রেজাবুদ্দৌলা চৌধুরী : জাতীয় প্রয়োজনে যেমনি জিয়াউর রহমানের আবির্ভাব হয়েছিল তেমনি রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণে বিএনপির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল—প্রথমে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের সমন্বয়ে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট (জাগো-ফ্রন্ট) এবং পরে তাকে একটি পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক দলে রূপ দেওয়া হয়, ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর।
বিএনপি প্রতিষ্ঠা তখন অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। কারণ, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জিয়াউর রহমান অসহায় ও দিশাহারা জাতিকে একটা মুক্তির পথ দেখাতে চেয়েছিলেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রথম সরকার পরিচালনাকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ (বাকশালের কারণে তখনো বিলুপ্ত) ‘নেতৃত্বশূন্য’ ও ‘ছ্যাড়াব্যাড়া’ দশায়।
বাকশাল ব্যবস্থার ফলে আওয়ামী লীগের পুরনো নেতারা অসংগঠিত হয়ে পড়েছিলেন, কেউ কেউ হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিলেন এবং বাকশাল ব্যবস্থায় প্রধান শক্তিগুলোর অন্যতম কমিউনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশ (সিপিবি) আর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ/মোজাফফর) তখন অসংগঠিত, ভাসানী ন্যাপের নেতা-কর্মীরা নানা দল-উপদলে বিভক্ত, তারাও চরম অসংগঠিত।
আর প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার স্বাপ্নিক কল্পনায় ভেসে তথাকথিত বিপ্লব সম্পাদনের দিবাস্বপ্নে বিভোর ছিল, তারা তখনো আন্ডারগ্রাউন্ডে সক্রিয় ছিল। সেরকম পরিস্থিতিতে সামরিক শাসনের মধ্য থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের লক্ষ্যে জিয়াউর রহমান প্রথমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করলেন এবং গণভোটে নিজে নির্বাচিত হলেন, সেটা ১৯৭৮ সালে।
এরই মধ্যে তিনি জা.গ দল (জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল), ভাসানী ন্যাপের নেতাদের, জাসদের একাংশ, আওয়ামী লীগ ও ডেমোক্রেটিক লীগের এবং ইউনাইটেড পিপলস পার্টির (ইউপিপি) নেতা ও সংগঠকদের তফসিল ফেডারেশন, লেবার পার্টি ও বিলুপ্ত মুসলিম লীগের সংগঠক-নেতাদের অংশবিশেষকে নিয়ে নতুন দল বিএনপি গড়ে তোলার চেষ্টা চালাতে থাকেন। তিনি অবশ্য ১৯৭৬ সাল থেকেই সেই চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন।
পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার এক বিপ্লবী অভ্যুত্থানে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান জনগণ কর্তৃক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। তিনি পরের বছর সাধারণ নির্বাচন দিয়ে নিজেকে সেনা-ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু অচিরেই দেখা গেল, বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির সামরিক বাহিনীর ও জাতীয় প্রশাসন-ব্যবস্থার ভিতরে নৈরাজ্য এবং জনগণের মধ্যে এক অনিশ্চয়তার রাজত্ব কায়েম হয়ে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো এবং তা থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসা সম্ভব হচ্ছিল না।
দীর্ঘ আন্দোলনের মধ্যদিয়ে গড়ে ওঠা আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ হিসেবে বিএনপি কীভাবে একটা জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলের অবস্থান লাভ করল তার যুক্তিগ্রাহ্য কারণ ছিল যথেষ্ট। বিএনপি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে আমাদের জনগণের সঠিক আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পায়; সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ সংযোজনের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনসংখ্যার ধর্মবোধ ধারণ করে, আর বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণ-ভাষা ও সংস্কৃতির এবং ক্ষুদ্র সব নৃ-গোষ্ঠীর মেলবন্ধন রচনার মধ্যদিয়ে জাতীয় ঐক্যের সংহত রূপ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার প্রক্রিয়ায় তাকে সমন্বিত করার পথে এগিয়ে যায়।
জিয়াউর রহমানের মূল লক্ষ্য ছিল ভূ-রাজনৈতিক কারণে প্রতিবেশী দেশের আধিপত্যবাদী আগ্রাসনের বিপক্ষে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দল গড়ে তোলা। যে দল ভারত তোষণ নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নিজ দেশের মানুষের প্রকৃত জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটাবে এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল চেতনার ধারক-বাহক হয়ে কাজ করবে। জাসদের গণবাহিনী ও সর্বহারা পার্টিসহ বিভিন্ন আন্ডার গ্রাউন্ড বাম দল সশস্ত্র তৎপরতার মাধ্যমে দেশে অগণতান্ত্রিক নৈরাজ্যময় দশা তৈরি করে যাচ্ছিল। সেই অপতৎপরতা জিয়াউর রহমান সাফল্যের সঙ্গে সামাল দিয়েছিলেন।
সেই পরিস্থিতিতে দেশে একটি সুস্থ রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরুর চেষ্টা চালান জিয়াউর রহমান। বলা চলে, তার ওপর সে দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয়। রাষ্ট্রকে সমমর্যাদায় টিকিয়ে রাখা ও দেশবাসীকে একটা সুষ্ঠু সরকার ব্যবস্থা ও প্রশাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে নিশ্চিত নৈরাজ্যময় সংকট থেকে রক্ষার জন্য, একটা সবল অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার জন্য। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় বসেন ১৯৭৮ সালে। এরপর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের রাজনীতির দর্শনের ওপর তিনি দেশের মূল ধারার রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস পান।
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নাগরিকদের জাতীয়তার আসল পরিচয় তিনি তুলে ধরলেন ‘বাংলাদেশি’ জাতি হিসেবে। তিনি ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (ইংরেজিতে ‘বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি’, সংক্ষেপে ‘বিএনপি’) প্রতিষ্ঠা করেন। এর আগে ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ধরে দুই বছর নয় মাস তিনি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও জনগণের চাহিদা নিয়ে টানা রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে এসেছেন, সেসবের চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন।
বাইরের দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়ন করে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি পরিচ্ছন্ন করেছেন। তিনি দেশব্যাপী স্বেচ্ছাশ্রমে খালকাটা কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে নদ-নদীর নাব্য বৃদ্ধির মাধ্যমে সেচকাজ সুচারুকরণ ও বন্যা প্রতিরোধে উদ্যোগ গ্রহণ করেন, যা ছিল তার উদ্যমী কর্মকাণ্ডের চমৎকার এক উদাহরণ।
একাত্তর সালের ২৬ মার্চ কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে যে মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর পক্ষে, সেই জিয়াউর রহমানের কাছে দায়িত্ব এলো রাষ্ট্র-প্রশাসন পরিচালনার পঁচাত্তর সালের ৭ নভেম্বর। আমাদের জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও ভবিষ্যৎ নির্মাণ উভয় প্রক্রিয়ায়ই জিয়াউর রহমান অপরিহার্য হয়ে ওঠেন তার নিজেরই অজান্তে। ইতিহাস তাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই।
বিএনপি প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে জিয়াউর রহমান শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের রূপরেখা দেন : ১. জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সুসংহত করা; ২. কৃষি সংস্কার; ৩. শিক্ষা সংস্কার; ৪. পরিবার পরিকল্পনা; ৫. শিল্প উৎপাদন এবং বিদ্যুতায়ন; ৬. সমাজ সংস্কার; ৭. প্রশাসনিক সংস্কার ; ৮. ধর্ম; ৯. আইন সংস্কার; ১০. শ্রম আইন সংস্কার; ১১. নারী-পুরুষ নির্বিশেষে জনশক্তি উন্নয়ন; ১২. খনিজ তথা সব প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ; ১৩. সংস্কৃতির বিকাশ সাধন ও ১৪. বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উন্নয়ন। এগুলো থেকেই তিনি বিএনপির ১৯ দফা কর্মসূচি প্রণয়ন করেন এবং সেসব বাস্তবায়ন শুরু করেন। ১৯ দফা বস্তুত, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের রাজনীতির মূল দর্শন। ১. সর্বতোভাবে দেশের স্বাধীনতা, অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। ২. শাসনতন্ত্রের চারটি মূল নীতি অর্থাৎ সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায় বিচারের সমাজতন্ত্র জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে প্রতিফলন করা। বিডি প্রতিদিন
লেখক : বিএনপির সাবেক তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক।
এমটিনিউজ/এসবি