বুধবার, ১৮ অক্টোবর, ২০১৭, ০১:০১:৫৭

যে তিন ইস্যু গুরুত্ব পাবে সুষমা স্বরাজের সফরে

যে তিন ইস্যু গুরুত্ব পাবে সুষমা স্বরাজের সফরে

মিজানুর রহমান : সব প্রস্তুতি চূড়ান্ত। আগামী সোমবার ঢাকা আসছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। বাংলাদেশ-ভারত জয়েন্ট কনসালটেটিভ কমিশন-জেসিসি’র চতুর্থ বৈঠকে নেতৃত্ব দিতে আসছেন তিনি। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, হাই প্রোফাইল ওই সফরের দ্বিপক্ষীয় স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট সব বিষয়েই কমবেশি আলোচনা হবে।

জেসিসি বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক ছাড়াও সুষমা স্বরাজের সাক্ষাৎ হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গেও তার বৈঠকের সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।

সিরিজ এসব বৈঠকে মোটা দাগে ৩টি ইস্যুতে তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা হবে। প্রথমত: রাজনৈতিক বিষয়াবলী। দ্বিতীয়ত: রোহিঙ্গা সংকট প্রসঙ্গ, তৃতীয়ত ও সর্বশেষ: অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন ও ব্যবস্থাপনা। বাংলাদেশে আগামী বছর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজনের প্রস্তুতি এরইমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।

প্রধানমন্ত্রীসহ শাসক দলের তরফে এবারের নির্বাচনটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে, অন্তত ৫ই জানুয়ারির মতো হবে না এমন বার্তা দেয়া হয়েছে তৃণমূলে। মাঠে থাকা আওয়ামী লীগ ও তার জোটের শরিকরাও এটা মানছেন এবং সে মতেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

বিপরীত দিকে বিগত নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় জাতীয় সংসদের বাইরে চলে যাওয়া প্রধান বিরোধী জোটও অনেকটা নীরবে নির্বাচনের জন্য ঘর গোছাচ্ছে। বাংলাদেশের নির্বাচন এবং রাজনীতিতে ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী ভারতের আকাঙ্ক্ষা বা মতামতের গুরুত্ব রয়েছে। আসন্ন নির্বাচন প্রশ্নে দিল্লির মনোভাবের বিষয়টি সুষমার সফরেই স্পষ্ট হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

তাছাড়া, এই মুহূর্তে বাংলাদেশে সবচেয়ে আলোচিত হচ্ছে নির্বাহী ও বিচার বিভাগের মধ্যে ‘ভুল বুঝাবুঝি’। ঐতিহাসিক এক রায় নিয়ে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার পর্যবেক্ষণ, সরকারের কর্তাব্যক্তিদের সমালোচনা এবং শেষ পর্যন্ত তার ছুটি! এ নিয়ে বিতর্ক থামছে না। ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমে বহুবার শিরোনাম হয়েছেন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি। তাকে নিয়ে ফলাও করে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে দেশটির বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল।

এ ঘটনাকে ‘বাংলাদেশের প্রথম হিন্দু প্রধান বিচারপতির হেনস্তা’ হিসেবেও তুলে ধরতে চাইছে কেউ কেউ। ভারতের সর্বাধিক প্রচারিত বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার এ নিয়ে সর্বশেষ যে রিপোর্ট করেছে তাতে বলা হয়েছে প্রধান বিচারপতিকে ঘিরে সৃষ্ট পরিস্থিতি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছে নয়াদিল্লি। আনন্দবাজারের রিপোর্টে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আসন্ন সফরে কথা বলবেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ।

স্পর্শকাতর এ ইস্যুতে সাউথ ব্লক প্রকাশ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে চাইছে না উল্লেখ করে ওই রিপোর্টে বলা হয়- ‘বাংলাদেশের নির্বাহী ও বিচার বিভাগের মধ্যকার সংঘাতকে অনভিপ্রেত মনে করছে দিল্লি। গণতান্ত্রিক সরকারের সঙ্গে বিচার বিভাগের বিরোধে রাজনৈতিক ব্যবস্থা যে দুর্বল হয়, তা বিলক্ষণ জানে নয়াদিল্লি। যা ভারতের জন্য একেবারেই শুভ সংকেত নয়।’

প্রধান বিচারপতির ছুটি নিয়ে বিদেশি সংবাদমাধ্যমের যে আগ্রহ রয়েছে তা আরেক দফা স্পষ্ট হয় দিল্লির ফরেন করেসপন্ডেন্টস ক্লাবে ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলীর ‘প্রেস মিট’-এ। সেখানে তিনি এ নিয়ে কথা বলেন।

সরকারের তরফে এতদিন যেসব বক্তব্য এসেছে তা থেকে পুরোপুরি ইউটার্ন করে হাইকমিশনার বিদেশি সংবাদকর্মীদের বলেন, প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা ছুটি থেকে ফিরে এসেই কাজে যোগ দিতে পারবেন! বিচারপতির সঙ্গে তার ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতার প্রসঙ্গ টেনে হাইকমিশনার বলেন, ‘আমি নিশ্চিত-তিনি যদি চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে কাল সকালে আবার দায়িত্ব নিতে চান তাতেও কোনো সমস্যা হবে না।’

রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে দিল্লির সুসংহত অবস্থান চায় ঢাকা: এদিকে দ্বিতীয় যে ইস্যুটি সুষমা স্বরাজের সফরে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাবে তা হলো রোহিঙ্গা সংকট প্রসঙ্গ। মিয়ানমারে সৃষ্ট এবং বাংলাদেশের ঘাড়ে চেপে বসা ওই সংকট নিয়ে প্রতিবেশী ভারতের সুসংহত অবস্থান চায় বাংলাদেশ।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সফরে এ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হবে জানিয়ে সফর প্রস্তুতির সঙ্গে যুক্ত এক কর্মকর্তা গতকাল বলেন, একান্তই মানবিক কারণে আমরা লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছি। আমরা চাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাদের রাখাইনে নিজ নিজ বসতভিটায় নিরাপত্তা ও মর্যাদার সঙ্গে ফেরত পাঠাতে। এ নিয়ে আমাদের অবস্থান খুবই স্পষ্ট এবং ইতিবাচক। আমরা বিশ্ব সমপ্রদায়ের সম্পৃক্ততায় মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয়ভাবে এ সংকটের শান্তিপূর্ণ এবং স্থায়ী সমাধান করতে চাই। এ ইস্যুতে যারা দৃঢ়ভাবে বাংলাদেশের পাশে রয়েছে এবং যাদেরকে এখনো কাছে টানা সম্ভব হয়নি-সবাইকে নিয়েই আমরা এ সংকটের সুরাহা চাই।

ওই কর্মকর্তা বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে প্রতিবেশী ভারতকে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে পাশে চায় বাংলাদেশ। কূটনৈতিক যোগাযোগে ভারত অবশ্য সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছে। ঢাকা এখন চাইছে ভারতের সেই অঙ্গীকারটি আরো সুসংহত হোক। আর তাই সুষমা স্বরাজের সফরে এ নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করবে বাংলাদেশ।

পানি বণ্টন ও ব্যবস্থাপনা গুরুত্ব পাবে; কথা হবে তিস্তা নিয়েও: এদিকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর প্রস্তুতির সঙ্গে যুক্ত দেশীয় কর্মকর্তা ও কূটনীতিকরা জানিয়েছেন, ওই সফরে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদীগুলোর পানি বণ্টন ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা হবে। কথা হবে দীর্ঘ সময় ধরে ঝুলে থাকা তিস্তার পানি চুক্তি নিয়েও।

সোমবার ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মুয়াজ্জেম আলী এ নিয়ে বলেন, বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কে নদী হলো একটি স্পর্শকাতর ইস্যু। বিস্তারিত হিসাব নিকাশের পরেই কোনো প্রকল্প নেয়া যেতে পারে। দুই দেশের মধ্যে বহমান নদীগুলোর পানি বণ্টন এখনো ভারতে একটি উদ্বেগের বিষয় হয়ে আছে। দীর্ঘদিন মুলতবি থাকা তিস্তার পানি ভাগাভাগি চুক্তি প্রসঙ্গে হাইকমিশনার সরাসরি কোনো মন্তব্য করেননি।

তবে এ নিয়ে যে সুষমা স্বরাজের ঢাকা সফরে কথা হবে সেদিকে তার স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল বলে জানিয়েছে ওই অনুষ্ঠান কভার করে সংবাদমাধ্যমগুলো। অভিন্ন নদীগুলোর মধ্যে তিস্তার অবস্থান চতুর্থ। ওই নদীর পানি বণ্টন চুক্তি ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সফরের সময়ে স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তিতে তা আটকে যায়। এখনো তা ঝুলেই আছে।

জেসিসি’র বৈঠকের এজেন্ডায় আরো যা থাকছে: সুষমা স্বরাজের সফর বিশেষ করে জেসিসির বৈঠকের এজেন্ডায় সন্ত্রাস ও উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ও ভারতের অভিন্ন অবস্থানের বিষয়টি থাকছে। এছাড়া জ্বালানি, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য, উপ-আঞ্চলিক সংযুক্তি সহ আরো বিষয় থাকছে বলে আভাস মিলেছে। ২০১১ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরে দু’দেশের মধ্যে সহযোগিতার ক্ষেত্র সমপ্রসারণে সই হওয়া ‘রূপরেখা’ চুক্তির আওতায় ভারত-বাংলাদেশ যৌথ পরামর্শমূলক কমিশন (জেসিসি) বৈঠক হয়ে আসছে।

এ পর্যন্ত জেসিসির ৩টি বৈঠক হয়েছে। যার দুটি দিল্লিতে আর একটি ঢাকায়। সেই সব বৈঠকে নিরাপত্তা, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো, লাইন অব ক্রেডিট, জনগণের আন্তঃযোগাযোগ, বাণিজ্য বাধা অপসারণ, সংস্কৃতি, পরিবেশ, শিক্ষাসহ দ্বিপক্ষীয় নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এবারের বৈঠকেও সেই আলোচনার ধারাবাহিকতা থাকবে বলে জানিয়েছেন চলতি সপ্তাহের শুরুতে ঢাকায় ওই সফর প্রস্তুতি বিষয়ে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় অংশ নেয়া কর্মকর্তারা। এমজমিন
এমটিনিউজ/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে