নিউজ ডেস্ক : ২০১২ সালের মতো এবারও মিয়ানমারের ওপর চাপ না বাড়িয়ে রোহিঙ্গাদের জন্য সীমান্ত খুলে দেওয়ার চাপ দেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশকে। গতকাল মঙ্গলবার জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর রোহিঙ্গাদের জন্য সীমান্ত খুলে দিতে বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছে, তারাও সহায়তা নিয়ে পাশে দাঁড়াবে। আগের দিন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস একই আহ্বান জানিয়েছিলেন। তবে ঢাকায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, রোহিঙ্গা সমস্যার বিরূপ প্রভাব ইতিমধ্যে দেশে বড় মাত্রায় পড়েছে। তাই বাংলাদেশ নতুন করে আর রোহিঙ্গা শরণার্থী গ্রহণ করবে না। বাংলাদেশ জোর দিয়েই বলছে, রোহিঙ্গা সমস্যা মিয়ানমারের। সমাধান তাদেরকেই করতে হবে।
এর আগে ২০১২ সালেও জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশকে রোহিঙ্গাদের জন্য সীমান্ত খুলে দেওয়ার আহ্বান জানালে বাংলাদেশ তা প্রত্যাখ্যান করে।
তবে কূটনীতিকরা বলেছেন, রোহিঙ্গাদের মধ্যে যারা একবার মিয়ানমার ছেড়েছে তাদের ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। কারণ রোহিঙ্গাদের এখনো নিজেদের নাগরিক বলে স্বীকার করে না মিয়ানমার। রোহিঙ্গাদের নেই কোনো পরিচয়পত্র। তাই একবার মিয়ানমার ছাড়ার পর তাদের পরিচয় সংকট আরো তীব্র হবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিক বলেন, বাংলাদেশ সীমান্তে আসা যে শিশু এখন মিয়ানমারে তাদের বাড়ির ঠিকানা, পরিচয় বলতে পারে না, ভবিষ্যতে তার পরিচয় যাচাই করা কার্যত অসম্ভব। ২০০৫ সাল থেকে মিয়ানমার বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নেওয়া বন্ধ রেখেছে। কবে তা শুরু হবে বা আদৌ কোনো দিন তা সম্ভব হবে কি না, তা কেউ জানে না। বাংলাদেশে মিয়ানমারের রোহিঙ্গার সংখ্যা ইতিমধ্যে পাঁচ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এটি অনেক বড় একটি সমস্যা।
জেনেভায় ইউএনএইচসিআর গতকাল এক ব্রিফিংয়ে বলেছে, গতকালই তারা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে এবং শরণার্থীদের জন্য বাংলাদেশ সহযোগিতায় প্রস্তুত থাকার কথা বলেছে। ইউএনএইচসিআরের হিসাব অনুযায়ী, গত বৃহস্পতিবার থেকে রবিবার পর্যন্ত প্রায় পাঁচ হাজার ২০০ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। আরো কয়েক হাজার সীমান্তের মিয়ানমার অংশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। রাখাইন রাজ্যে সহিংসতার নিন্দা জানিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব যে বিবৃতি দিয়েছেন তার ওপর গুরুত্বারোপ করছে ইউএনএইচসিআর। সংস্থাটি বলেছে, ‘সীমান্তের কাছে বাংলাদেশ অংশে কিছু ব্যক্তিকে ঘিরে রাখা হয়েছে এবং বাকিরা কুতুপালং এলাকায় আছে। তাদের বেশির ভাগই নারী, শিশু ও বৃদ্ধ। তাদের মধ্যে আহত ব্যক্তিরাও আছে বলে খবর পাওয়া গেছে। ’ ইউএনএইচসিআর বলেছে, রোহিঙ্গাদের ঢুকতে বাধা দেওয়া হচ্ছে এমন বেশ কিছু ঘটনা তারা জেনেছে। এতে ওই ব্যক্তিদের জীবন চরম ঝুঁকিতে পড়েছে বলে সংস্থাটি মনে করে।
২০০৯ সালের আগস্ট থেকে ২০১৪ সালের জুলাই পর্যন্ত মিয়ানমারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মেজর জেনারেল (অব.) অনুপ কুমার চাকমা বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা একটি ‘আন-এন্ডিং’ সমস্যা। এর কোনো শেষ নেই। তিনি রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় যে পরিস্থিতি দেখেছিলেন এখনো তেমনই দেখছেন বলে মন্তব্য করেন।
