বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম : জন্মের পর থেকেই গ্রামেগঞ্জে শুনছি, 'কত রঙ্গ দেখাইলা মাঐ, পিঠার দেখাইলা ঠ্যাং।' ঠিক সেই রকম এক বিচারপতি যাওয়ারকালে আরেক বিচারপতির অভিশংসন চেয়েছেন রাষ্ট্রপতির কাছে। তাও আবার যে সে বিচারপতি নন, একেবারে প্রধান বিচারপতির বরখাস্ত কামনা। এভাবে বিচার-আচার, আইন-আদালত, দেশ কিছু থাকে? এ কী এক অরাজকতা! এসব থেকে কবে মুক্তি পাব?
'৭৪-এ রামপুর-কুকরাইলে এক রাতে ডাকাত ধরা পড়ে গণপিটুনিতে নিহত হলে দেখা যায় সেখানে বল্লা ক্যাম্পের এক পুলিশ রয়েছে। পুলিশের ডাকাতি করায় দোষ নেই, জনতা ডাকাত মেরেছে তাই বড় দোষ। ক্যাম্প থেকে দলবদ্ধ পুলিশ গিয়ে রামপুর-কুকরাইল জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছিল, করেছিল মা-বোনদের চরম নির্যাতন। খবর পেয়ে ছুটে গিয়েছিলাম, তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। হুজুর মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে নিয়ে গিয়েছিলাম। চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধু তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের মস্কোতে ছিলেন। সেখানেই তাকে রামপুর-কুকরাইলের মানুষের দুরবস্থার কথা জানিয়ে প্রতিকার চেয়েছিলাম। ৪০-৪১ বছর আগে তাদের দুঃসময়ে পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। আজ যাচ্ছি রামপুর-কুকরাইলে, দেখি তারা আমার পাশে, আমার দলের পাশে দাঁড়ায় কিনা।
যাকে দেখেশুনে যার কারণে রাজনীতিতে এসেছিলাম, বঙ্গবন্ধুকে পেয়েছিলাম, জননী জন্মভূমিকে চিনেছিলাম, সেই পিতৃতুল্য বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী নানা ষড়যন্ত্রের আবর্তে গত ১ সেপ্টেম্বর সংসদ সদস্য পদ ত্যাগ করতে বা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। ৬ তারিখ নির্বাচন কমিশন তার আসন শূন্য করেছে। সেই থেকে জল্পনা-কল্পনার শুরু, সেখানে কে নির্বাচন করবেন। আগে গ্রামগঞ্জে গরু-ছাগল মারা গেলে শকুনির আনাগোনা দেখতাম। লতিফ সিদ্দিকীর আসনটি নিয়ে আওয়ামী লীগের মধ্যে তেমনি টানাটানি কাড়াকাড়ি শুরু হয়েছে। আওয়ামী রাজনীতির মধ্য দিয়েই আমাদের জন্ম। এখন তাতে নানা রং ঢং তেল মেশায় বঙ্গবন্ধুকে খুঁজে পাই না। যে কারণে অনেক অবহেলা-লাঞ্ছনা-নির্যাতন সহ্য করেও গামছা নিয়ে রাস্তাঘাটে পড়ে আছি। দেশে সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি হোক, ভারসাম্যহীন রাজনীতি ও সামাজিক অবক্ষয়ের অবসান ঘটুক এমন আশাতে যতটা পারি মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করি।
গত ১৮ আগস্ট ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি, বাঙালির অহংকার শ্রী প্রণব মুখার্জির স্ত্রী মহীয়সী নারী শুভ্রা মুখার্জির মহাপ্রয়াণে এক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। তার শ্রাদ্ধে দিলি্ল গিয়েছিলাম। আজমিরে খাজা বাবার পবিত্র মাজার জিয়ারত করে ফেরার পথে বিমান থেকে নামার আগেই শুরু হয়েছিল কালিহাতীর শূন্য আসনে কে নির্বাচন করবে, আমি করব নাকি আমার দল করবে। উপনির্বাচনের মধ্য দিয়েই আমার দলের জন্ম। সবার অংশগ্রহণে ভোট হয়নি বলে আমরা জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিইনি। ৫ জানুয়ারি ২০১৪-র জাতীয় নির্বাচনের মাত্র ১৫ দিন পর ২০ জানুয়ারি বিনা ভোটে নির্বাচিত টাঙ্গাইল-৮ আসনের সংসদ সদস্য শওকত মোমেন শাজাহান মারা যান।
সৃষ্টি হয় এক শূন্যতা। সবাই উঠেপড়ে লাগে আমাদের দলের জন্ম নেওয়া সিট, সেখানে আমাদের অংশ নিতেই হবে। এলাকার মানুষ এবং কর্মীদের অনেক চাপাচাপিতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ সখিপুর-বাসাইলের উপনির্বাচনে অংশ নেবে। দুর্জনের ছলনার অভাব হয় না। যে কোনোভাবেই হোক সে উপনির্বাচনে আমাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেওয়া হয়নি। এরপর '৭৫-এর প্রতিরোধ সংগ্রামের আমারই এক সহকর্মী নাসিম ওসমানের আকস্মিক মৃত্যুতে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসন খালি হয়। সেখানে আমাদের দলের শফিকুল ইসলাম দেলোয়ার গামছা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। সেই থেকে আমাদের সিদ্ধান্ত কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ যে কোনো উপনির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। সেই হিসেবে গত ১২ সেপ্টেম্বর বর্ধিত সভায় ঠিক হয় টাঙ্গাইল-৪, কালিহাতী আসনের উপনির্বাচনে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ অংশ নেবে। আমি প্রার্থী হব কি হব না তা ঠিক হবে আরও ২-৪ দিন পর।
মাত্র ক'দিন আগে দেশে ২০ স্তরের এক বেতন কাঠামো ঘোষণা হয়েছে। উপরে ৭৮,০০০ নিচে ৮,২৫০। এমন বৈষম্যের বেতন কাঠামো পৃথিবীতে আর কখনো দেখেছি কিনা জানি না। ভাবতে অবাক লাগে, সর্বোচ্চ ৭৮,০০০ সর্বনিম্ন ৮,২৫০ এমন হবে কেন? উচ্চ পদাধিকারীদের পেট কি সাগর আর ছোটদের চড়ুইভাতি? জীবনের কড়কড়ে বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখেছি, যারা বড় চাকরি-বাকরি করে, ধনী মানুষ, তারা আত্দীয়স্বজনের খোঁজখবর রাখে না, মা-বাপকে দেখে না, ভাইবোনের বোঝা বয় না, প্রতিবেশীর খবর রাখে না। কিন্তু কেরানি, পিয়ন, চাপরাশির চাকরি যারা করে তারা বাবা-মা, ভাইবোন, সন্তান-সন্ততি, প্রতিবেশী নিয়ে একবেলা খেয়ে মাটিতে পড়ে থেকেও সবাইকে নিয়ে জীবন চালায়।
সেই গরিবের বেতন এত কম আর পেট মোটা বড়দের বেতন অত বেশি! তবে কি গরিব মারতে পাকিস্তান হানাদারদের কাছ থেকে বাংলাদেশ ছিনিয়ে এনেছি? ভাবতে কেমন লাগে? একজন বড়মাপের কর্মচারী চাকরিতে নিয়োগের পর থেকেই বাড়ি, গাড়ির ড্রাইভার, পিয়ন, চাপরাশি, বাবুর্চি কত কিছু পায়, কোনো অভাব থাকে না। তারপরও তার অত বেতন! ঠিক আছে, সর্বোচ্চ ৭৮,০০০ হলে সর্বনিম্ন বেতন ৬০,০০০ হতো, তাহলেও না হয় বলা যেত। কোথায় ৭৮ আর কোথায় ৮। ৭০,০০০-ই নেই- এটা কী করে সম্ভব? বিবেকবান কোনো মানুষ এমন আকাশ-পাতাল বৈষম্যের চিন্তা করতে পারে? পারে না। মেনে নিতে পারে? পারে না।
একটা দেশে যত সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তা থাকে তার ১০-১৫ গুণ বেশি থাকে বেসরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তা। সরকারি বেতন বৃদ্ধির যে প্রভাব বাজারে পড়বে, বেসরকারি চাকরিজীবীরা সে চাপ সইবে কী করে! বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সবাই যে না খেয়ে মরবে। হ্যাঁ, সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধিতে বাজারে কোনো প্রভাব না পড়লে সুবিধাভোগী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যেমন লাভ হতো, সাধারণ মানুষেরও তেমনি কোনো ক্ষতি হতো না। শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকার আশায় সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি এক সময় বুমেরাং হতে পারে। পদক্ষেপটা আরও ভেবেচিন্তে নেওয়া উচিত ছিল। তাছাড়া এটা কী করেছেন অর্থমন্ত্রী?
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কর্মচারীদের নিচে নামিয়ে এনে অপমান-অপদস্থ করলেন। কেন শিক্ষাকে ধ্বংসের এ অপচেষ্টা? মাননীয় অর্থমন্ত্রী দেশে অশান্তি সৃষ্টিতে বারবার ঘৃতাহুতি দিচ্ছেন যা হয়তো এখনো অনেকে হৃদয়ঙ্গম করছেন না। গরিব কৃষক ২-৪-১০ হাজার টাকা কৃষিঋণ শোধ করতে না পারলে তার মাজায় রশি বেঁধে জেলে নেওয়া হয়। আর অর্থমন্ত্রী হলমার্কের সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা লুটকে সমর্থন করে বলেন, 'চার হাজার কোটি কোনো টাকা হলো!' ৮০, ৯০ লাখ তরুণ শেয়ার ব্যবসায়ীর ভাগ্য লুটে নেওয়ার ঘটনার প্রতিকার অর্থমন্ত্রী করেননি বরং বলেছেন, 'তারা প্রবল শক্তিশালী। তাদের নাম বলা যাবে না। তাদের ধরাছোঁয়া যাবে না।'
গরিবের রক্ত-ঘামে সৃষ্ট বাংলাদেশ এ যেন আজ ধনবানের, লুটের এক তীর্থভূমি। দিনে দিনে ধনী আরও ধনী, গরিবরা নিঃস্ব-রিক্ত হচ্ছে। সর্বত্র দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতিতে ছেয়ে যাচ্ছে। লাগামহীন প্রশাসন, গতিহীন অর্থনীতিতে নিরুৎসাহিত হতাশ দেশবাসী। মনে হয় যেন কোথাও কোনো আশার আলো নেই। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে যাক, শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে পড়ুক- এমন আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে শরিক হয়ে কেউ আমাদের উচ্চশিক্ষার পথ রুদ্ধ করার প্রয়াস পাচ্ছে। শিক্ষা তো কোনো ব্যবসা নয়, সেখানে ভ্যাট কেন?
স্বীকার করি, ইদানীং শিক্ষা ও স্বাস্থ্য আর সেবাখাত হিসেবে বিবেচিত হয় না। বেসরকারি স্বাস্থ্য শিক্ষা এখন প্রধান ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। তবু ছাত্রছাত্রীদের ভ্যাট দিতে হবে এ কেমন কথা? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, 'ছাত্রদের ভ্যাট দিতে হবে না। ভ্যাট দেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।' শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দালানকোঠা, চেয়ার-টেবিল তো কোনো উপার্জন করে না। যা কিছুই দিতে হবে ছেলেমেয়েদের পকেট থেকেই দিতে হবে। ছাত্রছাত্রীরা ভ্যাট দেবে না বলে রাস্তায় নেমেছে। যে কারণে ঢাকার রাস্তাঘাটে অসহনীয় যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। তবু ছাত্রছাত্রীদের ধন্যবাদ জানাই, তারা রাস্তায় নেমেছে।
অনেক দিন ধারণা ছিল, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করা, ব্যাগ নিয়ে ঘোরাফেরা করা ছেলেমেয়েরা পোলট্রির মুরগির চেয়ে বেশি কিছু নয়। কিন্তু তারা আজ চরম অন্যায়ের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামায় তাদের প্রতি স্নেহ-ভালোবাসায় বুক ভরে গেছে। রাস্তায় বসে থাকা ছেলেমেয়েদের মাঝে আমি বঙ্গবন্ধুকে, মওলানা ভাসানীকে খুঁজে পাচ্ছি, কোথাও কোথাও আমি নিজেকেই তাদের মাঝে আবিষ্কার করছি। চারদিকে সর্বগ্রাসী নতজানু মনোভাবে ভাসিয়ে নেওয়া বানে এই অহিংস প্রতিবাদ-প্রতিরোধ জাতিকে জাগিয়ে তুলবে।
এতদিন অনেক আন্দোলন, অবরোধ-হরতাল হয়েছে। দৃঢ়কণ্ঠে বলতে চাই, ইচ্ছা করলে তারা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে নিয়ন্ত্রিত, অহিংস, ভাঙচুরহীন, অবরোধ-হরতাল-বিক্ষোভের প্রশিক্ষণ নিতে পারেন। আমি এবং আমার দল ছাত্রদের এই ভ্যাটবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে একমত পোষণ করেছি আর ভেবেছি, অর্থমন্ত্রীকে শিক্ষার ওপর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহারের অনুরোধ জানাচ্ছি। তা না হলে দেশবাসী তাকেই প্রত্যাহার করে নেবে।
আমরা যখন বেড়ে উঠছিলাম তখন ছিল প্রবল আইয়ুব-মোনায়েমবিরোধী আন্দোলনের সময়। শত উসকানির মাঝেও হাজার হাজার ছাত্র-যুবক নিয়ে আমরা দিনের পর দিন রাস্তাঘাট মাতিয়ে তুলতাম। সে আন্দোলনে আমাদের কী দারুণ অভাবনীয় নেতৃত্ব কর্তৃত্ব থাকত যা আজ ভাবতেই অবাক লাগে। আজকাল যখন দেখি ছাত্র সমাবেশে ছাত্ররা নেই, কোনো মিছিল-মিটিংয়ে লোক নেই, গতি নেই, মেয়েদের অংশগ্রহণ নেই তখন বড় হতাশ লাগে। সেদিন ছাত্রদের অবরোধে ঢাকা ছিল অনেকটাই স্থবির। তারই মাঝে বায়তুল মোকাররমের দিক থেকে ফিরছিলাম। হাইকোর্টের কাছাকাছি এলে এক মিছিল দেখি। প্রথম বুঝতে পারিনি, পরে দেখলাম ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সম্মেলন। তারা কোথায় যাচ্ছিল ঠিক বলতে পারব না। তবে হাইকোর্টের পাশ দিয়ে যাওয়ার পথে তাদের দেখে দারুণ খুশি ও উৎসাহিত হয়েছি। বহুদিন পর ছাত্রছাত্রীদের একতালে পা মিলিয়ে যেতে দেখে গর্বে বুক ভরে গেছে। যে দলেরই হোক, যে নীতিরই হোক ছাত্র সে যে ছাত্রই।
সুশৃঙ্খল লম্বা লাইনে হেঁটে যেতে দেখে আইয়ুব-মোনায়েমবিরোধী আন্দোলনের কথা মনে পড়েছে। আশায় বুক ভরে গেছে, মনে হয়েছে এখনো দেশ একেবারে রসাতলে যায়নি, যানবাহন না ভেঙে হাজারো বঙ্গসন্তান সুশৃঙ্খলভাবে এখনো রাস্তায় মিছিল করতে পারে। ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সম্মেলন উপলক্ষে মিছিলে আমি জাতির এক সুন্দর ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি। মাভৈ, যে অমৃতের সন্তানের আশায় পথ চলি, আজ হোক, না হয় কাল সে দিগ্বিদিক কাঁপিয়ে একদিন আসবেই এবং ঘুমন্ত দেশবাসীকে জাগিয়ে তুলবেই।-বিডিপ্রতিদিন
লেখক : রাজনীতিক
১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে