বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম : ঈদ মোবারক! ঈদ মোবারক! খুশির ঈদ, ত্যাগের ঈদ আমাদের জাতীয় জীবনে বয়ে আনুক অনাবিল আনন্দ। দেশবাসী হিংসা-বিদ্বেষ-জিঘাংসা থেকে মুক্ত হয়ে ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হোন, স্রষ্টার দরবারে এই শুভদিনে সেই প্রত্যাশাই করি।
দেখতে দেখতে বেদনার মাস আগস্ট চলে গেল। আবার কে শোকের মাস পাব কেউ জানি না। কত তর্ক-বিতর্ক, কত আলোচনা-সমালোচনা। জাতির পিতার একক নেতৃত্ব নিয়ে কেউ কেউ সন্দেহ করায় জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী তাদের ইয়াহিয়ার ভাষণ শুনতে বলেছিলেন। মনে হয় তার যুক্তি ইয়াহিয়া সে সময় অন্য কারও নাম মুখে আনেননি, একমাত্র বঙ্গবন্ধুর কথাই বলেছেন, ‘এ যাত্রায় শেখ মুজিব আনপানিস্ট যাবেন না’ বলে হুমকি দিয়েছিলেন। এ তো খুব সত্য।
তখন বঙ্গবন্ধু ছাড়া বাংলার আকাশে-বাতাসে জোয়ার-ভাটায় কারও নাম ছিল না। আমরা সবাই ছিলাম বঙ্গবন্ধুর ছায়া। তিনি তখন একা কোথায়? যখন দেশ স্বাধীন হয়েছে তখন তিনি বাঙালি সত্তার সঙ্গে একাকার হয়ে গিয়েছিলেন। খুব বেশি মানুষ অমন জাতীয় সত্তায় মিশে যেতে পারেন না। ভারতের স্বাধীনতায় মহাত্মা গান্ধী, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই।
স্বার্থান্বেষীদের আজকাল পিতা নিয়ে প্রশ্ন জাগতে পারে। কিন্তু সেদিন কারও মনে কোনো প্রশ্ন ছিল না। চিলে কান নিয়েছে শুনে কানে হাত না দিয়ে চিলের পিছু ছোটা মানুষ আমি নই। তাই প্রধানমন্ত্রীকে বলছি, ভালো-মন্দে ইয়াহিয়ার কোনো উপমা ভালো লাগে না। তেমনি প্রধান বিচারপতির পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে অযোগ্য ঘোষণার উপমা আমরা পছন্দ করি না। তিনি কি বাংলাদেশেও তেমন করার চিন্তায় আছেন? না না। পাকিস্তানের বিচারালয়ের উপমা দিয়ে প্রধান বিচারপতি কোনো ভালো কাজ করেননি। যেভাবেই উপমা দিন উপমা উপমাই। তারও একটা স্থানকাল থাকে।
ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে সরকার এবং আওয়ামী লীগ যা করছে তার অনেক কিছুই দেশবাসী সমর্থন করে না, আমরাও করি না। কিন্তু তাই বলে প্রধান বিচারপতি পাকিস্তানের উপমা দিয়ে ঢেঁকুর তুলবেন, তাও অনাকাঙ্ক্ষিত। মনে হয় রায় নিয়ে এখন সরকারেরও কোনো আপত্তি নেই। যা কিছু আপত্তি নিরীক্ষণ নিয়ে। তার জন্য রিভিউর পথ তো খোলাই আছে।
পৃথিবীতে কেউ কখনো কোনো বিচারককে অবৈধ বলতে পারে জানা ছিল না। আমরা কোর্টকে বড় বেশি খেলো করে ফেললাম। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, আমাদের কোর্টগুলো কখনো-সখনো যথাযথ আচরণ করতে পারে না। দেশের মানুষ কোর্টের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেললে আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াব? সবকিছু যে অন্ধকারে তলিয়ে যাবে। তাই এখনো সময় আছে সাবধান হওয়ার।
সাধারণত আগস্ট মাস আমার জন্য ভালো নয়। কেমন যেন এলোমেলো লাগে। ১৫ তারিখ ধানমন্ডির ৩২-এ বোনদের মাঝেও কিছুটা এলোমেলো লেগেছে। দেখা হওয়ায় পক্ষে-বিপক্ষে ঝড় উঠেছে। ১৫ আগস্ট আমাদের জীবনে সবচেয়ে ভয়াবহ নির্মম দুর্ভাগ্যের দিন। জীবন তো চলেই গেল। পিতাকে পেয়েছিলাম ২৮ বছর, বাকি বছরগুলো তাকে ছাড়াই কাটিয়ে দিলাম। বিশুষ্ক মরুভূমির মতো জীবন বয়ে বেড়ালাম কত দিন। শান্তি নেই, স্বস্তি নেই, মুক্তি নেই। শুধু ঠেলাঠেলি।
একে অন্যকে ছোট করা, বশীভূত করার এক মহারণ। কেউ ন্যায়-অন্যায়ের বাচ-বিচার করে না। সুবিধার জন্য কেউ পিছে ফিরে তাকায় না। এ অবস্থায় সেদিন ২২ আগস্ট টুঙ্গিপাড়া পিতার কবরে গিয়েছিলাম। জোহরের নামাজ আদায় করতে চেয়েছিলাম টুঙ্গিপাড়ায়। যানজটের কারণে ঠিক সময় পৌঁছতে পারিনি। আসরের সময় পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন, দলীয় নেতা-কর্মী, জনসাধারণকে নিয়ে মোনাজাতের পর ছেলেকে নিয়ে পিতার পায়ের কাছে বসে দোয়া-দরুদ পাঠ করেছিলাম।
বার বার মনে হচ্ছিল, এখন ঢাকার দিকে রওনা হলে অর্ধেক রাত পথেই কেটে যাবে। তাই রাতটা পিতার পায়ের কাছে কাটিয়ে গেলে কেমন হয়। মেয়ে নিয়ে স্ত্রী বঙ্গবন্ধুর বৈঠকখানায় বসে ছিল। বৈকুণ্ঠ ছিল, নির্মল ছিল না। আমি গিয়ে বসতেই কী খাব, কী চাই নানান কথা। সাধ্যমতো যত্ন করার চেষ্টা করছিল। বলেছিলাম, কিছু দরকার নেই। স্ত্রীকে যেই বললাম ঢাকা ফিরতে অর্ধেক রাত হয়ে যাবে। আমি থেকে গেলে তোমার কোনো আপত্তি হবে? সাদামাটা স্ত্রী আমার, অনেক কিছুতেই আপত্তি করে না।
সঙ্গে সঙ্গে বলেছিল, ‘তোমার যদি মন চায় থেকে যাও। প্রয়োজন হলে আমরাও থাকি। তোমার যা ভালো লাগে তাই কর। আমাদের নিয়ে ভেবো না। আমরা সব সময় সব কাজে তোমার সঙ্গে আছি।’ কুশিমণির পরদিন স্কুল ছিল। তাই তার ঢাকা ফেরা দরকার। প্রায় সবাইকে পাঠিয়ে পিতার কবরে রাত কাটিয়েছিলাম। বড় আনন্দ পেয়েছি। পিতার কথা ভাবতে ভাবতে কোথা দিয়ে রাত কেটে গিয়েছিল। আজানের শব্দে উঠে বসেছিলাম। বহুদিন পর খাট-পালঙ্ক ছাড়া ফ্লোরে বড় ভালো লেগেছে।
কত বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। টুঙ্গিপাড়ায় পিতার সমাধি দেখাশোনার তেমন উন্নত ব্যবস্থা নেই। পাহারার ৩০-৩৫ জন পুলিশ। এ দেশে কেউ কাউকে সম্মান করে না। ভারতে রাজঘাটে মহাত্মা গান্ধীর সমাধি। কংগ্রেস, বিজেপি যারাই সরকারে আসুক সে সমাধির অমর্যাদা হয় না। পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর ত্রিমূর্তি ভবন কত সরকার এলো গেল কিন্তু সেই জাদুঘরের কোনো অমর্যাদা নেই। ১ নম্বর সফদর জংয়ের ইন্দিরা মিউজিয়ামে জনতা পার্টি বা নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রিত্বে কোনো অবহেলার ছাপ পড়েনি। কিন্তু আমাদের দেশে কি তেমন হবে?
অন্য কোনো সরকার এলে বঙ্গবন্ধুর সমাধি কি মর্যাদা পাবে? তেমন মনে হয় না। আমরা মারাত্মক পরশ্রীকাতর। কাউকে সম্মান করতে মর্যাদা দিতে আমাদের গা জ্বলে যায়। এত বছর বঙ্গবন্ধুর কন্যার সরকার এর পরও পিতার সমাধি যারা দেখাশোনা করে তারা স্থায়ী নয়। পাঁচ-ছয় জন পূর্ত মন্ত্রণালয়ের কর্মচারী আছে। কিন্তু যারা সমাধি দেখাশোনা করে, ঝাড়পোছ করে মো. আলভী মোল্লা, প্রদীপ কুমার দাস, সালমা খানম, সুজন কুমার দাস, বাপ্পি দাস, সঞ্জিত দাস, মো. জাকারিয়া, ববিতা মণ্ডল, মো. বদরুল, মো. টুটুল শেখ, দাউদ মোল্লা...।
তারা এখনো দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করে। তাদের চাকরির নিরাপত্তা নেই, কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই। খেতমজুরও যেটুকু সম্মান বা মর্যাদা পায় তাও তারা পায় না। ব্যাপারটা কে দেখবে? মনে হয় দেখার কেউ নেই।
সেদিন ঢাকা অফিসার্স ক্লাবে মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর আমার সঙ্গে নির্মলেন্দু গুণের টুঙ্গিপাড়ায় পিতার সমাধিতে যাওয়ার এক নিরীক্ষা এবং আরবি শিক্ষক আবদুল হালিমের আরবি কবিতার চমৎকার অনুবাদ পড়ে শুনিয়েছেন বা আবৃত্তি করেছেন। আসাদুজ্জামান নূর একজন জাত শিল্পী, আবৃত্তিকার। জীবনমঞ্চের চেয়ে অভিনয় মঞ্চেই তাকে ভালো মানায়। তার আবৃত্তি সবাইকে অভিভূত করেছে। অনেকেই মনে করেছেন এটা নূরেরই আলো। বেশ কয়েকবার আমার নাম আসায় অনেকে বিস্মিত, কেউ আবার আনন্দিত। অনেকেই ভাবে না, একসময় ছিল যখন আমি ছিলাম, আমরা ছিলাম।
এখন যারা পাদপ্রদীপের শিখায় জ্বলজ্বলে উজ্জ্বল, তারা লক্ষ যোজন দূরে ছিলেন। অনেকে আবার বড় বেশি বিরুদ্ধে ছিলেন। অফিসার্স ক্লাবের অনুষ্ঠান উচ্চমহলে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। সব দিকে নাড়া পড়ায় বাধ্য হয়ে ইউটিউবে দেখেছি। ঝকঝকে তকতকে ছবি, সাবলীল আবৃত্তি যা অনেকটা দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রদীপ ঘোষ বা বিপ্লবী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ছেলে সব্যসাচীর মতো। আসাদুজ্জামানের কণ্ঠের জাদু সবাইকে মোহিত করেছিল। নির্বাসনে থাকতে যখন তার কণ্ঠে সৈয়দ শামসুল হকের ‘নূরল দীনের সারা জীবন’ শুনতাম, শিহরিত হতাম। খুবই গর্ব হতো আমার দেশের এসব শিল্পীর জন্য।
সেদিন টুঙ্গিপাড়ায় পিতার কবরে পরিবারের বাইরে কর্নেল জামিলের নামে মোনাজাত করায় মৌলভিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কর্নেল জামিল কে? কেন পিতা-মাতার নিহত পরিবারের পাশে তার ছবি? কেন তার মুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা? কী করেছেন তিনি? বঙ্গবন্ধুকে উদ্ধার করতে গিয়ে যদি জীবন দিতেন আমি তার পায়ের জুতা মাথায় রাখতাম। কিন্তু তা তিনি করেননি। তাই আমার কাছে তার মৃত্যুর কোনো মূল্য নেই। বঙ্গবন্ধু যেদিন নিহত হন সেদিন বিপথগামীদের গুলিতে নিহত হয়েছেন সেজন্য তাকে সম্মান করব, নাকি অসম্মান?
আমি বা আমার পরিবার ১৫ আগস্ট কোনো অনুষ্ঠানে দাওয়াত পাই না। কিন্তু কর্নেল জামিলের পরিবার-পরিজন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যে কোনো সভা-সমিতি মিলাদ-মাহফিল বা অন্য যা কিছুই হয় অসম্ভব মর্যাদা পায়। মর্যাদার কাজ করলে মর্যাদা পাবে এটা জাতীয় কৃষ্টি, সভ্যতা, আল্লাহ-রসুল রাজি-খুশি হন। কিন্তু তেমন না করলে অযথা মর্যাদা দিলে সেটা অপাত্রে দান। পাঁচ-ছয় বছর আগে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে আমার স্ত্রী ঘেরাওয়ের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
এসএসএফের লোকেরা জামিলের স্ত্রী এবং মেয়ে বা ছেলেকে খুঁজে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিয়ে গেল। আমার স্ত্রী সেই ঘেরাওয়ের ভিতরে যেতে পারেনি। কিন্তু কেন? কর্নেল জামিল এমন কী করেছেন আর আমি এমন কী অন্যায় করেছি একটু ভেবে দেখা দরকার নয় কি? শতকরা ৯০ জন বঙ্গবন্ধুপ্রেমী মনে করেন কর্নেল জামিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে জীবন দিয়েছেন, কিন্তু তাকে ত্যাগ করেননি। ব্যাপারটা তেমন নয়।
কর্নেল জামিল যদি সাধারণ মানুষ হতেন, ছুটে গিয়ে ওভাবে জীবন দিতেন তাকে মাথায় তুলে রাখতাম। তিনি যদি একজন সাধারণ মিলিটারি অফিসার হতেন এবং ওই একই কাজ করতেন তাও তাকে মাথায় রাখতাম। কিন্তু কর্নেল জামিল তেমন ছিলেন না। তিনি রাষ্ট্রপতিকে রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার ছিলেন। মাত্র ১০-১৫ দিন আগে তাকে কর্নেল থেকে ব্রিগেডিয়ার করা হয়েছিল। তাকে গণভবনে ব্যাজ পরানোর সময় আমি ছিলাম।
গোয়েন্দা বাহিনী ডিজিএফআইর ডিজি ছিলেন তিনি। রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রপতিকে রক্ষার জন্য তাকে এক ব্রিগেড সৈন্য দেওয়া ছিল। যার এক ব্যাটালিয়ান গণভবনেই ছিল। যখন তখন ব্যবহারের জন্য তিনটি হেলিকপ্টার বরাদ্দ ছিল। যার একটা তখনো ছিল গণভবনে। ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন। তার বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার অনুষ্ঠান বানচাল করার জন্য হাসানুল হক ইনুর গণবাহিনীর ঢাকা মহানগরীর কমান্ডার অধ্যাপক আনোয়ারের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয় এবং পুরান ঢাকায় বোমা ফাটানো হয়েছিল। সবাই তটস্থ।
অনেকেই রাত জেগে ছিলেন আর গোয়েন্দাপ্রধান নাকে তেল দিয়ে ঘুমালেন— এটা তার সফলতা, নাকি ব্যর্থতা? আমি ভালো করলেও খারাপ। আমাকে এক ব্যাটালিয়ান ৭০০-৮০০ সৈন্য দিয়ে যদি বঙ্গবন্ধুর হেফাজতের দায়িত্ব দেওয়া হতো, আর আমি যদি ওই রকম ব্যর্থ হতাম আমাকে, আমার পরিবার-পরিজনকে এমন সম্মান দেখানো হতো? নাকি এখনকার মতো অবহেলা করা হতো? কোনো কোনো জিনিস কখনো কখনো খুবই বিরক্তিকর হয়ে ওঠে। সেদিনও ৩২-এ বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতির পাশ থেকে আমাদের সঙ্গে কথা বলে প্রধানমন্ত্রী চলে গেলে বা বিদায় নিলে কর্নেল জামিলের বোন বলছিলেন, ‘ভাই! আপনি জামিল সম্পর্কে অমন বললে আমাদের খুব কষ্ট হয়।’
তাকে কিছু বলিনি। তার কষ্ট হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু জামিল যে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন সেদিক থেকে ভাবলে কারও তেমন খুব একটা কষ্ট হওয়ার কথা নয়। বরং তখন মনে হবে পাকিস্তানফেরত কী কাপুরুষ, কী নির্বোধের হাতেই না পিতার হেফাজতের দায়িত্ব দিয়েছিলাম। আজ অনেকেই কথা ঘোরাতে পারে, কিন্তু কর্নেল জামিল যখন বঙ্গবন্ধুর ফোন পেয়ে হাফশার্ট গায়ে পাগলের মতো ছুটে বেরোচ্ছিলেন তখন তার স্ত্রী বলেছিলেন, ‘তুমি রিভলবারটাও নিলে না? একা গিয়ে কী করবে?’
আমারও সেই একই কথা। তার তো একা গিয়ে জীবন দেওয়ার কথা ছিল না, তার বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করার কথা ছিল। বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে গিয়ে কর্নেল জামিল জীবন দেননি। ঘাতকরা তাকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি যাওয়া নিয়ে গুলি করে উড়িয়ে দিয়েছে। অস্ত্র হাতে সিপাহিরা অনেক সময় মানুষ থাকে না। তারা যন্ত্রের মতো হয়ে যায়। তাদের বিচার-বিবেচনা করার সুযোগ থাকে না। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম করতে হয়। আবারও বলছি, ফারুক-রশীদ-ডালিমের ষড়যন্ত্র তার ব্যর্থ করা উচিত ছিল, ওসব তার আগেই জানা উচিত ছিল।
যখন ট্যাঙ্ক নিয়ে ফারুক-রশীদ-ডালিম আসছিল তখন যদি কর্নেল জামিল এক বা দুই ব্যাটালিয়ন সৈন্য নিয়ে বাধা দিয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের চুরমার করে দিতেন তাহলে মুক্তিযুদ্ধে আমি ছিলাম টাইগার, স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুকে রক্ষার জন্য তাকে না-হয় লায়ন বলা যেত। তাও যদি না পারতেন এক কোম্পানি সৈন্য নিয়ে বাধা দিতেন সান্ত্বনা পেতাম। বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করতে না পারলেও মনে কোনো খেদ থাকত না। কিন্তু পুরো বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন একজন কমান্ডার এভাবে চরম ব্যর্থ হয়ে উল্টো হিরো সাজবেন আর তা জেনেশুনেও কিছু বলব না— আল্লাহর কাছে কী জবাব দেব?
প্রায় ২৪ হাজার রক্ষীবাহিনী ছিল। তার ৬-৭ হাজার ঢাকাতেই ছিল। অত সুযোগ-সুবিধা থাকার পরও ফরিদপুরের মোল্লা আর টাঙ্গাইলের শহীদ একটা গুলিও ছোড়েনি, ছুড়তে সাহস করেনি। শেয়াল খোঁয়াড়ে মুরগি ধরতে গেলে মোরগ-মুরগি তবু কিছুটা কক কক করে সেটুকুও তারা করেনি বা করতে সাহস করেনি। তাদের আর যাই হোক দেশপ্রেমিক বীর বলে মেনে নিতে পারি না। মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম থাকলেই সবাই সাহসী হয় না। বরং ভীরুও হয়। এরা তার উজ্জ্বল প্রমাণ।
আমি ছিলাম, তাই একটা গুলি না ছুড়েও শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা। আমি রক্ত ঝরিয়েও ভদ্রলোকদের মন পেলাম না। কিছু না করে পিছু পিছু চলেই এরা সব মহাবীর হলো। জানি অনেকের বিশ্লেষণ অনেক রকম হবে। বঙ্গবন্ধুর হত্যার খবর পেয়ে আমিও ধানমন্ডি বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দু-তিন বাড়ির পশ্চিম পর্যন্ত উন্মাদের মতো ছুটে গিয়েছিলাম। এক ভদ্রলোক আমাকে টেনে-হিঁচড়ে তার ঘরে নিয়ে এক গ্লাস পানি খাওয়ালে কিছুটা চেতনা ফিরে পাই। আর বড়জোর ৬০-৭০ গজ গেলে বুলেট আমাকেও ঝাঁঝরা করে দিত।
তখন কি কেউ আমার কথা মনে করত? সব কেমন যেন কাল্পনিক হয়ে যাচ্ছে। শোক দিবসের অনুষ্ঠানে জাত শিল্পী আসাদুজ্জামান নূর নির্মলেন্দু গুণের লেখা দারুণ সুন্দরভাবে পাঠ করেছেন। তাতে আমার বোন প্রধানমন্ত্রীর চোখের পানি টসটস করে ঝরেছে। ছবিতে কতজনকে চোখ মুছতে দেখলাম। আবদুল হালিমের আরবি কবিতার কথা বলতে গিয়ে কবি শুধু আরবি শিক্ষক আবদুল হালিমকেই তুলে ধরেছেন।
শেখ আবদুল হাই, আলহাজ আবুল কাশেম, আবদুল মুকিত ফকির, গাজী ইমান উদ্দিন, হাজী কেরামত আলী, শেখ মো. ইদ্রিস, নাজীর মোল্লা, সোহরাব মাস্টার, শেখ নুরুল হক, গোলাম আলী মোল্লা, ইলিয়াস হোসেন সরদার, কাজী ইদ্রিস, কাজী আকবর, মুন্সী জর্জিস শেখ, তোতা মিয়া মুন্সী, শেখ আবদুল মান্নান, শেখ আয়ুব আলী এমনি ২১-২২ জন যারা একই ভূমিকা পালন করেছিলেন, বঙ্গবন্ধুকে কবর দিয়েছিলেন তারা বাদ পড়ে অন্ধকারে তলিয়ে গেছেন।
তাদের কথা একবারও আসেনি। আমরা ’৯৩-এর পর টুঙ্গিপাড়া শোক দিবস পালন করতে গিয়ে আবদুল হালিমকে পাইনি। আগেই পরপারে চলে গিয়েছিলেন। বাকি যারা ছিলেন তারাও প্রায় সবাই চলে যাচ্ছেন। কাজী ইদ্রিস, গোলাম আলী মোল্লা আর শেখ আয়ুব আলী এখনো বেঁচে থাকলেও কেউ তাদের খবর রাখে না। একসময় তারা কত বড় জাতীয় দায়িত্ব পালন করেছিলেন, কত বড় বীরের মতো কাজ করেছিলেন, কিন্তু আজ তাদের কোনো কদর নেই। -বিডি প্রতিদিন
লেখক : রাজনীতিক।
এমটিনিউজ/এসবি