নিউজ ডেস্ক : বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক স্মরণীয় দিন। ১লা সেপ্টেম্বর। ১৯৭৯ সালের এই দিনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের আদর্শে ও ১৯ দফার ভিত্তিতে গঠিত দলটি ভাঙা-গড়া আর উত্থান-পতনের মধ্যদিয়ে পার করেছে সুদীর্ঘ ৩৯ বছর।
আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে দেশের রাজনীতিতে মজবুত অবস্থান তৈরির পাশাপাশি চারবার রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করেছে এ দল।
রাজনীতি ও সরকার পরিচালনায় সাফল্য-ব্যর্থতা: ৩৯ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসে প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে প্রথমবার বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে বিএনপি। পরের তিনবার সরকার গঠনে নেতৃত্ব দিয়েছেন তারই সহধর্মিণী বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। প্রধান বিরোধী দলের দায়িত্ব পালন করেছে দু’বার।
বিএনপির নেতৃত্বে দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বহুদলীয় গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা, সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা। জিয়াউর রহমান সরকারের আমলে স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জন করে বিশ্বের বহু দেশের স্বীকৃতি ও সমর্থন। মধ্য প্রাচ্যে শ্রমবাজার সৃষ্টি ও দেশে গার্মেন্ট খাতের মাধ্যমে বেকারত্ব দূরীকরণ, কৃষিবিপ্লব, নারী শিক্ষার অগ্রগতিসহ অনেক কিছুই এসেছে দলটির হাত ধরে।
সরকার পরিচালনায় বিভিন্ন যুগান্তকারী পদক্ষেপের জন্য যেমন দলটির সুনাম রয়েছে তেমনি রেখেছে ব্যর্থতার বহু নজির। দুর্নীতি, সরকার পরিচালনায় অযোগ্যতা ও অদক্ষতা, অপশাসন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, জঙ্গিবাদের উত্থান ও দলীয় ক্যাডারদের দৌরাত্ব্যের বিষয়গুলো আলোচিত ছিল বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে।
ফলে জঙ্গিবাদী রাষ্ট্রসহ নানাভাবে যেমন বিশ্বের বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তেমনি রাজনৈতিক দল হিসেবে বিপর্যয় এবং নানা প্রশ্নের মুখে পড়েছে দলটি। বিচারপতিদের বয়স বাড়ানোসহ বিএনপির কিছু একগুঁয়েমি সিদ্ধান্তের কারণে পাল্টে যাওয়া পরিস্থিতিতে দেশে এসেছিল ওয়ান-ইলেভেন জামানা।
এ সময় কারাভোগ করতে হয় দলটির চেয়ারপারসনসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের। সবচেয়ে বড় মূল্য দিতে হয় তৃণমূল সম্মেলনের মাধ্যমে বিএনপির ভবিষ্যৎ কর্ণধার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া তারেক রহমানকে। শারীরিক, মানসিক নির্যাতনের পাশাপাশি তাকে বাধ্য করা হয় দেশত্যাগে। ওয়ান ইলেভেনে বিএনপি তো বটেই বিপর্যস্ত হয়েছিল দেশের সার্বিক রাজনীতি।
দুই বছর গুমোট সময় পেরিয়ে নবম জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। কিন্তু ওয়ান ইলেভেনের যে বিপর্যয় সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি বিএনপি। উল্টো দীর্ঘায়িত হয়েছে সে দুঃসময়। ওয়ান-ইলেভেনের সে সূত্র ধরে এখন প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিরুদ্ধে লড়াই করছে বিএনপি।
আন্দোলন-সংগ্রাম ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে কখনও জামায়াতে ইসলামী, কখনও হেফাজতে ইসলাম, কখনও বিডিআর বিদ্রোহ, আবার কখনও বিদেশি কূটনীতিবিদদের ওপর নির্ভর করে রাজনীতি করছে দলটি। কিন্তু বিপর্যয় উত্তরণে কার্যকর হয়নি সে পরনির্ভরতা। কিছু ভুল সিদ্ধান্ত দলটিকে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে খাদের কিনারে।
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে অটল থেকে শেষ পর্যন্ত বর্জন করেছে দশম জাতীয় নির্বাচন। সে নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি লক্ষণীয়ভাবে কম থাকলেও প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়নি দ্বিতীয় দফায় আওয়ামী লীগের সরকার গঠনে। উল্টো সংসদীয় রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়ে তারা। রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২০১৫ সালে।
একতরফা দশম নির্বাচনের বর্ষপূর্তির কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়েন চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। নিজের রাজনৈতিক কার্যালয়ে টানা প্রায় দুই মাস অবরুদ্ধ দিন কাটিয়েছেন তিনি। অবরুদ্ধ খালেদা জিয়ার ঘোষিত হরতালসহ অনির্দিষ্টকালের আন্দোলন কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সারা দেশে তৈরি হয়েছিল এক অরাজক পরিস্থিতি। যানবাহনে অগ্নিসংযোগসহ নানা ঘটনায় বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী হতাহত হয়েছেন।
কেন্দ্র থেকে তৃণমূল নেতাদের ওপর চেপে বসে মামলার পাহাড়। গ্রেপ্তার হন হাজার হাজার নেতাকর্মী। পরে অনির্দিষ্টকালের সে কর্মসূচিটি অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচিত হয় রাজনৈতিক মহলে। বিপুল ক্ষয়ক্ষতির পর কোনো ফলাফল ছাড়াই রাজপথের কর্মসূচি থেকে সরে আসে বিএনপি। এরপর প্রশাসনিক প্রতিবন্ধকতায় ঘরবন্দি হয়ে পড়ে দলটির রাজনীতি। অন্যদিকে জনগণের সমস্যা নিয়ে দীর্ঘ সময়েও সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয় দলটি।
তবে সমূহ বিপর্যয়ের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে ধীরে চলো নীতি নেয় বিএনপি। তারই প্রেক্ষিতে বিগত দুই বছর ধরে তারা রাজপথ উতপ্তকারী কর্মসূচি থেকে বিরত। এ ধীরে চলো নীতির ফলে সাংগঠনিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে দলটির সামনে। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের ফর্মুলা উত্থাপনের পর নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের ফর্মুলা উত্থাপনের ঘোষণা রয়েছে বিএনপির। তবে আগামী একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এখন পরিচালিত হচ্ছে দলটির সার্বিক কার্যক্রম।
রাজনীতিতে বিএনপির সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা বিবেচিত হয় সাংগঠনিক ক্ষেত্রে। দলে আদর্শবাদীদের চেয়ে প্রাধান্যবিস্তার করে রেখেছেন ভোগবাদীরা। ৩৯ বছরে নিজেদের ছাত্র ও যুবদল থেকে বেরিয়ে আসেনি জাতীয়তাবাদী আদর্শের দূরদর্শী ও জনপ্রিয় জাতীয় নেতৃত্ব। ছাত্রদল বা যুবদল থেকে সৃষ্ট নেতারাও জাতীয় রাজনীতিতে ভোগবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। দলটিতে একনিষ্ঠদের চেয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে রঙ বদলকারীদের। ত্যাগীরা অবমূল্যায়নের শিকার হয়েছেন বারবার।
দলটির নেতারা আত্মসমালোচনা করে বলছেন, ভূঁইফোড়, আমলা, সুবিধাবাদী ও নব্য জাতীয়তাবাদীদের প্রভাবেই চলছে দলটির রাজনীতি। বারবার বিপর্যয় ও বর্তমান ক্রান্তিকাল থেকে উত্তরণে ব্যর্থতার জন্যও নেতাদের আত্মোপলব্ধি হচ্ছে রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাব এবং সাংগঠনিক ব্যর্থতা। তবে ঢাকা মহানগর বিএনপিকে দুই ভাগ করে নতুনদের হাতে দায়িত্ব দিয়ে অনৈক্যের রেশ কাটিয়েছে অনেকটাই।
যদিও এখন পর্যন্ত বেশির ভাগ জেলা ও উপজেলায় রয়েছে পাল্টাপাল্টি কমিটি। একদিকে সিনিয়র নেতারা তাদের প্রভাব ধরে রাখতে গঠন করেন পকেট কমিটি অন্যদিকে অর্থসহ অনিয়মের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ পদ হাসিল করে নেন অযোগ্য নেতারা। সাম্প্রতিক সময়ে আরেকটি ইতিবাচক বিষয় হচ্ছে প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও দলের ষষ্ঠ কাউন্সিল করে ‘এক নেতা এক পদ’ নীতির মাধ্যমে অনেকটাই ফিরিয়ে এনেছে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা।
দলটির ৩৯ বছরের পথচলার ইতিহাসে আড়াই দশকই আন্দোলন-সংগ্রামের। বারবার ষড়যন্ত্রমূলক ভাঙা-গড়া ও উত্থান-পতনের শিকার হয়েছে বিএনপি। দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের নেতৃত্ব বাংলাদেশ যখন স্বনির্ভরতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল দ্রুত পদে তখনই একদল বিপথগামী সেনাসদস্যের হাতে নিহত হন তিনি। বাংলাদেশ পড়ে এক দীর্ঘমেয়াদি স্বৈরশাসনের কবলে।
স্বৈরাচার পরবর্তী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপির সরকারের আমলে দেশ যখন অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল তখন তাদের মোকাবিলা করতে হয় নৈরাজ্যময় পরিস্থিতি। খালেদা জিয়া সরকারের নেতৃত্বে দেশ যখন ইমার্জিং টাইগারে পরিণত হচ্ছিল তখনই শুরু হয় দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র। অব্যাহত নেতিবাচক প্রচারণার শিকার বিএনপিকে ক্ষমতা ছাড়ার পর নির্যাতন-নিপীড়নে চরম মূল্য দিতে হয় ওয়ান-ইলেভেনের সময়ে।
দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের শাহাদাত বরণের পর কৌশলে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আসেন এরশাদ। তার বিরুদ্ধে টানা নয় বছর আন্দোলন করে বিএনপি। কখনও একক, জোটের মাধ্যমে এগিয়ে নেয় সে আন্দোলন। যে আন্দোলনে অনঢ় মনোভাবের কারণে আপসহীন নেত্রীখ্যাত হন চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। পরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সপ্তম সংসদে আন্দোলন ছিলেন বিরোধী দলের ভূমিকায়।
ওয়ান-ইলেভেনের সেনা সমর্থিত সরকারের সময়ে সদ্য ক্ষমতা ত্যাগী হিসেবে নেতাকর্মীদের নির্যাতন সহ্য করার পাশাপাশি দলটি মেতে ছিল গণতন্ত্র পেরোনোর আন্দোলনে। মহাজোটের নেতৃত্বাধীন নবম ও দশম সংসদেও নির্দলীয় সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন আয়োজনের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি। আন্দোলন-সংগ্রামে বিএনপির একটি দর্শন হচ্ছে মৌলিক ইস্যুতে আপসহীন মনোভাব ধরে রাখা।
অতীতে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে এ আপসহীন মনোভাবই সাংগঠনিকভাবে একটি ভঙ্গুর ও অগোছালো বিএনপিকে ক্ষমতায় এনেছিল জনগণ। যা ছিল বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি তাৎপর্যময় ঘটনা। ওয়ান-ইলেভেনের সরকারের বিরুদ্ধে দেশত্যাগ অস্বীকৃতি এবং নির্বাচন আদায়ে আপসহীন মনোভাবই জিতিয়েছে বিএনপির রাজনীতিকে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় আপসহীন মনোভাবটা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে দশম জাতীয় নির্বাচন বর্জনের মধ্যদিয়ে।
রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে বিভিন্ন পথ ও মতের ঐক্যের একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা। দীর্ঘদিন থেকেই বাংলাদেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি রাজনৈতিক দল একটি বিএনপি। দেশের মোট জনসংখ্যা একটি বড় অংশের সমর্থন আদায় করে নিয়েছে দলটি। বিগত কয়েকটি জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল বিবেচনা করলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়।
ভাঙা-গড়ার খেলাটি যেকোনো রাজনৈতিক দলের ব্যর্থতা ও ষড়যন্ত্রের যৌথ রসায়ন। রাজনৈতিক ইতিহাসে ষড়যন্ত্রের ভেতর দিয়েই শুরু হয় বিএনপির ভাঙা-গড়ার খেলা। জিয়াউর রহমানের জাগদল ও বিএনপিতে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে ছিলেন বহুদলীয় ও বহুমতের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। সেই সঙ্গে রাজনীতি সচেতন বিদগ্ধজনদের সমাবেশ।
জিয়াউর রহমানের সময়ে তাদের দুয়েকজন নানা কারণে পদত্যাগ করেন। জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর ষড়যন্ত্রকারী ইঁদুর কাটতে থাকে বিএনপির ঐক্যের জাল। ’৮৩ সালে প্রথম ভাঙন ঘটান শামসুল হুদা চৌধুরী ও ডা. মতিন। ’৮৫-র নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভাঙনের নেতৃত্ব দেন জিয়া সরকারের প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজ।
তারপর বিভিন্ন সময়ে দল ছেড়ে যান কাজী জাফর, সিরাজুল হোসেন খান, আনোয়ার জাহিদ, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, মাঈদুল ইসলাম, আবদুল আলিম, সুলতান আহমেদ চৌধুরী, আতাউর রহমান খান, জাফর ইমাম, ওবায়দুর রহমান, জামালউদ্দিন আহমেদ, ব্যারিস্টার আবুল হাসনাতসহ অনেক ছাত্রদল ও যুবদল নেতা। যাদের অনেকেই পরে ফিরে আসেন বিএনপির ছায়াতলে।
তবে বিএনপির সবচেয়ে বড় ধরনের ভাঙনটি ঘটে অষ্টম সংসদ ও ওয়ান-ইলেভেনের সময়। রাজনৈতিক মতদ্বৈততাকে কেন্দ্র করে দলের প্রতিষ্ঠাকালীন মহাসচিব প্রফেসর ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও স্থায়ী কমিটির সদস্য কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীরবিক্রমের মতো সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে দল ছাড়েন অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা।
সর্বশেষ ওয়ান-ইলেভেনের সময় দলের দীর্ঘদিনের মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে দলের একটি সংস্কারপন্থি গ্রুপ আলাদা তৎপরতা চালায়। পরে তাদের অনেকেই দলে ফিরলেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নেতা হয়ে পড়েছেন নিষ্ক্রিয়। এসবের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠাকালীন বহু প্রভাবশালী ও সম্ভাবনাময় নেতা বিভিন্ন সময়ে বিএনপি ছেড়েছেন। দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা বারবার ভাঙা-গড়ার খেলায় জড়িত হলেও তৃণমূল নেতৃত্ব ছিল সবসময় ঐক্যবদ্ধ।
যেভাবে বিএনপির জন্ম: ’৭৫-এর পটপরিবর্তন পরবর্তী তিন মাস ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে অস্থির-অনিশ্চয়তাময় এক ঘোর অমানিশা। হতাশায় বিপর্যস্ত মানুষ সিপাহী-জনতার বিপ্লবের নামে নতুন প্রত্যয়ের প্রকাশ ঘটিয়ে নিজেদের নেতা নির্বাচন করেন জিয়াউর রহমানকে। ঘটনা পরম্পরায় তিনি হয়ে উঠেন এক অনিবার্য চরিত্র। বাংলাদেশের সিপাহি-জনতা সেদিন ঘোর অমানিশায় কারাবন্দি সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে আসীন করেন সেনাপ্রধানের দায়িত্বে।
’৭৫-এর ১০ই নভেম্বর প্রেসিডেন্ট সায়েম সরকার গঠিত হলে সেনাপ্রধানের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান জিয়াউর রহমান। বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে সেদিনটিই ছিল মূলত ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁকবদল। সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান ধীরে ধীরে প্রকাশ করতে থাকেন তার রাজনৈতিক ভাবনা।
১৯৭৬ সালে খুলনা, কুমিল্লা ও সিলেট স্টেডিয়ামের জনসভায় তিনি বলেন, ‘পার্টিতে পার্টিতে, গ্রুপে গ্রুপে অতীতের সকল পার্থক্য ভুলে দেশের প্রগতির জন্য ‘বাংলাদেশি’ রূপে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।’ ১লা মে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মে দিবসের শ্রমিক সমাবেশের বক্তব্যে তার জাতীয়তাবাদের দর্শন স্পষ্ট করেন। চীনের সমর্থনের মাধ্যমে তিনি আন্তর্জাতিক বিশ্বের সমর্থন ও সম্পর্ক গড়ে তোলেন।
মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্রপ্রধান ও দেশে শ্রমিক, মুক্তিযোদ্ধাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে বৈঠক করে দেশের মানুষকে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও মৌলিক ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ করার মাধ্যমে নিজের রাজনৈতিক অবস্থান তৈরি করেন। ’৭৭-এর ২১শে এপ্র্রিল ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে প্রেসিডেন্ট সায়েম দায়িত্ব ছেড়ে জিয়াউর রহমানকেই মনোনীত করেন নতুন কর্ণধার।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কর্ণধার মনোনীত হয়ে জিয়াউর রহমান ‘স্বনির্ভর বাংলাদেশ’ গড়ার প্রত্যয়ে ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা দেন। সে কর্মসূচির প্রতি দেশবাসীর মতামত যাচাইয়ে দেন গণভোট। দেশবাসীর বিপুল আস্থা নিয়ে তিনি গঠন করেন সরকার। দূরদর্শী জিয়াউর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন ক্ষমতার চেয়ে সংগঠিত রাজনৈতিক শক্তিই বেশি ক্ষমতাবান। ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’ এ অভিজ্ঞান থেকে তিনি একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরির উদ্যোগ নেন।
সেই সঙ্গে গুরুত্ব আরোপ করেন বৈদেশিক সম্পর্কে। তারই প্রেক্ষিতে বিচারপতি সাত্তারকে আহ্বায়ক করে ’৭৮-এর ২২শে ফেব্রুয়ারি গঠন করেন জাতীয়তাবাদী গণতন্ত্রী দল (জাগদল)। মে মাসে জিয়াউর রহমানকে চেয়ারম্যান করে ন্যাপ (ভাসানী), ইউপিপি, মুসলিম লীগ, লেবার পার্টি ও তফশিলি জাতীয় ফেডারেশনের সমন্বয়ে জাগদল রূপান্তরিত হয় ‘জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট’-এ।
সে বছরই আনুষ্ঠানিক নির্বাচনে ওসমানীকে পরাজিত করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন জিয়াউর রহমান। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি সময় বিএনপি গঠনের এ প্রাকপ্রস্তুতি পর্ব। ১লা সেপ্টেম্বর ১৯৭৯। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির আনুষ্ঠানিক জন্মদিন। জাগদলের আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তির মাধ্যমে রাজধানী ঢাকার প্রাণকেন্দ্র রমনা পার্কের খোলা চত্বরে ১৯ দফার ভিত্তিতে ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)’ নামে প্রেসিডেন্ট জিয়া নতুন রাজনৈতিক দলের ঘোষণা দেন।
এর রাজনৈতিক দর্শন ছিল বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। জিয়াউর রহমানকে আহ্বায়ক করে গঠিত বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম কলেবর ছিল ৭৬। যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৯৬ জনে। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে কতটুকু সফল ও সম্প্রসারিত হয়েছে বিএনপি?
দেশে একদিকে বন্যাপরিস্থিতি অন্যদিকে পবিত্র ঈদুল আজহা। এবার এমনই এক সময়ে এসেছে প্রতিষ্ঠার দিনটি। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর পরদিন ঈদুল আজহা হওয়ায় এবার বড় কোনো কর্মসূচি থাকছে না। বন্যাদুর্গত এলাকায় ত্রাণ বিতরণ ও অন্যান্য এলাকায় সীমিত পরিসরে দিনটি উদযাপন করবে বিএনপি। ঈদের পর কেন্দ্রীয়ভাবে আলোচনা সভাসহ অন্যান্য কর্মসূচি পালন করবে। -এমজমিন
এমটিনিউজ/এসবি