রবিবার, ০৮ অক্টোবর, ২০১৭, ১১:২০:৪৮

বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে মরণঘাতী একটি খেলা- প্রথমে প্রাণ কেঁড়ে নিল কিশোরীর

বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে মরণঘাতী একটি খেলা- প্রথমে প্রাণ কেঁড়ে নিল কিশোরীর

ঢাকা: 'দ্য 'ব্লু হোয়েল চ্যালেঞ্জ'। এটি অনলাইন গেম। এরই মধ্যে প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে এই খেলা। শুরুর দিকে এ খেলায় মজা থাকলেও কয়েক ধাপ পার হওয়ার পর এটি ভয়ঙ্কর ফাঁদে পরিণত হয়। ৫০ নম্বর ধাপের সেই ফাঁদে পা দিয়ে হারাতে হয় নিজের জীবন। শেষ ধাপের নাম 'আত্মহত্যা'। আসক্তির কারণে চাইলেও ফেরা যায় না। ২০১৩ সাল থেকে বিশ্বের বিভিম্ন দেশে তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরী এই ফাঁদে পা দিয়ে প্রাণ হারালেও সম্প্রতি ভারতে 'ব্লু হোয়েল (নীল তিমি) নামের এ খেলায় পা দিয়ে কয়েকজনের আত্মহত্যার খবর মিলেছে। সেখানকার প্রচার মাধ্যমেও বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশেও ঢুকে পড়েছে মরণঘাতী এ খেলাটি। ঢাকায় এরই মধ্যে এক কিশোরী এতে আসক্ত হওয়ার পরিণামে প্রাণ হারিয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে তথ্য মিলেছে। তবে বিষয়টি সুনিশ্চিত করতে নিবিড়ভাবে অনুসন্ধান চলছে।


বাংলাদেশে কতজন এই মরণ খেলায় আসক্ত, পুলিশের সাইবার সিকিউরিটি সেলে তার সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে তারা সতর্ক রয়েছে বলে জানিয়েছে। এরই মধ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) নিউজ পোর্টালে এই গেম নিয়ে সতর্কতামূলক বার্তা দেওয়া হয়েছে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগও তাদের ফেসবুক পেজে 'ব্লু হোয়েল' গেম নিয়ে সতর্ক করে বলেছে, অনলাইনে ্ব্নু হোয়েল গেম খেলা বা এই গেমের লিঙ্ক দেওয়া-নেওয়া বা সে চেষ্টা দন্ডনীয়। যারা এগুলোর যে কোনো একটি করবেন, তাদের বিরুদ্ধে সাইবার পুলিশ ব্যবস্থা নেবে।


সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার নাজমুল ইসলাম গতকাল শনিবার বলেন, 'ব্লু হোয়েলের ফাঁদে পড়ে দেশে তারা এখন পর্যন্ত একজন কিশোরীর আত্মহত্যার খবর পেয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার সেন্ট্রাল রোড এলাকায় ওই কিশোরী আত্মহত্যা করে। কেউ তাদের কাছে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ না করলেও ঘটনাটি তারা তদন্ত করছেন।


তিনি আরও বলেন, এরই মধ্যে বিটিআরসিকে এ ধরনের গেমের লিঙ্ক সার্চ চোখে পড়লে তা বন্ধের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। তবে সবার আগে বাবা-মা, অভিভাবকদের বেশি সচেতন হতে হবে। এ ধরনের গেম খেলার কোনো লক্ষণ পাওয়া গেলে তা পুলিশকে জানাতে হবে।


ভয়ঙ্কর এই গেমের সফটওয়্যার লিঙ্ক ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ বা ইনস্টাগ্রামের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে পাওয়া যাচ্ছে। নির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও বাংলাদেশেও বেশ কয়েকজন এই ভয়ঙ্কর খেলায় আসক্ত বলে তথ্য রয়েছে পুলিশের কাছে। গেমটির কয়েক ধাপ পার হয়ে ফেরত এসেছেন- ময়মনসিংহের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত এমন একজন ছাত্রের সঙ্গে কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের। নাম প্রকাশ না করে ওই ছাত্র বলেন, মজা পেয়ে তিনি খেলতে শুরু করেছিলেন। ২৯ নম্বর ধাপে যাওয়ার পর তাকে হাত কাটতে বলা হলো। এরপর তিনি ওই গেম বন্ধ করে বেরিয়ে আসেন।


ওই ছাত্র বলেন, এটি যে একটি মরণফাঁদ তা শুরুতে বোঝা যায় না। যখন বোঝা যায় তখন অনেকের পক্ষেই আর ফিরে আসা সম্ভব হয় না। প্রযুক্তি বিষয়ে তার জানাশোনা রয়েছে বলে তার পক্ষে ফেরা সম্ভব হয়েছে।

'ব্লু হোয়েল গেম কী : গেমটি খেলা ময়মনসিংহের ওই ছাত্র, পুলিশের সাইবার সিকিউরিটি বিভাগ ও বিভিম্ন অনলাইন ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, ্ব্নু হোয়েল একটি আত্মঘাতী গেম। এর ৫০টি ধাপ বা লেভেল রয়েছে। সর্বশেষ ধাপ মৃতু্য। প্রথম দিকের ধাপগুলো মজার হওয়ায় কিশোর-কিশোরীরা সহজেই আকৃষ্ট হয়।


সাইবার সিকিউরিটি বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ডিপ ওয়েব বা ডার্ক ওয়েবে পাওয়া যায় এই গেম। সেখান থেকে ইনস্টল করে নিতে হয়। কেউ খেলায় ইচ্ছুক হলে তার মোবাইল ফোন বা ল্যাপটপ-কম্পিউটারে পৌঁছে যায় গেমের নির্দেশাবলি। সে অনুযায়ী সাদা কাগজে তিমি মাছের ছবি এঁকে শুরু হয় খেলা। যেটি পাঠাতে হয় গেম অ্যাডমিনকে। এরপর আসে পরবর্তী ধাপ।


গেমটি খেলেছেন এমন একজন বলেন, আপনাকে বলা হবে গভীর রাতে ঘুম থেকে উঠে রাস্তায় বসে থাকতে। তার প্রমাণ হিসেবে ছবি পাঠাতে হবে। পরের ধাপে ভূতের ছবি দেখতে নির্দেশ দেওয়া হবে। প্রমাণ হিসেবে সেই লিঙ্ক পাঠাতে হবে। একটি ধাপে হাতে আঁকতে হবে নীল তিমি বা 'ব্লু হোয়েল। সেটি সুচালো পিন বা ধারালো অস্ত্র দিয়ে। সেই ছবিও পাঠাতে হবে। এভাবে সহজ থেকে কঠিন ধাপের শুরু হবে। অতিরিক্ত মাদক সেবনের চ্যালেঞ্জও থাকে গেমে। আসতে থাকবে একের পর এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। ততক্ষণে একজন খেলোয়াড় আসক্ত হয়ে পড়ে তাতে। শেষ ধাপে বলা হবে আত্মহত্যার মতো কিছু করতে। সেই ছবিও পাঠাতে বলা হবে। আত্মহত্যা না করলে বাবা-মায়ের ক্ষতি হবে- এমন হুমকিও দেওয়া হয় গেম অ্যাডমিন থেকে। তবে ওই ফাঁদে পড়ে আর ছবি পাঠানোর সুযোগ থাকে না। তার আগেই প্রাণ শেষ।


গত ২৩ সেপ্টেম্বর ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকার এক খবরে বলা হয়, মধ্য প্রদেশের রায়গড়ের দশম শ্রেণির এক ছাত্র তার পরীক্ষার খাতায় ্ব্নু হোয়েলের কথা লেখে। এর পরই ভারতে ্ব্নু হোয়েল নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। বেরিয়ে আসে 'ব্লু হোয়েলের ফাঁদে পড়ে কয়েকজনের মৃতু্যর সংবাদ।


জার্মানির গণমাধ্যম ডয়েচে ভেলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সাম্প্রতিককালে গোটা বিশ্বে আত্মঘাতী হওয়া অন্তত ১৩০ জনের আত্মহননের পেছনে রয়েছে এই 'ব্লু হোয়েল সুইসাইড গেম।


অনলাইনের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ফিলিপ বুদেকিন নামে রাশিয়ার এক তরুণ এই গেমের সফটওয়্যার তৈরি করেন। তিনি মনোবিজ্ঞানের ছাত্র। এরই মধ্যে ওই যুবককে গ্রেফতারও করা হয়েছে বলে ডয়েচে ভেলের খবরে বলা হয়েছে।


খেলতে খেলতে মৃত্যু ! : গত বৃহস্পতিবার ঢাকার সেন্ট্রাল রোডের ৪৪ নম্বর বাসার একটি ফ্ল্যাট থেকে অপূর্বা বর্ধন অরুন্ধতীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। মেধাবী অপূর্বা হলি ক্রস স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী ছিল।
তার মা সানি বর্ধন গতকাল বলেন, তার মেয়ে সবার অজান্তেই ইন্টারনেটের 'নিষিদ্ধ' গেমে ঢুকে পড়েছিল। সব সময়ে গেম খেলত। তারা সন্দেহ করছেন, মেয়ে ্ব্নু হোয়েল গেমের ফাঁদে পা দিয়ে প্রাণ হারিয়েছে। এ ঘটনায় নিউমার্কেট থানায় একটি অপমৃতু্য মামলা হয়েছে।

অপূর্বার বাবা আইনজীবী সুব্রত বর্ধন বলেন, মেয়ের মৃতু্যর পর তার শরীরে একটি বিশেষ চিহ্ন আঁকা দেখা গেছে। ইংরেজিতে লেখা এক লাইনের সুইসাইড নোটেও 'স্ট্মাইলি' চিহ্ন ছিল। এ থেকে তারা ধারণা করছেন, অপূর্বা ্ব্নু হোয়েলের ফাঁদে পড়েছিল। সুব্রত বলেন, তার মেয়ের মতো যাতে পরিণতি আর কারও না হয়, সেজন্য সন্তানদের প্রতি সব অভিভাবকের সতর্কদৃষ্টি থাকা জরুরি। দ্রুতই ইন্টারনেট থেকে এ ধরনের মারণঘাতী গেমের লিঙ্ক বন্ধের জন্যও তিনি সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান।

নিউমার্কেট থানার ওসি আতিকুর রহমান বলেন, একটি সুইসাইড নোট মিলেছে। তাতে লেখা, 'আমার আত্মহত্যার জন্য কেউ দায়ী নয়।' পরিবার বলছে, অপূর্বার আত্মহত্যার কোনো পারিবারিক কারণ থাকতে পারে না। তাদের বক্তব্য গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে তার ব্যবহূত মোবাইল ফোনটি যাচাই করে কিছু পাওয়া যায়নি। প্রয়োজনে সেটি ফরেনসিক ল্যাবে পরীক্ষা করা হবে।
এমটি নিউজ/ আ শি/এএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে