রবিবার, ০৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ০১:০৩:১৪

রোহিঙ্গা মুসলিম নিয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনী কী ভাবছে?

রোহিঙ্গা মুসলিম নিয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনী কী ভাবছে?

নিউজ ডেস্ক: গত এক সপ্তাহে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ২৬০০ বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে৷ শনিবার এ তথ্য জানিয়েছে মিয়ানমার সরকার৷ গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ এই সহিংসতায় এখন পর্যন্ত চারশ'রও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে৷

জাতিসঙ্ঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে, গত এক সপ্তাহে বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে ৫৮ হাজার রোহিঙ্গা৷ মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের অভিযোগ আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা এআরএসএ রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে৷ তবে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা বলছেন, সেখানকার সেনাবাহিনী তাদের সেখান থেকে তাড়িয়ে দিতেই বাড়িঘরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে, নির্বাচরে হত্যা করছে রোহিঙ্গাদের৷ রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম বলছে, ‘‘তিনটি গ্রামের ২৬২৫টি বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে জঙ্গি গোষ্ঠী এআরএসএ''৷

মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ছবি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মিয়ানমার সেনাবাহিনী বাড়িগুলোতে আগুন লাগিয়েছে৷

বাংলাদেশের নাফ নদীর পাশে শরণার্থী শিবিরে গাদাগাদি করে আশ্রয় নিয়েছেন রোহিঙ্গারা৷ স্থানীয়দের অনেকে দয়াপরবশ হয়ে নিজেদের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন কয়েকজনকে৷ ইউএনএইচসিআর এর স্থানীয় মুখপাত্র জানিয়েছেন, সেখানে যে কয়টি শরণার্থী শিবির রয়েছে তাতে আর তিল পরিমাণ জায়গা নেই৷

শুক্রবার শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন ৬০ বছরের বৃদ্ধ জালাল আহমেদ৷ যিনি জানালেন, ‘‘২০০ মানুষ নিয়ে সেনাবাহিনীর সদস্যরা এসে তাদের গ্রামে চড়াও হয় এবং বাড়িঘর সবকিছুতে আগুন ধরিয়ে দেয়৷ আমরা যদি ফিরে যাই, দেখামাত্র আমাদের গুলি করবে সেনাবাহিনী৷''

মিয়ানমারের সেনা প্রধান বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, ‘‘রাখাইনে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বজায় রাখতে তারা একটি ফ্রেমওয়ার্ক অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছেন৷ ‘বাঙালি সমস্যা' একটা দীর্ঘদিনের সমস্যা, যেটা সমাধান হওয়ার সম্ভাবনা নেই৷''

এদিকে, রাখাইনে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ডাব্লিউএফপি সহ অনেক দাতা সংস্থা কাজ করছিল, যারা সহিংসতা শুরু হওয়ার পর তাদের কাজ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছেন৷ মিয়ানমারে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক মুখপাত্র জানালেন, ‘‘মাংদোতে শিশুরা এমনিতেই অপুষ্টিতে ভুগছিল, তাদের জন্য জরুরি খাদ্য দরকার ছিল৷ কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের কোনোরকম খাদ্য সহায়তা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না৷''

রাখাইনের উত্তরাঞ্চলে ৮০ হাজারেরও বেশি শিশু অপুষ্টিতে ভুগছিল, যাদের চিকিৎসা প্রয়োজন বলে জুলাইতে রিপোর্ট করেছিল ডাব্লিউএফপি৷ এছাড়া যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে তাদের মধ্যে অনেক নারী অন্তঃসত্ত্বা, অনেকে সেখানে গিয়ে কেবল সন্তান জন্ম দিয়েছে, কারো একেবারে ছোট সন্তান রয়েছে, তাদের অবিলম্বে খাদ্য সহায়তা না দিলে বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি৷

এদিকে, শুক্রবার রাতে এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আকাশসীমা লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে তাদের সতর্ক করে দিয়েছে৷ আকাশসীমা লঙ্ঘন করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার ঢুকে পড়ার ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ৷ গত ২৭ ও ২৮ আগস্ট এবং শুক্রবার মিয়ানমারের কয়েকটি হেলিকপ্টার আকাশসীমা লঙ্ঘন করে বাংলাদেশে প্রবেশ করে৷

৮ দিনে বাংলাদেশে এসেছে ৬০ হাজার রোহিঙ্গা

এদিকে জাতিসঙ্ঘের উদ্ধতি দিয়ে বিবিসি জানিয়েছে, মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে গত আট দিনে সহিংসতার কারণে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা মুসলিমদের সংখ্যা প্রায় ৬০ হাজারে পৌঁছেছে।

জাতিসঙ্ঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার বা ইউএনএইচসিআর এর কর্মকর্তা ভিভিয়ান ট্যান বলেছেন, যে ভাবে লোক আসছে তাতে আর কয়েক দিনেই সীমান্তে যে শিবিরটি আছে তা পুরো ভরে যাবে।

রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে উদ্বেগ প্রকাশ করে জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব আন্তনিও গুটেরেস সেখানে একটি মানবিক দুর্যোগ তৈরি হতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী গত সপ্তাহে সন্দেহভাজন রোহিঙ্গা জঙ্গীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে, কিন্তু বাংলাদেশে পালিয়ে আসা লোকেরা বলছে, সৈন্যরা তাদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে এবং তাদের ওপর গুলি চালিয়েছে। মিয়ানমারের সরকার এসব অভিযোগ অস্বীকার করছে।

মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আজ বলেছে, সেখানে কেবল একটি রোহিঙ্গা গ্রামেই সাতশো বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে বলে তারা স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবিতে দেখতে পাচ্ছে।

এর আগে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়িপ এরদোয়ান যেভাবে রোহিঙ্গা মুসলিমদের হত্যা করা হচ্ছে তাকে রীতিমত গণহত্যা বলে বর্ণনা করেন।

সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারা বলছেন, এখনো প্রতিদিনই হাজার হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশ পালিয়ে যাচ্ছে। জাতিসঙ্ঘের সর্বশেষ হিসেবে আজকে পর্যন্ত ৫৮ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে।
যদিও বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বিজিবি এবং কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, রোহিঙ্গারা যাতে বাংলাদেশে ঢুকতে না পারে, সেজন্য তারা সীমান্তে তৎপর রয়েছেন। কিন্তু গত দু'দিন ধরে সীমান্তে কিছুটা শিথিলতা দেখানো হচ্ছে বলে সূত্রগুলো অনানুষ্ঠানিকভাবে বলছে।

প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম বলছিলেন, একেবারে দুস্থ মহিলা এবং শিশুদের জন্য কিছু ক্ষেত্রে মানবিক দিক বিবেচনা করা হচ্ছে।

"আমরা তাদের ফিরিয়ে দিচ্ছি। ফিরিয়ে দেয়ার পরও মানবিক দিক বিবেচনা করে যারা নিতান্তই অসুস্থ বা বৃদ্ধ মহিলা, শিশু এবং বেশ কিছু আহত, তাদেরকে তো আমাদের আশ্রয়, খাদ্য, চিকিৎসা, এগুলো না দিলেই নয়। এটা আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আগেও বলেছেন, এখনো আমরা সেটা দিযে চলেছি।"

এইচ টি ইমাম আরও বলেছেন, "মিয়ানমারের অভ্যন্তরে যারা এই আক্রমণের শিকার,তাদের নিরাপত্তা দিতে হলে মিয়ানমারের মধ্যেই দিতে হবে। এটা আন্তর্জাতিক রেড ক্রসই করতে পারে।"

হাজার হাজার শরণার্থী বাংলাদেশে ঢুকে আশ্রয় এবং খাবারের জন্য চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে।
কক্সবাজার থেকে রেড ক্রিসেন্ট এর সহকারি পরিচালক সেলিম আহমেদ বলছিলেন, গত ২৫ শে অগাষ্ট মিয়ানমারে সংঘাত শুরুর পর পরই রোহিঙ্গা যারা বাংলাদেশে ঢুকেছে, তাদের বেশির ভাগই উখিয়ার কুতুপালং এ নিবন্ধিত এবং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে।

রোহিঙ্গা গ্রামের ৭০০ বাড়িতে আগুন

মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, মিয়ানমার থেকে পাওয়া নতুন উপগ্রহ-চিত্রে দেখা যাচ্ছে যে একটি রোহিঙ্গা মুসলিম গ্রামের ৭০০-রও বেশি বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

সংস্থাটি বলছে, এসব ছবি গভীরভাবে উদ্বেগজনক, এবং এতে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে যে রাখাইন প্রদেশের উত্তরাঞ্চলে ধ্বংসলীলার মাত্রা আসলে আগে যা ভাবা হয়েছিল তার চাইতে অনেক বেশি।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং সন্দেহভাজন রোহিঙ্গা জঙ্গীদের মধ্যে সংঘর্ষের পর গত সপ্তাহে হাজার হাজার সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিম সীমান্ত পেরিয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশে ঢুকেছে।

পালিয়ে আসা এই শরণার্থীরা বলছে, মিয়ানমারের সৈন্যরা তাদের বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।

তবে মিয়ানমারের সরকার এ কথা অস্বীকার করেছে। সরকার বলছে, তাদের নিরাপত্তা বাহিনী গত মাসে ঘটা একটি আক্রমণের মোকাবিলা করছে - যাতে রোহিঙ্গা জঙ্গীদের হাতে ২০টি পুলিশ ফাঁড়ি আক্রান্ত হয়েছিল।

জাতিসংঘের অনুমান অনুযায়ী এ পর্যন্ত ৫৮ হাজার শরণার্থী বাংলাদেশে ঢুকেছে। অন্য আরো প্রায় ২০ হাজার লোক সীমান্ত এলাকায় নাফ নদীর তীর বরাবর আটকে রয়েছে।

মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর অফিস বলছে, রাখাইন রাজ্যের সহিংসতায় এ পর্যন্ত ৪০০ লোক নিহত হয়েছে - যার অধিকাংশই রোহিঙ্গা মুসলিম।
এমটিনিউজ২৪.কম/টিটি/পিএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে