রবিবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৭, ১১:২৫:৩৯

মিয়ানমারকে বিজিবির হুঁশিয়ারি

মিয়ানমারকে বিজিবির হুঁশিয়ারি

নিউজ ডেস্ক : সীমান্তের জিরো লাইন ক্রস করে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে কোনো গুলি আসলে পাল্টা দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির মহাপরিচালক আবুল হোসেন। মিয়ানমার বাহিনী এবং সশস্ত্র রোহিঙ্গাদের প্রতি ইঙ্গিত করে এ হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি।

রবিবার বিকালে কক্সবাজারের সীমান্ত এলাকা ঘুমধুমে বিজিবি ক্যাম্প পরিদর্শন করে সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান বিজিবি প্রধান। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধে বিজিবি সদস্যদের সতর্ক থাকারও নির্দেশ বিজিবি প্রধান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রামের আঞ্চলিক কমান্ডার কর্ণেল আলিফ, কক্সবাজারের সেক্টর কমান্ডার আনোয়ারুল আজিম, বান্দরবান জেলা প্রশাসক বাবু দীলিপ কুমার বণিক, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কামরুজ্জামান, ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মঞ্জুরুল হাসান খান, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এসএম সরওয়ার কামাল প্রমুখ।

বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, ‘স্বাধীন দেশের ভূখণ্ডে একটি গুলি পড়লে পাল্টা জবাব দেওয়া হবে। আমরা পরিপূর্ণভাবে যেকোন সমস্যা মোকাবেলায় প্রস্তুত রয়েছি। অতিরিক্ত ১৫ হাজার বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।’

বাংলাদেশ সীমান্তে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি)। শনিবার (২৬ আগস্ট) দুপুরের দিকে তুমব্রু’র ২টি পয়েন্ট দিয়ে ৮ থেকে ১০ রাউন্ড গুলিবর্ষণ করেছে তারা। এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। পরে বিজিপি দুঃখপ্রকাশ করে।

এদিকে ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত অং মিন্টকে তলব করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। শনিবার (২৬ আগস্ট) বিকালে তাকে তলব করেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (দ্বিপক্ষীয়) মাহবুবুজ্জামান। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান সহিংসতা ও নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান এবং রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের প্রেক্ষাপটে দেশটির রাষ্ট্রদূতকে তলব করা হয়।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে গত বৃহস্পতিবার রাখাইনে সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানানো হয়েছে। একইসঙ্গে, রোহিঙ্গারা যেন দলে দলে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ না করে সে ব্যবস্থা নেওয়ারও আহ্বান জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে অং মিন্টের কাছে একটি অনানুষ্ঠানিকপত্র হস্তান্তর করেছে ঢাকা।

মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের দাবি, রাখাইন রাজ্যে বৃহস্পতিবার (২৪ আগস্ট) এক রাতে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ২০টি পোস্টে হামলার ঘটনা ঘটে। এরপর সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযানে নামে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী। রোহিঙ্গাদের একটি জঙ্গি সংগঠন এ হামলার দায়ও স্বীকার করে। মিয়ানমার সরকারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চির দফতর এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, অভিযানে উভয়পক্ষের সংঘর্ষে নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ সদস্য এবং ৭৭ রোহিঙ্গা জঙ্গি নিহত হয়েছে।এ ঘটনার একদিন আগেই কফি আনান কমিশন তাদের প্রতিবেদন দেয়। তাতে রাখাইন রাজ্যের সমস্যা সমাধানে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দান ও স্বাধীন চলাচলের অনুমতির সুপারিশ করা হয়।

নতুন এ সহিংসতার পরই ফের বাংলাদেশের দিকে ঢল নামে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের। সীমান্তে বিজিবির কঠোর নজরদারি সত্ত্বেও কক্সবাজারের সীমান্ত দিয়ে দলে দলে অনুপ্রবেশ করছে তারা। তাদের অনেকেই গুলিবিদ্ধ ও গুরুতর আহত অবস্থায় বাংলাদেশে ঢুকেছেন। শনিবারই চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ এক রোহিঙ্গা মারা যান।

গত অক্টোবরেও সন্ত্রাসী হামলার জবাবে রাখাইনে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। ওই সময় প্রাণ বাঁচাতে অন্তত ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেন। তারা এখনও উখিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থান করছে।

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, শুক্রবার ভোরে রাথিডং শহরের ২০টি পুলিশ ফাঁড়িতে শ দেড়েক বিচ্ছিন্নতাবাদী বন্দুক হাতে বানানো বিস্ফোরক নিয়ে হামলা চালায়। রাখাইনের ওই শহরটিতে ১১ আগস্ট থেকে বিপুল সেনা মোতায়েন করেছে মিয়ানমার। সেনাপ্রধান মিন অং লায়েং তাঁর ফেসবুক পেজে লিখেছেন, সেনাবাহিনী ও পুলিশের সদস্যরা উগ্রপন্থী বাঙালি সন্ত্রাসীদের একসঙ্গে মোকাবিলা করেছে।

গত বুধবার রাতে মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের রাখাইন রাজ্যে পুলিশ পোস্টে সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলায় ১২ নিরাপত্তা কর্মীসহ ৯৬ জনের প্রাণহানির পর স্বাধীন রোহিঙ্গা রাজ্য প্রতিষ্ঠান জন্য আন্দোলনে থাকা সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সলভেশন আর্মি (এআরএসএ) এক টুইট বার্তায় হামলার দায় স্বীকার করে।

এরপর শুক্রবার ও শনিবার রাখাইনের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত মাওন তাও, বুথিডাং ও রাথেডংসহ বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক অভিযান চালায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এ সময় তারা ঘরবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। অভিযানের মুখে প্রাণ বাঁচাতে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশ সীমান্তের ঘুমধুম, তুমব্রু, রহমতের বিল, জলপাইতলী, ধামনখালী, কলাবাগান, তুমব্রু উত্তর পাড়া, তুমব্রু পশ্চিম পাড়ায় অবস্থান নেয়।

শনিবার দুপুরের পরে সীমান্তে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা নারী-শিশুদের ওপর মিয়ানমারের সীমান্ত পুলিশ বিজিপি গুলি চালালে এক ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

রবিবার সকালে সীমান্তের কাছাকাছি মিয়ানমারের ঢেকিবনিয়া ও তুমব্রু গ্রামে প্রচন্ড গুলিবর্ষণ হয়েছে এবং সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার নজরদারি রাখতে দেখা গেছে। মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী এসব রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার কৌশল বলে জানিয়েছেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান একেএম জাহাঙ্গীর আজিজ। তিনি বলেন, সীমান্তের তুমব্রু, ঘুমধুম ও পালংখালী নাফনদীর তীরবর্তী অঞ্চলের গ্রামবাসীরা বসবাস করছে। বিশেষ করে আতঙ্কে রয়েছে বাংলাদেশ সীমান্ত জনপদের মানুষও।

কক্সবাজার ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক মঞ্জুরুল হাসান খান জানিয়েছেন, তিন হাজারের অধিক রোহিঙ্গা নাফ নদীর ওপারে সীমান্তে অবস্থান নিয়েছে।

মিয়ানমার মংডুর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নেতা কেফায়ত উল্লাহ জানান, মিয়ানমার সেনাবাহিনী গ্রামের পর গ্রাম আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিচ্ছে। হুরটেইল কাইল্ল্যা ভাঙ্গা গ্রাম আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে। শত শত লোকজনকে ধরে নিয়ে গেছে। মেয়েদের নিয়ে গেছে নির্জন স্থানে। এই অবস্থায় মিয়ানমার ঢেকিবুনিয়া তুমব্রু থেকে এসে এপারের ঘুমধুম এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে দুই হাজারের বেশি রোহিঙ্গা নরনারী শিশু।

বালুখালী ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা মরিয়ম বেগম (৫৫) বেগম জানান, তার স্বামী ছেলেকে গুলি করে হত্যা করেছে সেনাবাহিনী। তাই তিনি পালিয়ে এসেছেন।

বিজিবি কর্মকর্তারা বলেছেন, বাংলাদেশের ভূখণ্ডে কোনো মর্টার শেল পড়েছে কি না, খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। তবে সীমান্ত পরিদর্শনে যাওয়া ম্যাজিস্ট্রেট মফিদুল আলম বলেন, মিয়ানমার পুলিশ বিজিপির ছোড়া তিনটি গুলি তুমব্রু বাজারে এসে পড়েছে। তবে কারও কোনো ক্ষতি হয়নি।

বিজিবি কক্সবাজারের সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল আনোয়ারুল আজিম বলেন, ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে কিছু সমস্যা হওয়ায় কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গা সীমান্তে জড়ো হয়েছে। কিন্তু কাউকে বাংলাদেশে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। সীমান্তে আরও জনবল বাড়ানো হয়েছে এবং সার্বক্ষণিক সতর্ক অবস্থায় রয়েছে বিজিবি।

মিয়ানমার আনুষ্ঠানিকভাবে রাখাইনের মুসলিম জনগোষ্ঠীকে রোহিঙ্গা বলে না। এদের সাধারণত উত্তর রাখাইনের মুসলিম বলা হয়। এবারের সংঘর্ষের পর মিয়ানমার সন্ত্রাসীদের পরিচয় দিতে গিয়ে উত্তর রাখাইনের মুসলিমদের পরিবর্তে ‘বাঙালি’ শব্দটি ব্যবহার করেছে।

এ নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাঁদের মতে, সুযোগ পেলেই রোহিঙ্গাদের পরিচয় দেওয়ার সময় ‘বাঙালি’ শব্দটা ব্যবহার করা মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নিয়মে পরিণত হয়েছে। এবার রাখাইনে সংঘর্ষের পর ‘বাঙালি’ শব্দটি ব্যবহার করে সু চি বুঝিয়ে দিলেন, সেনাবাহিনীর মতো তাঁর অবস্থানও অভিন্ন।
এমটিনিউজ২৪.কম/এইচএস/কেএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে