নিউজ ডেস্ক: মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে সম্প্রতি বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন আহসান (৩০), আশ্রয় নিয়েছেন কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে। সেখানেই আহসানের সাথে কথা বলেন আল জাজিরার ক্যাটি আর্নল্ড। রোহিঙ্গাদের অবস্থান থেকে এই সঙ্কট দেখতে বিশ্বের প্রতি আহ্বান জানান আহসান। বলেন, ‘আমরাও আপনাদের মতো মানুষ।’ দুবির্ষহ অভিজ্ঞতার সাথে শঙ্কা জানান রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের নিশ্চিহ্নের।
জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী ২৫ আগস্ট সহিংসতা শুরুর পর থেকে এখনও পর্যন্ত প্রায় ৩ লাখ ৭০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তবে কক্সবাজারের স্থানীয়রা বলছেন, মিয়ানমারে চলমান সহিংসতায় বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ৬ লাখ ছাড়িয়ে গেছে।
আহসান বলেন, আমাদের গ্রাম চিন খালিতে কৃষক হিসেবে কাজ করতাম। পাশাপাশি শিশুদের ইংরেজি ভাষাও শিখাতাম। তাই আমাকে খুবই ব্যস্ত থাকতে হতো।
সহিংসতা শুরুর সেই দিনের কথা স্মরণ করে আহসান বলেন, ২৫ আগস্ট সকালে যখন পরিবারের সাথে নাস্তা করছিলাম, তখনই সেনাবাহিনী গ্রামে প্রবেশ করে। তারা আমাদের লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি ছুড়তে থাকে। এতে আমার পরিবারের ৫ জন সদস্য নিহত হয়।
‘সবচেয়ে দুঃসহ দৃশ্যের’ কথা বলেন তিনি, “আমি দেখলাম আমার মা মেঝেতে পড়ে রয়েছে, তার পিঠে গুলি। পাশেই আমার বোন পড়ে ছিলো, তার মুখে ও শরীরে ক্ষত। কিন্তু তখন আমার শোক করারও সময় ছিলো না। আমি ভীত ছিলাম, সেনারা আমাকেও গুলি করতে পারে।”
“এক সেনা আমার বোনকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। আমার বোন বাধা দিলেও তারা তাকে নির্যাতন করে। আমার বোন এতটাই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে যে সে কোন শব্দও করেনি। সে নড়াচড়াও করতে পারছিলো না। আমার ভাই এবং আমি বোনকে এখানে (শরণার্থী শিবিরে) নিয়ে আসি।”
বাংলাদেশে পালিয়ে আসার পথেও অনেক ভয়াবহ দৃশ্য দেখতে হয় আহসানকে। “দেখছিলাম মৃতদেহ, শিশুদের কান্না এবং বৃদ্ধদের ভোগান্তি। সীমান্তে পৌঁছালে দেখি সেখানে হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা নদী পার হওয়ার অপেক্ষায়। পরে একটি নৌকায় পার হই।”
“বাংলাদেশে আমাদের জীবন অত্যন্ত করুণ। আমাদের যথার্থ আশ্রয় নেই, স্যানিটেশন নেই, সকল রোহিঙ্গাদের ঘুমানোর মতো জায়গাও নেই। আমরা বেঁচে আছি, কিন্তু মারা গেলেই হয়তো ভালো হতো। আমি ভীত যে রোহিঙ্গারা শীঘ্রই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, মিয়ানমারে থাকলে আমাদের মেরে ফেলা হবে, কিন্তু এখানেও তো আমাদের কোন জীবন নেই।”
সাহায্য ও সমর্থনের জন্য সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, “আমার বিশ্বাস পুরো বিশ্ব আমাদের সাহায্য ও সমর্থন করছে। এজন্য আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। আমি চাই আমাদের অবস্থান থেকে বিশ্ব এই বিষয়টা দেখুক- আমরা তোমাদের মতোই মানুষ, যদিও তোমরা একটি দেশের নাগরিক কিন্তু আমরা নই। বিশ্বের কাছে আমার আবেদন, দয়া করে আমাদের একটা দেশের নাগরিক হতে দিন, আপনাদের মতো আমাদেরও বাঁচতে দিন।”
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সেনাবাহিনীর বহুদিন ধরে চলমান সংঘর্ষ-সহিংসতা সঙ্কট সমাধানে ২০১৬ সালের আগস্টে গঠিত হয় অ্যাডভাইজরি কমিশন অন রাখাইন স্টেট। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে ওই কমিশন এক বছরের তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দলের প্রধান অং সান সু চির কাছে জমা দেয় চলতি বছরের ২৪ আগস্ট।
৬৩ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদন জমা দেয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই ২৪ আগস্ট দিবাগত রাতে ত্রিশটি পুলিশ ও সেনাচৌকিতে রহস্যজনক হামলার ঘটনা ঘটে। হামলায় নিহত হয় নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ সদস্য। তারপরই হামলার জন্য রোহিঙ্গা ‘জঙ্গি’দের দায়ী করে জবাব হিসেবে সেনাবাহিনী পুরো অঞ্চলে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে।
সেনাবাহিনীর ওই হামলায় এখনও পর্যন্ত প্রায় ৫শ মানুষ মারা গেছে, আর প্রাণভয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে পাড়ি জমাচ্ছে বাংলাদেশে। নৌপথে পালিয়ে আসার পথে নৌকাডুবিতেও বাড়ছে মৃতের সংখ্যা।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, আনান কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন না করার উদ্দেশ্যেই মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এই হত্যাকাণ্ড শুরু করে।
এমটিনিউজ২৪ডটকম/আ শি/এএস