শনিবার, ১৯ আগস্ট, ২০১৭, ১২:১৫:৪৪

এ কোন ভারত?

এ কোন ভারত?

কাজী আলিম-উজ-জামান : গানের দেশ, ফুলের দেশ, পাখির দেশ ভারত। বহু মানুষ, বহু ভাষা, বহু সংস্কৃতির এক বিচিত্র দেশ এই ভারত। বহুত্ববাদ আর সহিষ্ণুতাই ভারতের ধর্ম। সেদেশের সংবিধান ভারতকে এভাবেই পরিচিত করেছে।

কিন্তু কী আশ্চর্য! সংবিধানের এই বিষয়গুলোই বারবার মনে করিয়ে দিতে হচ্ছে। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি তার বিদায়ী ভাষণে মনে করিয়ে দিলেন। এরপর উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারিও সতর্ক করলেন গোটা দেশকে। স্পষ্ট করে বললেন, ভারতের সংখ্যালঘুরা নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন।

রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতির বিদায়ী ভাষণের বার্তাকে ইতিবাচকভাবে নিতে পারত মোদি সরকার। কিন্তু ক্ষমতাসীনেরা তা করলেন না। দুই সাংবিধানিক পদাধিকারীর বক্তব্যের মধ্যে ‘উদ্দেশ্য’ খুঁজে পেলেন, বিশেষ করে হামিদ আনসারির বক্তব্যে। এক বিজেপি নেতা এ-ও বললেন, তিনি (হামিদ) এখন রাজনীতির মঞ্চ খুঁজছেন। এ জন্য এমন বক্তব্য।

ভারত বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ। জনগণের ভোটেই নির্দিষ্ট সময় পরপর ক্ষমতার পালাবদল হয়। স্বাধীনতার পর থেকে একবারও ব্যতিক্রম হয়নি। এ কথা বলায় কোনো অত্যুক্তি নেই যে ভারত গণতন্ত্রের উজ্জ্বল ক্ষেত্র।

শুধু কেন্দ্রে নয়, বিভিন্ন রাজ্যের সিংহাসনও হিন্দুত্ববাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির দখলে। দিকে দিকে সাম্প্রদায়িক এই দলটির বিজয়কেতন উড়ছেই। আপনি পছন্দ করুন আর না করুন, মোদির বিজেপি ছাড়া ভারতীয় রাজনীতি এখন অকল্পনীয়।

দলটির বিজয়ের পাগলা ঘোড়া যেভাবে ছুটছে, তাতে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস পরিণত হয়েছে নিতান্ত দুর্বল একটি দলে। মা-ছেলের দলটির এখন না আছে কোনো তেজ, না আছে কোনো পাল্টা রণকৌশল। ভারতের জনগণ ভালোবেসে কংগ্রেসকে ক্ষমতায় বসাবে না। বিজেপির উত্থানে কেবল কংগ্রেস নয়, ধূলিসাৎ হয়েছে তৃতীয় শক্তিও। (উদাহরণ উত্তর প্রদেশ)

২. বর্তমানে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ, উপরাষ্ট্রপতি ভেঙ্কাইয়া নাইডু ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি—তিনজনই বিজেপির আদর্শে রঞ্জিত মানুষ। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এ রকম দৃশ্যপট আগে তৈরি হয়নি। দেশটিতে বহুত্ববাদ আর সহিষ্ণুতার ঘুড়ি নাটাই ছেড়ে পালিয়েছে কোথায় যেন! অসাম্প্রদায়িকতা, পরমতসহিষ্ণুতা—এসব শব্দ গেছে নির্বাসনে।

এ এক এমন ভারত, যেখানে গণতন্ত্রই সাম্প্রদায়িকতা ও দলতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষক? এ এমন এক নতুন ভারত, যেখানে সংখ্যালঘুদের ধর্মমতচর্চা ঝুঁকিতে। এ ভারত চেনা চোখে সম্পূর্ণ অচেনা ভারত। এ এমন এক অসাম্যের ভারত, যেখানে ঝাড়খন্ডের মোহাম্মদ নায়িম, হরিয়ানার হাফিজ জুনায়েদ, রাজস্থানের পেহলু খান কিংবা উত্তর প্রদেশের মোহাম্মদ আখলাক গুজবের বশে নিহত হলেও তাদের জন্য কেউ অশ্রুপাত করে না। টুইটারপ্রিয় প্রধানমন্ত্রীর টুইটে রচিত হয় না একটি শব্দও।

এ এমন এক ভারত, যেখানে কর্ণাটকের প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী এম এম কালবুর্গি নিজ বাড়িতে খুন হন অজ্ঞাত বন্দুকধারীর গুলিতে, কেবল ভিন্ন আদর্শে বিশ্বাস স্থাপনের জন্য?

কথিত গরুর মাংস রাখা বা গরু জবাইয়ের ঘটনায় ‘অভিযুক্ত’ হয়ে যারা নিহত হয়েছেন, একটা হত্যাকাণ্ডের বিচারেও গতি নেই। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক হলো, ভারতের শিল্পী, লেখক, মানবাধিকারকর্মী, সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে যথেষ্ট প্রতিবাদ হয়েছে। অরুন্ধতী রায়সহ ৪১ জন লেখক, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, কবি জাতীয় পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু বিজেপি সরকার কোনো প্রতিবাদই গায়ে মাখেনি।

হিন্দুস্তান টাইমসের একজন কলামিস্ট কিছুটা কৌতুকের স্বরে লিখেছেন, পর্তুগালে দাবানলের খবর বিজেপি সরকারকে যতটা ভাবায়, সামাজিক সম্প্রীতি রক্ষার বিষয়টিও ততটা ভাবাচ্ছে না। তাই আজ গণমাধ্যমে বাসে, ট্রেনে, পথে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিগ্রহের খবর।

উগ্রপন্থা আরও উগ্রপন্থার জন্ম দেয়। সেখান থেকে তৈরি হয় জিঘাংসার বিভীষিকা। আর সেই বিভীষিকা থেকে আসা লাভের সোনালি ফসল ঘরে তোলে বিজেপি।

৩. দক্ষিণ এশিয়ায় সেই অর্থে কেবল ভারতেই এখন ধর্মবাদী দল ক্ষমতায়। সাম্প্রদায়িকতা একটি দেশের সঙ্গে প্রতিবেশী আরেকটি দেশের, এক মানুষের সঙ্গে আরেক মানুষের প্রীতিপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় বিরাট বাধা। সাম্প্রদায়িকতা এক অনুশোচনার নাম।

ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ দেশ। এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা ও কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারে ভারতের বড় ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু একটি বিজেপির মতো সরকার কীভাবে সেই ভূমিকা রাখতে পারে?

লক্ষণীয় হলো, ভারতে সাম্প্রদায়িক শক্তির এই বিকাশ ও উল্লম্ফন সবই হয়েছে স্বীকৃত গণতন্ত্রের মোড়কে। আর এর দায় সেদেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তিরও। এ বেদনা আমরা কোথায় রাখি? প্রথম আলো

লেখক : কাজী আলিম-উজ-জামান (সাংবাদিক)
এমটিনিউজ/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে