শুক্রবার, ১৩ অক্টোবর, ২০১৭, ০৭:৩৬:৩৯

রোহিঙ্গা ইস্যু ও কিছু কথা

রোহিঙ্গা ইস্যু ও কিছু কথা

এ.এস.এম. ইয়াহিয়া: মিয়ানমারকে নিয়ে নতুন করে ভূমিকা দেবার কিছু নেই। বিগত মাস কয়েকের রোহিঙ্গা নিধন দেখে সে ধারণা কিছুটা হলেও পেয়েছি আমি-আপনি তথা সারা বিশ্ববাসী।
এই গণহত্যা হয়তো মৃতের সংখ্যায় নাৎসি হত্যাযজ্ঞ, রুয়ান্ডা, পূর্বতীমুর আর বসনিয়াকে ছাড়িয়ে যায়নি এখনও। কিন্তু বিভীষিকার দিক দিয়ে তা উল্লেখিত সবকটি হত্যাযজ্ঞের সমতুল্য অবশ্যই।

যদিও আগে থেকেই মিয়ানমারের সাথে সারা বিশ্বের যোগাযোগ ততটা প্রসারিত নয়। গণমাধ্যমগুলো কেবলমাত্র কোনো ঘটনা ঘটলেই তাদের দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ঐ-ভূখণ্ডে। আর এখন যা ঘটছে তা মিয়ানমারের অতীত ঘটনাগুলোকে পেছনে পেলেছে অনেক আগেই। কিন্তু কেন ঘটছে, কি উদ্দেশ্যে ঘটছে কিংবা কেন মিয়ানমার প্রসাশন তা বন্ধ করার উদ্যেগ নিচ্ছে না? ইত্যাদি নানান প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে প্রতিটি বিবেকবান মানুষের মনে। সেসব প্রশ্নের উত্তর এখন খুঁজব এমনটা আমার উদ্দেশ্য নয়।

নিরীহ রোহিঙ্গাদের এভাবে স্রোতের মতো আমাদের এখানে আসার ফলে ইতিমধ্যে ঘটেছে বেশ কিছু বিপর্যয়। আর এই জনস্রোতকে যদি তাদের যথাস্থানে পূর্বের মতো পুনর্বাসিত করা না হয় তাহলে খুব শীঘ্রই ভিন্নমাত্রার আরও কিছু ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে।
সে বিষয়ে আমাদের সচেতন হতে হবে এখনই এবং সারা বিশ্বকে সাথে নিয়ে একযোগে পুরো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে হবে।

নানা কারণে আমরা উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের গণ্ডি পেরোতে পারিনি এখনও। অভ্যন্তরীন বহুবিধ সমস্যার কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মাত্রা ৭.৬-এর ওপর স্থায়ী হয়নি এখনও। জোর গলায় বলার উপায় নেই যে, বেকার সমস্যার সমাধান হয়েছে পুরোপুরি। বরং প্রতিমুহুর্তে একটু একটু করে বেড়েই চলেছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা। এখনও আছে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অসঙ্গতি। আর সেই সাথে গত বছরের ১লা জুলাইয়ের পর থেকে বয়ে বেড়াচ্ছি বৈদেশিক বিনিয়োগের ঘাটতি। ক্রমান্বয়ে যা এখন হয়েছে আরও তীব্র। সাথে আরও আছে মূল্যস্ফীতি-বাজেটঘাটতি-দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি-স্বজনপ্রীতি-দুর্নীতি। এতোকিছুর সাথে এখন এসে যুক্ত হলো রোহিঙ্গা ইস্যু। বিভিন্ন গনমাধ্যম হতে যা জানতে পারছি – তা ধীরে ধীরে ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে এগোচ্ছে বলেই মনে করা যায়।

শুনতে অশোভন শোনালেও বিপুল এই জনস্রোতের প্রত্যেকেই প্রায় অক্ষরজ্ঞানহীন। সেই সাথে ছিল আধুনিক সভ্যতার অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকেই বঞ্চিত। ব্যক্তি এবং রাষ্ট্রিয় সব পর্যায় থেকেই ছিল চরম অবহেলিত। অন্যদিকে বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে বাংলাদেশের মূদ্রার সাথে মিয়ানমারের মূদ্রার পার্থক্য আসলেই উল্লেখ করার মতো। যার অনুপাত ১:১৬.৬০ প্রায়। জি.ডি.পি’র হার ৬.৫ (২০১৬)।

আমাদের তুলনায় মিয়ানমারের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ততটা পিছিয়ে পড়া নয়। কিন্তু পিছিয়ে পড়া জনপদ হলো রাখাইন আর রোহিঙ্গা অধ্যুসিত এলাকাগুলো। এমনকি প্রাকৃতিকভাবেও ওখানকার ভূ-প্রকৃতি বেশ বন্ধুর। তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থাকে খাটো করে তুলে ধরা আমার উদ্দেশ্য নয়। আসলে সবকিছু মিলিয়ে রোহিঙ্গারা কতটা পিছিয়ে আছে তার একটা ছোট্ট ধারণা দিলাম মাত্র।

অমন অবহেলিত পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী প্রাণ বাঁচাতে প্রতিনিয়ত অনুপ্রবেশ করছে আমাদের ভূখণ্ডে। মানবিক বিবেচনায় এই আহত-অভুক্ত মানুষগুলোকে রাষ্ট্রিয়, ব্যক্তিগত আর বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায় থেকে চেষ্টা করা হচ্ছে নূন্যতম সহযোগিতা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার জন্য – যা দেশে বিদেশে সর্বত্র হয়েছে ভূয়সী প্রশংসীত। এখানে একটি ব্যাপার অবশ্যই লক্ষণীয় – মিয়ানমারের অনুপ্রবেশকারী এই জনসোতের মধ্যে সামর্থবান পুরুষের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো কম। বেশীরভাগই শিশু, বৃদ্ধ আর বিভিন্ন বয়সী মহিলা। দীর্ঘ সময় পুরুষহীন এ জনগোষ্ঠি আমাদের এখানে থেকে গেলে প্রজনন পরিবেশের ওপর এক বিরূপ প্রভাব পড়বে –যা অচিরেই সামাজিক অবক্ষয়ের মাধ্যমে সৃষ্টি করবে এক ভয়াবহ অস্থিরতার। চিরাচরিত পারিবারিক-সামাজিক বন্ধনকে তছনছ করে জন্ম দেবে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির।

এমনিতেই আমরা নানাভাবে আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশকে ধ্বংস করছি প্রতিনিয়ত। বন কেটে পাহাড় কেটে, কাঠ আর মাটি বিক্রি করে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছি মারাত্মকভাবে। এই কাটাকাটির সাথে এখন নতুন করে যুক্ত হয়েছে প্রাণভয়ে ছুটে আশা অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠি। যারা প্রতিনিয়ত নতুনভাবে বন-পাহাড় কেটে আশ্রয় নিচ্ছে টেকনাফ-কক্সবাজারের বিভিন্ন অঞ্চলে। যদিও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনী সর্বোপরি চেষ্টা করে যাচ্ছে অস্থায়ী ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় নিশ্চত করার। কিন্তু তারপরও এই প্রচেষ্টার বাইরে এখনও রয়েগেছে অনেকে এবং সেই সাথে প্রতিনিয়ত আগত রোহিঙ্গার দল নানাভাবে সম্মিলিত বাহিনীর চোখ এড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন প্রান্তরে। যা বাংলাদেশের ঐ অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতির ভারসাম্যকে দ্রুত ঠেলে দিচ্ছে ধ্বংসের দিকে। এ যেন আমাদের পরিবেশের জন্য মরার ওপর খাড়ার ঘাঁ। মানবিকতার উদাহরণ সৃষ্টি করতে গিয়ে আমরা যেন নিজেদের পরিবেশের ধ্বংসযজ্ঞ আশু ত্বরান্বিত না করি সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে সবার আগে।

এছাড়া আরও বড় বিপর্যয় হবে এই জনস্রোত আমাদের মূল জনগোষ্ঠীর সাথে যখন মিশে যাবে কালের আবহে। অর্থাৎ এদেরকে দীর্ঘদিন এভাবে ক্যাম্পবন্দী করে রাখা হবে আমাদের জন্য হিতে বিপরীত। এদের মাঝে যেমন রয়েছে মরণব্যাধি এইচ আই ভি পজেটিভ বাহক; তেমনি রয়েছে পিছিয়ে থাকা কুসংস্কারের অন্ধকারময় শিক্ষা। দেহ-শৈষ্ঠব; রঙ আর ভাষার কারণে একটু সুযোগ পেলেই মিশে যেতে পারবে আমাদের মূলজনগোষ্ঠিতে। এর উদাহরণ পাবার জন্য খুব বেশি দূরে যাবারও প্রয়োজন নেই – মধ্যপ্রাচ্যসহ অনেক দেশেই বাংলাদেশের নাগারক পরিচয় দিয়ে পুরনো রোহিঙ্গারা পাড়ি জমিয়েছে বেশ আগেই। আর সেসব দেশের বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে জড়িত হয়ে শাস্তি পাচ্ছে; বদনাম কুড়োচ্ছে বাংলাদেশ নিজে। কেননা ঐ রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবেই পরিচিত। এ জাতীয় সংবাদ বিভিন্ন গনমাধ্যমে শুনে-পড়ে আমরা অভ্যস্ত আছি অবশ্যই। আর এমুহূর্তে যে হারে রোহিঙ্গা আসছে তাতে করে উল্লেখিত আশঙ্কা সম্ভাবনাময় হিসেবে রূপলাভ করবে বলেই আমার বিশ্বাস। যদি তেমনটা হয় তাহলে সুদীর্ঘমেয়াদি এক আন্তঃরাষ্ট্রীয় অবক্ষয় অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।

কারণ এতে করে রোহিঙ্গাদের ঘিরে বাংলাদেশীদের মাঝে যে সহানুভূতি কাজ করছে এখন – তা পাল্টে গিয়ে জন্ম দেবে প্রচণ্ড ঘৃণার। কে জানে! ওষ্ঠাগত সাধারণ বাংলাদেশীরা আইনকে তুলে নিতে পারে নিজেদের হাতে। ক্রমান্বয়ে অবনতি হবে দেশের সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির।

রোহিঙ্গারা যে নির্দিষ্ট ক্যাম্পে না থেকে সাধারণ বাংলাদেশিদের সাথে মিশে যেতে চায় তার নমুনা এখনই প্রকাশ পাচ্ছে। যেমন সাহ্পরির দ্বীপসহ বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে আসা রোহিঙ্গারা প্রায় অনেকেই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর স্থাপিত রেজিস্ট্রেশন ক্যাম্পগুলোকে এড়িয়ে আসছে কৌশলে। যাদের বেশিরভাগেরই ইচ্ছা কক্সবাজার শহর ও চট্টগ্রাম শহরে পৌঁছানো। যা গত বেশ কয়েকদিন ধরে পরিবেশিত হচ্ছে বিভিন্ন গনমাধ্যমে।

সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে– গত মাস কয়েকের রোহিঙ্গা নির্মমতায় আমরা সকলেই ব্যথিত। এই পরিস্থিতি আবশ্যই অনাকাঙ্খিত এবং অনুচিত। আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা করা হচ্ছে মানবিক সহযোগিতা দেবার। কিন্তু মানবতার উদাহরন সৃষ্টি করতে গিয়ে এক দীর্ঘ মেয়াদি পারিবারিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক তথা রাষ্ট্রিয় অবক্ষ্যয়কে ডেকে নিয়ে এলাম কিনা তা ভাবতে হবে এখনই।-কালের কণ্ঠ।

(লেখক একজন সংবাদকর্মী)
এমটিনিউজ২৪ডটকম/আ শি/এএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে