নিউজ ডেস্ক : মা রাজিয়া বেগম কথা বলতে পারতেন না। মুখে কিছু শব্দ করে ইঙ্গিত দিতেন। তবে অবিশ্বাস্যভাবে বিয়ের মাত্র ছয় মাসের মাথায় মা একটু একটু করে কথা বলতে শুরু করেন। আর আমার জন্মের পর মায়ের আচার-আচারণ ও কথাবার্তা অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে আসে। বাবার দাবি, তাবিজের জোরে এটা সম্ভব হয়েছে।
আমার জন্মের কিছুদিন আগে শুকরিয়া আদায়ের জন্য বাবা প্রথমে হজে যান। শুনেছি সেখানে তিনি আমার নাম মোঃ জয়নাল আবেদিন রাখার জন্য স্বপ্নে নির্দেশ পান। দেশে ফিরেই তিনি বিশাল মেজবানের আয়োজন করেন। উপলক্ষ ছিল ছেলের আকিকা। সুন্নতের সময়ও অন্তত বিশ হাজার লোকের খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। তার বিশ্বাস ছিল মানুষের দোওয়ায় আমার সকল বিপদ কেটে যাবে এবং বংশের মুখ উজ্জল হবে।
আমার সুন্নত করানো হয় ডাক্তার দিয়ে। এসময় আমার বেশ কষ্ট হয়েছিল। ধর্মপুরের কম্পাউন্ডার মকবুল আহমেদ আমার সুন্নত করেছিলেন। তিনি তখন সরকারি হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিমানঘাঁটি নির্মাণের সময় ইংরেজদের কাছ থেকে যে বিপুল অর্থ বাবা পেয়েছিলেন, তা তিনি ভাই-বোনদের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছিলেন। বিমানঘাঁটির নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর কিছু বিমান আসা-যাওয়া শুরু করে। এসময় কিছু বিমান হাঙ্গারে লুকিয়ে রাখা হয়। কিন্তু জাপানিরা এই বিমানঘাঁটির সন্ধান পেয়ে যায়। ফলে এই ঘাঁটিতে তারা তিনবার বোমাবর্ষণ করে। এসময় হাঙ্গারে লুকিয়ে রাখা বিমানগুলোতে আগুন ধরে যায়। সেই আগুনের লেলিহান শিখা মানুষ বহুদূর থেকে দেখেছে।
জাপানিদের বোমা হামলার ওই ক্ষত চিহ্ন আজও স্পষ্ট। বোমা হামলার সময় ওই অঞ্চলের লোকজন প্রাণভয়ে পালিয়ে যায়। আমাদের আত্মীয় স্বজনরাও এলাকা ছেড়ে রাজজীর দীঘির দক্ষিণ পার্শ্বে এসে স্থানীয়ভাবে বসবাস শুরু করে। এই এলাকায় আসার পর বাবা একটি মসজিদ স্থাপন করে। প্রথমে বেড়া দিয়ে মসজিদটি তৈরি করেন। পরে মসজিদটি পাকা করেন।
মসজিদের সঙ্গে একটি মক্তব ঘরও স্থাপন করা হয়। ওই মক্তবেই আমার প্রথম আরবি পড়ালেখা শুরু হয়। আমার বাবা মসজিদসংলগ্ন হাজারী পুকুরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে একটি ও পরে উত্তর পাড়ে আরও একটি ঘাটি তৈরি করেন। জায়গার সংকুলান হচ্ছে না দেখে পুকুরের পশ্চিমের পুরনো বাড়ি ছেড়ে দিয়ে তিনি উত্তর দিকে নতুন বাড়িতে চলে আসেন। সঙ্গে ছোট ভাই সোনামিয়া হাজারী ও তার পরিবারকে নিয়ে আসেন। অপর দুই ভাই পুরনো বাড়িতে থেকে যান।
আমার পড়ালেখার হাতেখড়ি বাবার প্রতিষ্ঠিত মক্তবে আরবি শিক্ষা দিয়ে। আমি খুব অল্প বয়সে তিনবার কোরআন খতম করেছিলাম । বয়স যখন ৫/৬ তখনই তাহাজ্জুতের নামাজ পড়ার জন্য বাবার সঙ্গে রাত তিনটায় মসজিদে যেতাম। বড় ছেলেকে বিখ্যাত আলেম বানাবেন এটাই ছিল বাবার স্বপ্ন। যারা আমার কোরআন তেলওয়াত শুনতেন তারাই বলতেন, নামকরা আলেম হবে।
আমার বয়স ৫ বছর হলে বাবা আমাকে নতুন জামা কাপড় পরিয়ে মাদ্রাসায় ভর্তি করানোর জন্য আমাকে নিয়ে রওনা দিলেন। প্রথমে নানার বাড়িতে নিয়ে গেলেন, নানা-নানিকে সালাম করানোর জন্য। আমার খালা পোশাক দেখেই হাসি ঠাট্টা
শুরু করে। নানাকেও খুব একটা খুশি মনে হলো না। সেখান থেকে বেরিয়ে মুন্সি পুকুরের উত্তর পাড়ে এলে বোচা মামার সঙ্গে দেখা হয়।
মামা তখন মাইনর স্কুলের শিক্ষক। স্কুলটির বর্তমান নাম সেন্ট্রাল হাই স্কুল। মামা আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ভাগিনা এসব কি পরছো? কোথায় যাচ্ছ? বাবা উত্তর দিলেন মাদ্রাসায় ভর্তি করাবো। মামা বললেন, হাবিবুল্লাহ পণ্ডিতের নাতি মাদ্রাসায় পড়বে? এটা হতে পারে না। মামা তখন বাবার হাত থেকে আমাকে জোর করে ছাড়িয়ে নিলেন।
এ সময় বাবা ও মামার মধ্যে বাদানুবাদ হলো। অবশেষে মামা আমাকে তার স্কুলে নিয়ে গেলেন এবং মাইনর ক্লাসে ভর্তি করে দিলেন। একইসঙ্গে মক্তবের পড়াও চলতে থাকলো। আমাদের বাড়ির প্রায় সবাই নুরুজ্জামান জ্যেঠা নামে এক হুজুরের কাছে আরবি পড়ালেখা শেখেন। আমার বাবাও নুরুজ্জামান জ্যেঠার কাছ থেকে ৭০ বছর বয়সে পাঠ নিয়েছিলেন।
লেখকঃ জয়নাল হাজারী
এমটিনিউজ২৪.কম/টিটি/পিএস