জানা গেছে, ২০১২ সালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে রোহিঙ্গারা সীমান্তে ভিড় জমালে তাদের জন্য সীমান্ত খুলে দেওয়ার চাপ ছিল বাংলাদেশের ওপর। কিন্তু বাংলাদেশ সচেতন ও যৌক্তিকভাবেই সীমান্ত বন্ধ রেখেছে। ফলে রোহিঙ্গারা ঢুকতে না পেরে ফিরে গেছে। এরপর মিয়ানমারকেই সেখানে ‘আইডিপি ক্যাম্প’ (অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুতদের আশ্রয়শিবির) খুলতে হয়েছে। এর মাধ্যমে মিয়ানমারকে অন্তত মেনে নিতে হয়েছে যে ওই রোহিঙ্গারা তার দেশেই ছিল। কিন্তু ওই রোহিঙ্গারা সীমান্ত পেরিয়ে যদি বাংলাদেশে চলে আসত বা অন্যত্র চলে যেত তাহলে মিয়ানমারের ‘দমন নীতিই’ আরো সফল হতো।
গত অক্টোবর থেকে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গাদের ব্যাপক নিপীড়ন, নির্যাতন ও হত্যার খবরে বিশ্বজুড়ে সমালোচনা হয়। গত ১৭ মার্চ রাখাইন রাজ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে উদ্বেগ জানিয়ে একটি বিবৃতি দিতে চেয়েছিল জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ। কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের অন্যতম চীন ও রাশিয়ার আপত্তির কারণে তা সম্ভব হয়নি। এরপর ২৩ মার্চ জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়নের অভিযোগের আন্তর্জাতিক তদন্তের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার সময়ও চীন, ভারত ও কিউবা এর বিরোধিতা করেছিল। ওই প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর মিয়ানমার সরকার তা প্রত্যাখ্যান করে তদন্তদলকে মিয়ানমারে ঢুকতে না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এত কিছুর পরও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় দৃশ্যমান অগ্রগতি না থাকায় এ বছরের শুরুতে বাংলাদেশ ওই দেশটির ওপর চাপ বাড়াতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে সু চি তাঁর বিশেষ দূত পাঠিয়েছিলেন বাংলাদেশে। এরপর চীন গত এপ্রিলে এ বিষয়ে আলোচনার জন্য বিশেষ দূত হিসেবে সান গেসিয়াংকে ঢাকায় পাঠায়। বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় চীনের বিশেষ দূতের অবস্থান ছিল স্পষ্ট। চীনা বিশেষ দূত দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যা সমাধানের পক্ষে মত দেন। অর্থাৎ রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দ্বারস্থ হোক, তা চায় না চীন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার কারণে মিয়ানমারকে প্রভাবশালী দেশের অন্ধ সমর্থনও পরিস্থিতি জটিল করেছে। অতীতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অনেক প্রস্তাবে চীন ও রাশিয়া ‘ভেটো’ দিয়েছে।
তবে বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় আলোচনাগুলোতে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি তুলে ধরছে। ঢাকা সফররত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক ভারপ্রাপ্ত অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি এলিস ওয়েলসের সঙ্গে গতকাল মঙ্গলবার বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন চেয়েছেন। বৈঠকে এলিস ওয়েলসও রোহিঙ্গা পরিস্থিতিতে অত্যন্ত উদ্বেগজনক বলে অভিহিত করেছেন।
এমটিনিউজ২৪.কম/এইচএস/কেএস