সোমবার, ০৯ অক্টোবর, ২০১৭, ০১:০৯:৫৯

সৌদি আরবে ২২ বাংলাদেশির মানবেতর জীবন

সৌদি আরবে ২২ বাংলাদেশির মানবেতর জীবন

রোকনুজ্জামান পিয়াস : কাজ করেও বেতন পাননি ৫ মাস। ঠিকমতো দেয়া হয়নি খাবার। কথায় কথায় তাদের ওপর আসে নির্যাতন। গত সপ্তাহে বেতন চাওয়ায় ক্যাম্প থেকেও বের করে দেয়া হয়েছে। এরপর দুই দিন দুই রাত কেটেছে রাস্তাতেই।

পথচারীদের কাছে হাত পেতে যা পেয়েছেন, তা দিয়েই কোনরকম খাবার কিনেছেন। সকলে মিলে ভাগাভাগি করে খেয়েছেন। কিন্তু এখন সে অবস্থাও নেই। কোম্পানি কর্তৃপক্ষ তাদের নিয়ে গেছে একটি হোটেলে। কেড়ে নিয়েছে আকামা। এক কক্ষে গাদাগাদি করে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়।

তিনদিন পর তালা খুলে দেয়া হলেও হোটেলেই বন্দি রয়েছেন তারা। হোটেল থেকে বের হওয়ার সুযোগ নেই, নেই খাবার-দাবারের ব্যবস্থাও। এ অবস্থা সৌদি আরবে কাজের সন্ধানে যাওয়া ২২ বাংলাদেশির। এদের একজন ওমর ফারুক। বাড়ি গাইবান্ধার সদর উপজেলার দক্ষিণ ধানগড়া ইউনিয়নের সুখনগর গ্রামে।

বৃহস্পতিবার থেকে গতকাল পর্যন্ত মোবাইল ফোনে কয়েক দফা কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি তুলে ধরেন তাদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগের কথা। অনুনয়-বিনয় করে বলেন, তাদের ভাগ্যবরণ করতে আর কোনো বাংলাদেশি যেন এ সময়ে সৌদি আরব না আসে।

গত ১৭ই এপ্রিল রহমানিয়া করপোরেট নামে রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকার এক রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে সৌদি আরব যান ওমর ফারুক। তার সঙ্গে একই ফ্লাইটে যায় দেশের বিভিন্ন এলাকার আরো ২১ জন। দেশটিতে যেতে তারা প্রত্যেকে ৬ থেকে সাড়ে ৬ লাখ টাকা এজেন্সিকে দিয়েছিল।

ওমর ফারুক জানান, তাদের সৌদির বিভিন্ন অফিস, ফাইভ স্টার হোটেল, মসজিদ-মাদরাসার সহকারী বা ক্লিনিংয়ের কাজ দেয়ার কথা বলেছিল সংশ্লিষ্ট এজেন্সি। বেতন দেয়ার কথা ছিল ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। সেই অনুযায়ী তারা মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে দেশটিতে গেছেন। রহমানিয়া এজেন্সি তাদের রিয়াদের মেসার্স মাযাহ আল দোয়া কনস্ট্রাকশন কোম্পাতি কাজ দিয়ে পাঠায়। এ কোম্পানি তাদের জেদ্দার সাফারি ক্যাম্পে হস্তান্তর করে। সেখানে যাওয়ার পরই তারা পড়েন বিপাকে।

ওমর ফারুক জানান, তাদের যেখানে রাখা হয়, সেখানে আগে থেকে আরো ২০০ বাংলাদেশি অবস্থান করছিল। তাদের অনেকেরই কাজ ছিল না। আবার কারো কাজ থাকলেও বেতন দেয়া হতো না। নতুনভাবে যাওয়া এই ২২ জনকে তারা রাস্তা ক্লিনিংয়ের কাজ দেয়। কিন্তু মাসের পর মাস কাজ করালেও বেতন দেয়া হতো না। এমনকি ঠিকমতো খাওয়াও দিতো না।

এই অবস্থায় তাদের অনেকেই দেশে থাকা পরিবারের কাছ থেকে টাকা নিয়ে খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। ওমর ফারুক নিজেও ইতিমধ্যে বিভিন্ন সময় রহমানিয়া করপোরেট এজেন্সির মাধ্যমে পরিবারের কাছ থেকে ২৫ হাজার টাকা নিয়ে কোনরকম দিন পার করছেন। আবার এলাকার অনেকে দেখা করতে এসেও কিছু সাহায্য করে যান। তা দিয়েই কোনরকম আধাপেট খেয়ে দিন চালায়।

প্রতারিত এই বাংলাদেশি জানান, এভাবে পাঁচ মাস কেটে গেছে। দীর্ঘ এই সময়ে প্রত্যেকে মাত্র ১২ হাজার টাকা করে পেয়েছেন। বেতন চাইলেই কোম্পানির লোকজন তাদের মারধর করতো। গত ২রা অক্টোবর তারা আবারো বেতন দাবি করলে এক কক্ষে ১০-১২ জনকে নিয়ে বেদম মারপিট করে। তাদের ২২ জনকে ক্যাম্প থেকে বের করে দেয়।

এরপর কোনো উপায় না পেয়ে তারা রাস্তাতেই দিনরাত কাটান। ওই পথচারীদের কাছে হাত পেতে যা পেয়েছেন তা দিয়েই কোনরকম খেয়েছেন। এ রাস্তায় দু’দিন থাকার পর গত বৃহস্পতিবার মেসার্স মাযায়া আল-দোহা কোম্পানির লোকজন তাদের জেদ্দার উবরি তাহালিয়া ইশারা আরবাইন এলাকার জাওহার্ত আল তানমিয়াহ ফার্নিশড  অ্যাপার্টমেন্ট নামে একটি হোটেলে নিয়ে যায়।

এরপর আকামা ছিনিয়ে নিয়ে তাদের ২২ জনকে একটি কক্ষে তালাবদ্ধ করে রাখে। গতকাল পর্যন্ত তারা কক্ষেই তালাবদ্ধ অবস্থায় ছিলেন। এরপর দুপুরে কোম্পানিটির একজন লোক এসে তালা খুলে দিয়ে তাদের মোবাইল ফোন নিয়ে নেয়। কিছুক্ষণ পর মোবাইল ফেরত দিলেও আকামা ফেরত না দিয়ে চলে যায়।

পরে তাদের দু’একজনের কাছে বাড়ি থেকে পাঠানো যে টাকা পয়সা ছিল তা দিয়ে সামান্য কিছু খাদ্যদ্রব্য কিনে ভাগাভাগি করে খায়। এদিকে আকামা ফেরত না দেয়ায় তারা হোটেলেই বন্দি হয়ে পড়েছেন। পুলিশের হাতে আটক হওয়ার ভয়ে বাইরে বের হতে পারছেন না। এ অবস্থায় না খেয়ে এবং অন্যকোনো উপায় না পেয়ে তারা দিশাহারা হয়ে পড়েছেন।

হোটেলটিতে বন্দি হয়ে পড়া এই ২২ জনের অন্যরা হলেন- রাজিব (চাঁদপুর), শাকিল (কুমিল্ল), ফারুক (গাজিপুর), খোকন (টাঙ্গাইল), সোহেল রানা (কুড়িগ্রাম), হানিফ (কুমিল্লা), সুমন (ব্রাহ্মণবাড়িয়া), রহমত আলী (গাজিপুর), জাহিদ ইসলাম (নওগাঁ), বিঞ্চু (টাঙ্গাইল), নাইম (ময়মনসিংহ), রবিউল ইসলাম (মানিকগঞ্জ), সুমন (নরসিংদী), মাসুদ রানা (মাগুরা), মনির (কুমিল্লা), সোবেল (ব্রাহ্মণবাড়িয়া), আলমগীর (ঢাকা), আল আমিন (ময়মনসিংহ), সালাউদ্দিন (মানিকগঞ্জ) এবং আবুল খায়ের (কুমিল্লা)।

বন্দি এই ২২ বাংলাদেশির প্রত্যেকেই ধারদেনা করে ৬ থেকে সাড়ে ৬ লাখ টাকা খরচ করে দেশটিতে গেছেন। ওমর ফারুক আরো জানান, জেদ্দায় সাফারি ক্যাম্পের তারাসহ ২২০ জন বাংলাদেশি ছিল। তাদের কাউকেই বেতন দেয় হয় না। কিন্তু উপায় না পেয়ে অনেকেই দিনের পর দিন থাকছেন। নির্যাতন সহ্য করছেন। এদিকে এসব কারণে বিভিন্ন সময় পালিয়ে যাওয়ায় বর্তমানে সেখানে ১৪৫ জনের মতো অবস্থান করছেন। কিছুদিন আগেও চারজন পালিয়ে দেশে ফিরেছেন।

এরা হলেন- টাঙ্গাইলের কামরুল, ঠাকুরগাঁওয়ের নাসিরুল, গাজিপুরের শরীফ এবং নোয়াখালীর আল আমিন। তারা পালিয়ে প্রথমে স্বেচ্ছায় পুলিশের হাতে ধরা দেন। এরপর নিজ খরচে দেশে ফেরেন। খিলক্ষেতের রিক্রুটিং এজেন্সি রহমানিয়া করপোরেট-এর ম্যানেজার মতিউর রহমান ওই ২২ জনের আকামা ছিনিয়ে নেয়ার কথা স্বীকার করেন।

তবে ৫ মাসের বেতন বকেয়ার কথা অস্বীকার করে তিনি বলেন, তাদের শুধুমাত্র ১ মাসের বেতন বাকি ছিল। এরপর তারা কাজ না করে স্ট্রাইক করলে তাদের বের করে দেয়। তবে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। সৌদি আরবের কোম্পানি তাদের ফিরিয়ে ক্যাম্পে নিয়ে গেছে। তিনি বলেন, আমরা যতটুকু জেনেছি তাদের জেদ্দার হোটেলে নয়, রিয়াদের ক্যাম্পে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে।

বন্দিদের সঙ্গে হোটেলে থাকা অবস্থায় রোববার দুপুরে কথা হয়েছে জানালে তিনি বলেন, তাদেরকে এমনটাই বলা হয়েছে। তাদের আকামা ফেরত দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কোম্পানির সঙ্গে কথা হচ্ছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। মতিউর রহমান আরো বলেন, ওই ২২ জনের মধ্যে সবাই তাদের মাধ্যমে যায়নি। তাদের এজেন্সির মাধ্যমে গেছে ৭ থেকে ৮ জন। এমজমিন
এমটিনিউজ/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে