বৃহস্পতিবার, ০৫ অক্টোবর, ২০১৭, ০১:২৯:২৭

আরাকান এখন যেমন-

আরাকান এখন যেমন-

কাফি কামাল, কক্সবাজার থেকে : আরাকানে এখনো থামেনি হত্যাযজ্ঞ। জাতিগত নির্মূল অভিযানে জনমানবশূন্য হয়ে পড়েছে বেশির ভাগ গ্রাম। অবশিষ্ট গ্রামগুলোতে এখন চলছে তাণ্ডব। কিছু গ্রামের মানুষকে কড়া নজরদারির মাধ্যমে আটকে রেখেছে দেশটির সেনাবাহিনী।

বিশেষ করে সামাজিকভাবে প্রভাবশালী ও অর্থনৈতিকভাবে বনেদি পরিবারগুলো। বাংলাদেশ অভিমুখে রওনা দেয়া সাধারণ রোহিঙ্গা পরিবারগুলোকে আটকানো হচ্ছে পথে পথে। অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের  এলাকা ছাড়তে সাইনবোর্ড ঝুলানো হচ্ছে পাড়ায় পাড়ায়। স্থানীয় মগরা মাইকিং করছে প্রতিদিন।

যারা মাটি কামড়ে পড়েছিল তাদের করা হয়েছে ঘরবন্দি। জোর করা হচ্ছে সেনাক্যাম্পে পাঠাতে সেয়ানা মেয়েদেরও। লুট করে নেয়া হচ্ছে গবাদিপশু। ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পথ আটকে সমানে লুটপাট করছে সশস্ত্র মগরা। পথে পথে হত্যা এবং সম্ভ্রমহানী চলছে সমানে।

বুচিদং ও মংডু অবস্থানকারী কয়েকজন রোহিঙ্গার সঙ্গে ফোনালাপ এবং মঙ্গলবার বাংলাদেশে আসা বেশকিছু রোহিঙ্গা পরিবারের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। সারা বিশ্বের চাপের মুখে বাংলাদেশ সফর করে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার কথা বলেছেন মিয়ানমারের স্টেট মিনিস্টার।

কিন্তু এখন পর্যন্ত মগদের মাধ্যমে হামলা চালিয়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দিচ্ছে দেশটির সেনাবাহিনী। এভাবে দ্বিমুখী নীতির মাধ্যমে আরাকান থেকে রোহিঙ্গা জাতিনির্মূল অব্যাহত রেখেছে দেশটি।

এখন যেমন উত্তর আরাকান : সময় তখন বিকাল ৫টা। কুতুপালং বাজারে পুরনো ক্যাম্পের একজন রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা হয়। যিনি বাংলাদেশে এসেছেন ১৯৯২ সালে। তিনি ফোনে খবর নিচ্ছিলেন বুচিদং-রাচিদং বর্ডারের খাতিরবিল এলাকায় বসবাসরত তার মামার।

যিনি খাদির বিল ইউনিয়নের চারবারের সাবেক উক্কাডা (চেয়ারম্যান) হাজী ওসমান। খাদিরবিলের বনেদি এ পরিবার অর্থের পাশাপাশি সামাজিকভাবেও বেশ প্রভাবশালী। তাদের জমি চাষ হয় এক হাজার কানি। দীর্ঘক্ষণ তার ফোনালাপে ওপার থেকে ভেসে আসছিল কান্নার শব্দ।

হাজী ওসমানসহ সেখানে অবস্থানরত কয়েকজনের বরাত দিয়ে পুরনো ওই রোহিঙ্গা জানান, উত্তর আরাকান জুড়ে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞের মধ্যেও বুচিদং-রাচিদংয়ের সীমান্তবর্তী মইদং, জাংহামা, জাংহামা উত্তর ও পূর্ব পাড়া, চাংগানা, পালিপাড়াগুলো ছিল তুলনামূলক নিরাপদ।

মিয়ানমারের ওপর সারা বিশ্বের চাপ এবং জাতির উদ্দেশে অং সান সুচির বক্তব্যের পর তারা কিছুটা আশান্বিত হয়েছিলেন। কিন্তু ২৪-২৫শে সেপ্টেম্বর সেখানে মিটিং ডেকে সেনাবাহিনীর কথা বলে মগরা রোহিঙ্গাদের এলাকা ছেড়ে দিতে বলে। তারা পরিষ্কার জানিয়ে দেয়, এ জমি আমাদের এখানে তোমরা বহু বছর বসবাস করেছো আর থাকতে পারবে না।

ইতিমধ্যে ওইসব গ্রাম থেকে অনেক রোহিঙ্গা পালিয়েছে। হাজী ওসমান জানিয়েছেন, তারা চরম আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। কিন্তু সেনাবাহিনীর কড়া নজরদারির কারণে এলাকাও ছাড়তে পারছেন না। সন্ধ্যা তখন ৬টা। উখিয়া পান বাজারে কয়েকজন রোহিঙ্গাকে দেখা গেল ফোনে কথা বলছেন স্বজনদের সঙ্গে। যারা

বাংলাদেশে আসার অপেক্ষায় অবস্থান করছেন মংডুর মংডিপাড়া ঘাট এলাকায়। তাদের একজন আবদুল্লাহ বাংলাদেশে মিয়ানমারের একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রীর আগমন এবং রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার ব্যাপারে তার আশ্বাসকে মিথ্যা আখ্যায়িত করে বলেন, মুখে ফেরত নেয়ার কথা বললেও বাস্তবে এখনো সেখান থেকে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।

তিনি জানান, মংডিপাড়া ঘাটের পাশেই বড় দুইটি সেনাক্যাম্প রয়েছে। মিয়ানমার সরকার যদি রোহিঙ্গাদের সেদেশে রাখতে চায় তাহলে এ সেনাক্যাম্পের সামনে দিয়ে নৌকায় করে প্রতিদিন হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ বাংলাদেশে আসতে পারতো না। এমন ঘটনাও ঘটেছে তড়িঘড়ি করে পালাতে গিয়ে ঘরে ফেলে আসা বয়স্কদের গাড়ি দিয়ে এনে ঘরছাড়া রোহিঙ্গাদের সঙ্গে শামিল করে দিয়েছে মগরাই।

আবদুল্লাহ জানায়, মংডুতে তার কিছু আত্মীয়স্বজন রয়েছে তাদের কড়া নজরদারির মধ্যে রেখেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। মঙ্গলবার দুপুরে বাংলাদেশে আসা বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ জানিয়েছেন, মুসলিম পাড়াগুলোর অধিকাংশই পুড়িয়ে জনমানবশূন্য করে ফেলা হয়েছে। বেশির ভাগ পাড়ার মুখে রোহিঙ্গাদের দেশ ছাড়ার কথা লেখা সাইনবোর্ড টাঙানো হয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় মাইকিংও অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু কিছু কিছু এলাকায় দু’চারঘর রোহিঙ্গাকে আটকে রেখেছে সেনাবাহিনী।  
 
পথেই কেটেছে আটদিন : দুপুর তখন সাড়ে ১২টা। বালুখালী ক্যাম্পের সামনে একসঙ্গে এসে নামে অন্তত চল্লিশটি পরিবার। আরাকানের বিভিন্ন জায়গা থেকে তারা এসেছে। তাদের একজন পূর্ব বুচিদংয়ের কেপ্রুডং পাড়ার জাফর আলম বলেন, কোরবানির পর থেকে আমাদের ঘরবন্দি করে ফেলেছে স্থানীয় মগরা।

ক্ষেতের ধান ঝরে যাচ্ছে, গরুগুলো উপোষ, নিজেরা পুকুরে পানি পর্যন্ত আনতে বেরুতে পারি না। কয়েক সপ্তাহ ঘরবন্দি কাটানোর পর অবশেষে একরাতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসি। বুচিদং ঢালা পেরুনোর পর হাউয়ার বিলে আমাদের ঘিরে ফেলে মগরা। এ সময় লুটপাটের পাশাপাশি মেয়েদের শরীরেও হাত দেয় তারা। অস্ত্র সজ্জিত মগদের এমন হামলার সময় আল্লাহকে ডাকা ছাড়া কোনো পথ ছিল না। এ সময় পাশের একজন মেয়েকে দেখিয়ে দেন তিনি। সে মেয়েটির নাম আরজু।

মাটির দিকে তাকিয়ে মেয়েটি বলে, লুটপাটের সময় তার গোটা শরীর হাতিয়ে দেখেছে মগের ছেলেরা। আমার মা তাদের পায়ে পড়লে বাড়ি দিয়ে তার পা ভেঙে ফেলেছে। পরদিন আমরা মগদের ভয়ে রাত কাটিয়েছি জমির আলে শুয়ে থেকে। হাউয়ার বিল পেরিয়ে পরদিন দৌলাবিল এলাকা পৌঁছালে তাদের আটকে ফেলে সেনাবাহিনী। এ সময় সেখানে তাদের জমায়েত করা হয়েছিল ৭৪৫টি পরিবার।

একদিন আটকে রাখার পর মংডুর শোয়ে মং জিম্মাদার হয়ে আমাদের ছাড়িয়ে দেয়। কিন্তু পেরাংপ্রু ঘাটে এসে নৌকা ভাড়ার টাকার জন্য আটকা পড়ি। নদীর ঘাটে চারদিন অপেক্ষার পর কয়েকজনকে জিম্মায় রেখে আমরা বাংলাদেশে এসেছি। এ সময় পাশের ফিরোজা খাতুন কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেন, আমার এক ছেলেকে জিম্মায় রেখে এসেছি জানি না সে কেমন আছে।

চলতি পথের একই রকম দুঃখের কাহিনী শোনায় উত্তর বুচিদংয়ের সোয়ে প্রাং এলাকার এয়াকুব আলী। তিনি জানান, দুই সপ্তাহ আগে তাদের পাড়ায় হামলা চালিয়ে ৪০ জনকে হত্যা করে সেনাবাহিনী ও মগরা। বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে আসার সময় ফাতিয়ার ঢালা পেরিয়ে এলে মগরা আমাদের লুট করে নেয়। সেখানে আমরা রাস্তার পাশেই দেখতে পেয়েছি ৫ নারী-পুরুষের তাজা লাশ।

সময় তখন দুপুর আড়াইটা। বালুখালী ক্যাম্পের সামনের রাস্তা। ট্রাক থেকে হুড়মুড় করে নামলো শিশুসহ একদল নারী-পুরুষ। সোমবার সকালেই তারা শাহপরীর দ্বীপ হয়ে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশে। ষাটোর্ধ্ব মোহাম্মদ ইউনুস তাদের একজন। স্ত্রী-কন্যাসহ পরিবারের সদস্য সংখ্যা এগারোজন। হাঁটতে হাঁটতে পা ফুলে গেছে, চড়া ওঠেছে কাঁধে। নয়দিনের পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন তিনি। তার বাড়ি পূর্ব বুচিদং।

ইউনুস জানান, কয়েক মাস আগে মিয়ানমার সরকার তাদের ডেকে কার্ড করতে বলেছিল কিন্তু কার্ডে তাদের পরিচয় বাঙালি লেখা হচ্ছে দেখে তারা সে কার্ড নিতে অস্বীকার করে। তারপর থেকে তাদের উপর নজরদারি শুরু হয়। কোরবানির আগে তাদের পাড়ায় প্রথম হামলার ঘটনা ঘটে। প্রতিবেশী মগরা তাদের রাস্তাঘাটে বের হতে এমন কি ক্ষেতের ধান পর্যন্ত কাটতে বাধা দেয়।

সেনাবাহিনী এসে তাদের পাড়া থেকে সেয়ানা মেয়ে খুঁজতে শুরু করে। কয়েকজনকে ধরে নেয়ার পর একদিন রাত দুটোর সময় তারা সপরিবারে বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা দেয়। বুচিদং পাহাড় পাড়ি দিতেই সেই রাত আর পরের দিন কেটে যায়। দিনের বেলা সেনাবাহিনী ও মগদের চলাচলের সময় কয়েকবার তাদের লুকিয়ে থাকতে হয়েছে জঙ্গলে।

দ্বিতীয় দিন সকালে বুচিদং ঢালা পেরিয়ে সমতলে এলে মগের একটি দল তাদের আটকে ফেলে। সেখানে প্রথম দফা লুটের শিকার হন। কিন্তু বিভিন্ন এলাকা থেকে ততক্ষণে তাদের মতো আরো কিছু লোক সেখানে পৌঁছালে মগরা চলে যায়। তারা সংখ্যায় দাঁড়ায় হাজারের উপরে। কিন্তু দুপুরের দিকে রাস্তায় তাদের দ্বিতীয় দফা আটকায় সেনাবাহিনী।

তাদের নেয়া হয় একটি স্কুলের মাঠে। বিকাল হতে হতে সেখানে জমায়েত হয় প্রায় কয়েক হাজার মানুষ। সেনাবাহিনী তাদের গ্রামে ফিরতে বলে। রাতটি সেখানেই কেটে যায়। পরদিন সকালে সেখানে পৌঁছায় মংডুর এক বড় রোহিঙ্গা ব্যবসায়ী শোয়ে মং। তিনি সেনাবাহিনীর সঙ্গে আলাপ করে তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করেন।

লোকজনের কাছে শোয়ে মং জানতে চান তারা গ্রামে ফিরে যাবে নাকি বাংলাদেশে। লোকজন তাদের ওপর অত্যাচারের কথা বলে বাংলাদেশে আসতে চাইলে শোয়ে মং সেনাবাহিনীর সঙ্গে কথা বলে ছুটিয়ে আনেন পরদিন। সেদিন ও রাত তাদের কেটে যায় চলতি পথে। চতুর্থদিন তারা পৌঁছান প্রাইপ্রু ঘাটে। কিন্তু ভাড়ার টাকা না থাকায় তাদের নৌকায় তুলেনি মাঝিরা। সেখানেই কেটে যায় তিন দিন তিনরাত। এক পর্যায়ে তারা বিনাভাড়ায় বাংলাদেশে আসার সুযোগ পায়।

সময় তখন বারোটা। বালুখালী ক্যাম্পের সামনেই এসে থামে দুইটি ট্রাক। হুড়মুড় করে নামে বেশকিছু রোহিঙ্গা পরিবার। তাদের একজন আছিয়া খাতুন। তাদের বাড়ি পূর্ব বুচিদংয়ের লংসং ও কুরিসং পাড়া।

তিনি জানান, কোরবানির কয়েকদিন আগে বাগি (বিদ্রোহী) খোঁজার কথা বলে তাদের পাড়ায় অভিযান চালায় সেনাবাহিনী। তারপর তাদের এলাকা থেকে চলে যেতে বলে স্থানীয় মগ উক্কাডা (চেয়ারম্যান) টিয়ং। তারপর কিছুদিন মাটি কামড়ে পড়েছিলেন। প্রতি রাতেই মেয়েদের বাড়ি থেকে সেনাক্যাম্পে তুলে নিয়ে যায়।

এ সময় পাশে বসা মিনারা নামের মহিলাটি কেঁদে ওঠে বলেন, বাবা আমরা মুসলমান হয়ে কিভাবে জেনে শুনে মগদের ক্যাম্পে মেয়েদের পাঠাবো। তাই টিকতে না পেরে এদেশে চলে এসেছি। আছিয়া বলেন, ৯ দিন আগে এক রাতে তারা বাড়ি ছেড়ে অনিশ্চয়তার পথ ধরে। বুচিদং ঢালায় কেটে যায় একদিন দুইরাত। ঢালা পেরিয়ে সমতলে এলে প্রথম দফা লুটপাট করে মগরা।

এ সময় একটি মেয়েকে তুলে নিয়ে যায় এবং অন্য এলাকার তিনজন পুরুষকে তাদের সামনেই হত্যা করে। পরদিন তাদের রাস্তায় আটকে দেয় সেনাবাহিনী। দুইদিন কেটে যায় সেখানে। পরে শোয়ে মংয়ের চেষ্টায় তারা ছাড়া পেয়ে হাঁটতে থাকে। কিন্তু নাফ নদীর ঘাটে এসে পারাপারের অভাবে দুইদিন বসে থাকে।

মংডুর কিছু মুসলিম পরিবার তাদের টুকটাক যে সাহায্য দিয়েছে তাই দিয়ে শেষ দুইদিন নিবারণ করেছে পেটের ক্ষুধা। কয়েকজনকে জিম্মি রেখে তারা নৌকার উঠলে পারাপারের জন্য মাঝিরা তাদের মারধর করে এবং শাহপরীর দ্বীপে এসে আটকে রাখে। পরে বিজিবি তাদের মুক্ত করে দেয়। এমজমিন
এমটিনিউজ/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে