মঙ্গলবার, ০৩ অক্টোবর, ২০১৭, ১১:৪৬:৫০

শেষ একটি অনুরোধ জানালেন সিদ্দিকুরের ভাই

শেষ একটি অনুরোধ জানালেন সিদ্দিকুরের ভাই

নিউজ ডেস্ক  :   রাজধানীর শাহবাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় পুলিশের টিয়ার শেলের আঘাতে চোখ হারানো তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী সিদ্দিকুর রহমান চাকরিতে সোমবার প্রথম দিন কাটিয়েছেন। রাতে তার মহাখালীর বাসায় কথপোকথনে তিনি জানিয়েছেন নিজের জীবনের অনেক কথা, বলেছেন জীবনযুদ্ধ হেরে না যাওয়া এবং মানুষের জন্য কাজ করতে আরো বহুদূর যাওয়ার বিষয়ে।

চাকরি দেয়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে সিদ্দিকুর বলেন: ছোটবেলা থেকে জীবনের এ পর্যন্ত সংগ্রাম করেই এসেছি, তাই আমি মনে করি জীবন যুদ্ধে হেরে যাইনি, বরং আমি স্বাভাবিক রয়েছি, যা হয়েছে তা সাময়িক একটা বিরতি।

সোমবার সকালে সরকারি ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডে টেলিফোন অপারেটর পদে সিদ্দিকুর যোগদান করেন। চাকরির আগে খিলক্ষেত থাকলেও সুবিধার জন্য এখন মহাখালীর তিতুমীর কলেজের পাশে বন্ধুর মেসে উঠেছেন।

অফিসের প্রথম দিনে কাজ করার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে সিদ্দিকুর বলেন: অফিসের সবাই আমার প্রতি আন্তরিক। সবার এত ভালোবাসা ও উৎসাহ পেয়ে আমি গর্বিত। অফিসের এমডি স্যার থেকে শুরু করে অন্যান্য বিভাগের সবাই এসে আমাকে সাহস যুগিয়েছে। তারা সবাই আমাকে জানিয়েছে তোমার কোন ভয় নেই, আমরা তোমার পাশে রয়েছি। আমার রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষিকা সালমা ম্যাডাম তিতুমীর কলেজের পক্ষ থেকে আমার নতুন কর্মস্থলে গিয়েছিল।

‘চোখে দেখতে না পেরেও টেলিফোন অপারেটরের কাজটা কতোটা চ্যালেঞ্জিং’ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন: ছোটবেলা থেকে কষ্টে বড় হয়েছি জীবনের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছিল আগে থেকেই, এখন তা বেড়ে গিয়েছে। আমার লিখতে কোন সমস্যা হচ্ছে না, আর প্রযুক্তির মাধ্যমে সব কিছুই করা সম্ভব। দক্ষতা বাড়ানোর জন্য যা দরকার তা আমি করব, কিছুদিন হয়তো সময় লাগবে, তবে আমাকে পারতে হবে। সামনে আমার পরীক্ষা আপতত আমি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছি।

চোখ হারানোর পর থেকে কলেজের বন্ধু বান্ধব থেকে শুরু করে অগণিত মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হওয়া প্রসঙ্গে সিদ্দিকুর বলেন: চোখ হারানোর পর মানুষের যে দোয়া আর ভালোবাসা পেয়েছি তাতে আমার আর কোন দুঃখ নেই। আমি তো আলোর মিছিলে গিয়েছিলাম, শিক্ষার জন্য গিয়েছিলাম, এতে আমার জীবন চলে গেলেও আমার দুঃখ থাকত না।

আমার স্বপ্ন ছিল আমি দেশের জন্য মানুষের জন্য কিছু করি, আমি আমার বন্ধুদেরও বলতাম একটা দিন একটা সময় আমি কিছু করব। আমার বাংলাদেশ আমাকে চিনবে জানবে। যেসব বন্ধুদের এসব বলেছিলাম এখন তারা কেঁদে আমায় বলে দেশ তোকে চিনেছে কিন্ত তুই কাউকে দেখতে পাচ্ছিস না।

শিক্ষার জন্য চোখ হারিয়েছি এজন্যই মনে হয় মানুষের ভালোবাসা পাচ্ছি। আমার বিভাগের অধ্যক্ষ স্যার এমন কোন দিন নেই যে আমার খোঁজ খবর নেননি, মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম আমার সঙ্গে সরাসরি ফোনে কথা বলেছেন, সব সময় খোঁজ রেখেছেন।

চোখে আঘাত পাওয়ার পর থেকেই সিদ্দিকুরের পাশে ছিলেন বন্ধু ফরিদ, এই বন্ধু সম্পর্কে সিদ্দিকুরের উক্তি: যেভাবে নবজাতককে মা যত্ন করে, ঠিক সেভাবেই আমাকে যত্ন করেছে আমার বন্ধু ফরিদ। এই যুগে এমন বন্ধু পাওয়া সত্যিই সৌভাগ্যের ব্যাপার।

বন্ধু ফরিদের পাশে বসেই এমনটা বলছিলেন সিদ্দিক, পাশে থাকা ফরিদ বললেন: ২০ জুলাইয়ের পর থেকে আমরা অনেক উৎকণ্ঠায় সময় পার করেছি কি হবে তা ভেবে। আজ যখন ও চাকরি জীবনের প্রথম দিন অতিক্রম করল আমার অনেক ভাল লাগছে।

নিজের পরিবারের সম্পর্কে সিদ্দিকুর বলেন: আমার তিন বছর বয়সে বাবা হারানোর পর বড়ভাই সংসারের দায়িত্ব তুলে নেয়, সংসারের ভারে তিনি নিজের লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারেননি। কিন্তু আমি যখন সংসারের দায়িত্ব নেব ঠিক তখনই এমন ঘটনাটি ঘটল।

নিজের কষ্টের কথা জানিয়ে তিনি বলেন: দুঃখ লাগে আমার পরিবারের জন্য, তারা এখনো লুকিয়ে কাঁদে,  আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিল তাদের স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে। এছাড়া কষ্ট লাগে যে আমার চোখ গেলেও শিক্ষার্থীদের যে অভিযোগগুলো ছিল তা এখনও স্বাভাবিক হয়নি। আমাদের রুটিন দেওয়া হয়নি, ফলাফল দেওয়া হয়নি, শুধুমাত্র মাস্টার্স এর রুটিন দেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন: আমি জীবন যুদ্ধে হেরে যাইনি, সবসময় মনে করি আমি স্বাভাবিক রয়েছি, যা হয়েছে তা সাময়িক একটা বিরতি। হয়তো আমার চলাফেরা সবার মতো হবে না, কিন্তু আমার চিন্তা ভাবনা সবই ঠিক পথে থাকবে। আমি বিশ্বাস করি আমি ভাল কিছু করব, এর চাইতেও ভাল চাকরি ভবিষতে আমার জন্য অপেক্ষা করছে, ইনশাআল্লাহ।

মানুষের জন্য কাজ করার স্বপ্নই দেখতেন সিদ্দিকুর। জানালেন, আমার নতুন কোন স্বপ্ন নেই, আগের স্বপ্ন গুলোর বাস্তবায়নের জন্য ভিন্ন পথে আমার যাত্রা করতে হবে। মানুষের জন্য কাজ করার ইচ্ছাই আমার স্বপ্ন, চোখ হারানোর পর মানুষের যে ভালবাসা পেয়েছি তা আমার মনে লালিত স্বপ্নকে আরো উজ্জীবিত করেছে।

চাকরি দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন সিদ্দিকুর। নিজের জীবন যুদ্ধে পাশে থাকার জন্য গণমাধ্যমকর্মীদের প্রতিও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন তিনি।

সিদ্দিকুরের ভাই মো. নায়েব আলী  বলেন, এখন সিদ্দিকুরের চলা ফেরার জন্য পাশে একজন লোকের প্রয়োজন হয়, আমি ওর পাশে থাকি সবসময়। সরকার আমাদের জন্য অনেক করেছে, শেষ একটা অনুরোধ যদি আমাকে রাজধানীতে ছোট একটা কিছুর ব্যবস্থা করে দেওয়া যায়, তাহলে ছোট ভাইটাকে দেখা শুনা করে পরিবারের দায়িত্বও পালন করা যাবে।

পরীক্ষার রুটিন ও তারিখ ঘোষণাসহ কয়েকটি দাবিতে গত ২০ জুলাই শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচি পালনকালে পুলিশের ছোঁড়া টিয়ার সেলের আঘাতে চোখে গুরুতর ক্ষতের সৃষ্টি হয় তিতুমীর কলেজের ছাত্র সিদ্দিকুর রহমানের। পরে তাকে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি করা হলে তার ডান চোখে আলো ফেরার সম্ভাবনা নেই এবং বাম চোখের অবস্থাও ভালো না বলে জানিয়ে দেন চিকিৎসকরা।

পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ও   স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের তত্ত্বাবধানে তাকে চেন্নাইয়ের শংকর নেত্রালয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়। সেখানে অস্ত্রোপচার করেও সিদ্দিকুরের চোখে আলো ফেরেনি। --চ্যানেল আই

এমটিনিউজ২৪/এম.জে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে