মঙ্গলবার, ০১ আগস্ট, ২০১৭, ০১:২৪:১৫

ত্রিকোণ প্রেমই কাল হলে দাঁড়ালো মিথিলার জীবনে

ত্রিকোণ প্রেমই কাল হলে দাঁড়ালো মিথিলার জীবনে

শুভ্র দেব : পরিবারের সঙ্গে রামপুরার হাজীপাড়ায় থাকতেন মিথিলা। ২০ বছর বয়সী এই তরুণী স্থানীয় একরামুন্নেছা কলেজের এইচএসসি প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। দীর্ঘদিন আসলাম নামের এক যুবকের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। সম্পর্ক থাকাকালে মিথিলা আরেক যুবকের সঙ্গে প্রেমে জড়িয়ে পড়েন। এই ক্রিকোণ প্রেমই কাল হলে দাঁড়ালো তার জীবনে।

ধীরে ধীরে সম্পর্কের অবনতি ঘটে মিথিলা-আসলামের। আসলামকে সময় দিতেন না মিথিলা। ভালোভাবে কথাও বলতেন না। নাছোড়বান্দা আসলাম পিছু হটেননি। মিথিলাকে বিয়ের চাপ দিতে থাকেন। এজন্য বিভিন্ন ভয়ভীতি দেখাতে থাকেন আসলাম। কিন্তু তাতেও রাজি হয়নি মিথিলা। আর এটাই কাল হয়ে দাঁড়ায়।

প্রথম প্রেমিক আসলাম তার নতুন এই সম্পর্ক মেনে নিতে পারেননি। শেষমেশ প্রেমিকা মিথিলাকে হত্যার ছক কষে। ছক মোতাবেক সুকৌশলে মিথিলাকে নিয়ে যায় শ্যামলীর তাজিন হোটেলে। স্বামী-স্ত্রীর পরিচয়ে হোটেলে ওঠে তারা। পরে হোটেলের ১০৭নং কক্ষে নিয়ে মিথিলাকে প্রচণ্ড মারধর করে আসলাম।

অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন করে। পরে গলায় দড়ি পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যার চেষ্টা চালায়। একপর্যায়ে মিথিলা রক্তাক্ত হন। অচেতন হয়ে পড়েন। মৃত্যু নিশ্চিত ভেবে আসলাম হোটেল কক্ষে মিথিলাকে ফেলে পালিয়ে যান। বিকালে হোটেল কর্তৃপক্ষ মিথিলাকে অচেতন অবস্থায় দেখতে পান।

খবর পেয়ে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ মিথিলাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১২ দিন পর গত ১৯শে জুলাই মিথিলা মারা যান। এ ঘটনায় মোহাম্মদপুর থানার উপ-পরিদর্শক আজিজুল হক বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা করেন।

এদিকে সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণহীন এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আসলাম নামের এক যুবককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আসলাম ঢাকার একটি জুস ফ্যাক্টরিতে কাজ করে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে হত্যার বিষয়টি স্বীকার করে। পুলিশকে সে জানায়, দীর্ঘদিন ধরে মিথিলার সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক ছিল।

মোহাম্মদপুর থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) শরিফ উদ্দিন জানান, মিথিলা হত্যার মামলা দায়েরের পর থেকে বিষয়টিকে খুব গুরুত্বসহকারে দেখা হয়। কোনো রকম তথ্য না থাকায় রহস্য উদঘাটনে প্রথমে বেগ পেতে হয়। কারণ হোটেলের রেজিস্ট্রিতে তারা ভুয়া ঠিকানা ও নাম ব্যবহার করে। তাদের দেয়া ঠিকানা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চরচণ্ডীপুরের ঠিকানায় খোঁজ করে এই নামের কাউকে পাওয়া যায়নি।

রেজিস্ট্রি খাতায় দেয়া মোবাইল নম্বরটিও অনেক দিন ধরে বন্ধ ছিল। পরে পুলিশ প্রযুক্তি ব্যবহার করে আসামি আসলামকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়। এদিকে মিথিলা চিকিৎসাধীন থাকাকালীন তার হাতের আঙুলের ছাপ নিয়ে নির্বাচন কমিশন অফিসে যোগাযোগ করেও কোনো তথ্য পায়নি পুলিশ। পরে মিথিলার সঙ্গে থাকা এসএসসি পরীক্ষার একটি নম্বরপত্রের সূত্রধরে তার পরিচয় শনাক্ত করা হয়।

রামপুরার একরামুন্নেছা কলেজের এইচএসসি প্রথম বর্ষের ছাত্রী মিথিলা পরিবারের সঙ্গে রামপুরা হাজীপাড়ার একটি বাসায় থাকতো। গ্রেপ্তারের পর প্রেমিক আসলামকে নিয়ে অভিযান চালিয়ে মিথিলার মোবাইল ফোন ও বিভিন্ন আলামত উদ্ধার করেছে পুলিশ।

যেভাবে রহস্য উদঘাটন হয়: অচেতন অবস্থায় হোটেল থেকে উদ্ধারের পর থেকেই পুলিশ বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করে। মিথিলা মারা যাওয়ার পর মোহাম্মদপুর থানার এসআই আজিজুল হক বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলার তদন্তের দায়িত্ব পড়ে পুলিশ পরিদর্শক শরিফ উদ্দিনের কাছে। তিনি শ্যামলীর ওই হোটেলটিতে অভিযান চালিয়ে হোটেলের মালিক ও কর্মচারীকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।

জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে তারা তাদের তৈরি করা কিছু আলামত পুলিশকে দেয়। সেই আলামত ভুয়া প্রমাণিত হওয়ায় পুলিশ তাদের আবার জিজ্ঞাসাবাদ করে। পরে তারা স্বীকার করে মিথিলার সব আলামত তারা নষ্ট করে ফেলেছে। কারণ রহস্য উদঘাটন হলে ভুয়া পরিচয়ে হোটেলে তোলার জন্য তাদের সমস্যা হতে পারে। পুলিশ অনেক খোঁজাখুঁজি করে হোটেলের ডাস্টবিনে মিথিলার একটি নম্বরপত্র খুঁজে পায়। পরে নম্বরপত্রের সূত্র ধরেই মিথিলার কলেজে যোগাযোগ করে রহস্য উদঘাটন করে পুলিশ।

মিথিলার পরিবারে শোকের ছায়া: গতকাল মিথিলার ৪৮/১ হাজীপাড়ার বাসায় গিয়ে দেখা যায় আদরের মেয়ের হত্যাকাণ্ডে শোকে পাথর হয়ে গেছে তার পরিবারের সদস্যরা। মিথিলার মা মিনারা বেগম এখনো পথ চেয়ে বসে আছেন মেয়ে কলেজ থেকে ফিরবে। তার ছোট বোন সিনথিয়া অপেক্ষায় আছে বাসায় ফিরে মিথিলা তার সঙ্গে আবার খঁনসুটি করবে। মিথিলার এই মর্মান্তিক মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না তার পরিবার।

মিথিলার মা মিনারা বেগম জানান, প্রতিদিনই তিনি নিজেই মেয়েকে কলেজে দিয়ে আসেন আবার ক্লাস শেষে গিয়ে নিয়ে আসেন। কিন্তু সেদিন মিথিলার বাবা চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন। তাই তার সেবা যত্নের জন্য তিনি আর সেদিন নিয়ে যেতে পারেননি। সকাল সাড়ে ৭টার দিকে মিথিলা কলেজের পোশাক পরে ঘর থেকে বের হয়।  

তিনি জানান, বের হওয়ার সময় বলে যায় আম্মু কলেজে যাচ্ছি দরজাটা বন্ধ কর। এরপর আর তার সঙ্গে  কোনো কথা হয়নি। সেদিন দুপুর সাড়ে ১১টায় মিথিলার বাবা তার মোবাইলে ফোন দেয়। কয়েকবার রিং হওয়ার পর কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। এক সময় সেই মোবাইল নম্বরটি বন্ধ হয়ে যায়।

মিথিলার মা আরো জানান, সে খুব শান্ত স্বভারের মেয়ে ছিল। মার্কেট, কলেজ সব জায়গায়ই সে তার মার সঙ্গে যেত। বখাটে আসলাম দীর্ঘদিন ধরে মিথিলাকে জ্বালাতো। নানা রকম ভয়ভীতি দেখাতো। সে কলেজে যাওয়া-আসার রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতো। মিথিলাকে রাজি করানোর জন্য অনেক চেষ্টা করে। সেই ক্ষোভের জন্যই সে মিথিলাকে হত্যা করে।

মিথিলার বাবা গিয়াস উদ্দিন জানান, দুই মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে মিথিলা সবার বড় ছিল। মেয়ে হত্যার খবর পেয়ে পুরো পরিবার অচল হয়ে গেছে। সব আনন্দ যেন মিইয়ে গেছে। আজ এতদিন হয়ে গেছে মেয়ের চেহারাটা দেখতে না পেরে অনেক কষ্ট হচ্ছে। মেয়ের লাশ পর্যন্ত এখন পাওয়া যাচ্ছে না। মিথিলা মারা যাওয়ার পর তার লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়। পরে লাশ আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম দাফন করে। কিন্তু মিথিলার পরিবারের মোবাইলে কে বা কারা ফোন দিয়ে বলছে লাশ এখনো মর্গে আছে। বিশ হাজার টাকা দিলে লাশ দেয়া হবে।
 
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদপুর থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) শরিফ উদ্দিন জানান, মিথিলা হত্যাকাণ্ডের আসামি আসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে প্রেমের সম্পর্কের কারণে হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছে বলে সে স্বীকার করেছে।

মোহাম্মদপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) জামাল উদ্দিন মীর বলেন, দীর্ঘ তদন্তের পর আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মিথিলার নম্বরপত্রের একটি কপির সূত্র ধরে তার কলেজে যোগাযোগ করেন তদন্ত কর্মকর্তা। কলেজের অধ্যক্ষের মাধ্যমেই মিথিলার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের প্রেমের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়।

পরে আসামির মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। আসামি মিরপুর বাঙলা কলেজের শিক্ষার্থী পাশাপাশি সেজান জুস কোম্পানিতে কাজ করে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) উপ-কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আদালতে আসামি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। -এমজমিন
এমটিনিউজ/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে