ঢাকা : মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বর গণহত্যা চালাচ্ছে রাষ্ট্রীয় বাহিনী। তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হচ্ছে। জীবন বাঁচাতে স্রোতের মতো রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ প্রবেশ করছে বাংলাদেশে।
মিয়ানমার বাহিনীর হামলায় তাদের কেউ আহত, কেউ পঙ্গু। প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা নতুন করে কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়েছে। খাদ্য, পানি আর চিকিৎসার জন্য সেখানে চলছে বিপন্ন রোহিঙ্গাদের হাহাকার।
এমন পরিস্থিতিতে রাজধানীতে সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হয়েছিল। নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ এ ইস্যুতে তাদের ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন যা পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-
একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার শিক্ষক বুরহান উদ্দিন ফয়সাল বলেন, ‘মগের মুল্লুক’ যে কথাটি এতদিন ধরে শুনে আসছিলাম তার সার্থক রূপ মিয়ানমারের বৌদ্ধ সন্ত্রাসীরা। রোহিঙ্গারা আরাকান বা রাখাইনের বহু বছরের পুরনো জনগোষ্ঠী।
১০৪৪ সালে কট্টর বৌদ্ধ বর্মী রাজা ‘আনাওহতা’ মগদের বার্মার অন্য অঞ্চল থেকে এনে রোহিঙ্গাদের আবাসভূমিতে বৌদ্ধ বসতি স্থাপন করায়। ১৭৮৪ সালে তৎকালীন বর্মী রাজা আরাকান দখলের পর থেকে এ জনগোষ্ঠী মানুষের দীর্ঘ বিড়ম্বনা শুরু হয়। এর একমাত্র কারণ তারা মুসলিম।
তিনি কয়েকটি প্রশ্ন রেখে বলেন, সুদান বা পূর্ব তিমুরে জাতিসংঘ যা করেছে মিয়ানমারে সে ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেয় না কেন? রোহিঙ্গাদের রক্ত তাহলে সাদা না হলুদ? তারা কি মায়ের পেট থেকে আসেনি? কেন তাহলে জাতিসংঘ সন্ত্রাসী রাষ্ট্র মিয়ানমারে শান্তিরক্ষী পাঠায় না? ওআইসি বা ক্ষমতাধর দেশগুলো কেন মিয়ানমারকে বয়কট করে না?
তুরস্ক বা মালয়েশিয়া এমনকি মালদ্বীপ বিক্ষিপ্তভাবে যা করছে তা যদি সংঘবদ্ধভাবে করতে পারতো তাহলে ভালো হতো। সেদিনের অপেক্ষায় যেদিন ওআইসি নেতারা একসুরে রাখাইনে নির্যাতনের বিপক্ষে কথা বলবেন। জাতিসংঘের ভূমিকা হবে ন্যায়ভিত্তিক।
আইনজীবী সাকিল আহমাদ বলেন, রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের ইতিহাস অনেক পুরনো। তবে বর্তমান সময়ে তা অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। বাংলাদেশ তাদেরকে মানবিক দিক থেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে আশ্রয় দিয়েছে। তবে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানে বিশ্ব সম্প্রদায়কে কয়েকটি বিষয় বাস্তবায়নে মিয়ানমারকে চাপ প্রয়োগ করতে হবে।
সেগুলো হলো: রোহিঙ্গা মুসলমানদেরকে নাগরিকত্ব দেয়া। সম্প্রতি তাদের বাড়িঘর পোড়ানো এবং অন্যান্য যেসব ক্ষতি হয়েছে তা তদন্ত করে সঠিক নিরুপণের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ দেয়া। আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশনের মাধ্যমে তদন্তে প্রমাণসাপেক্ষ এই গণহত্যা ও নির্যাতনে দায়ীদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।
সংবাদপত্রের এজেন্ট মো. শফিক বলেন, রোহিঙ্গারা আমাদের ওপরে বিশাল বোঝা। তারপরেও মানবিক কারণে সরকার আশ্রয় দিয়েছে। সৌদি আরব এই গণহত্যার বিপক্ষে এখন পর্যন্ত টুঁ-শব্দও করেনি। অথচ মিয়ানমারের মিত্র চীন ও ভারতও শেষ পর্যন্ত স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে যে, মিয়ানমারে গণহত্যা চলছে।
আমাদের গরিব দেশ নিজেরাই ভালো করে চলতে পারি না সেখানে তাদের বোঝা কি করে নেবো। এত রোহিঙ্গা নিয়ে আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ বা কিভাবে চলবে বলতে পারছি না।
মানবাধিকার কর্মী কামরুল হাসান বলেন, রোহিঙ্গাদের সমস্যা সম্পর্কে তো কম বেশি সবাই অবগত। আমি তাদের সমস্যা সমাধানে কয়েকটি করণীয় বলবো। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব দিতে হবে। জাতিসংঘের নিয়ন্ত্রণে রোহিঙ্গাদের জন্য ‘সেইফ জোন’ মিয়ানমারের ভেতরেই নিশ্চিত করতে হবে।
এ জন্য শান্তিরক্ষা মিশন মোতায়েন করতে হবে। মিয়ানমারের দাবি অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের মধ্যে কেউ যদি সন্ত্রাস, সহিংসতার সঙ্গে জড়িত থাকে তাহলে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। রোহিঙ্গাদের হত্যা, অগ্নিসংযোগ এবং উচ্ছেদের সঙ্গে জড়িত মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও বেসামরিক ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশে ইতিমধ্যে আশ্রয় নেয়া সব রোহিঙ্গার অধিকার (খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থান) নিশ্চিত করতে হবে।
চা দোকানি মো. নুর আলম রানা বলেন, রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ে আমাদের ছোট দেশের অনেক ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশ এমনি নানা সমস্যায় জর্জরিত। বাংলাদেশ একদিক থেকে রোহিঙ্গাদের না নিয়ে পারছে না। অন্যদিকে তাদের আশ্রয় দিলে নানা ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে।
জাতিসংঘ ঠিকভাবে পদক্ষেপ নিলে রোহিঙ্গাদের এমন ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ে পড়তে হতো না। আমাদের উচিত আলোচনা করে রোহিঙ্গাদের কিভাবে রাখাইনে ফেরত পাঠানো যায় এবং তাদের ভূমিতে বসবাসযোগ্যের ব্যবস্থা করে দেয়া যায়।
শিক্ষার্থী নাভা তাসনুভা বলেন, আমি যদি দেশের অবস্থা বিবেচনা করে বলি তাহলে মানবতার আগে আসে রোহিঙ্গাদের ভরণ পোষণের ব্যাপারটা। সহজ কথায় বললে, নিজেদের লোকদের খাবার নেই তার উপরে ওরা একটি বোঝা। তবে মানবিক দিক দেখলে তাদের আশ্রয় দেয়া যৌক্তিক।
বেসরকারি চাকরিজীবী মো. মহিবুল্লাহ বলেন, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় প্রদান করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। রোহিঙ্গা ইস্যু এখন বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু বাংলাদেশের পক্ষে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। এই সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে জাতিসংঘ ও বিশ্বের অন্যান্য সকল দেশ ও সংগঠনকে এগিয়ে আসতে হবে। এমজমিন
এমটিনিউজ/এসএস