ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে