নিউজ ডেস্ক: এই সুন্দর বাক্যগুলো নিয়েই তৈরি মিয়ানমারের জাতীয় সঙ্গীত। উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের শিশুদের একটি স্কুল পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, সেখানকার খুদে শিক্ষার্থীরা তাদের নিয়মিত পাঠের সঙ্গে তাদের দেশ মিয়ানমারের জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে দেশের প্রতি শ্রদ্ধা জানান দিয়ে থাকে।
শিশু কসমিত আরা ও নজিমুল হাসান মনের সব আবেগ দিয়ে তার সহপাঠীদের নিয়ে গেয়ে চললো মিয়ানমারের জাতীয় সঙ্গীত। যদিও কিছুদিন আগে সেই দেশ থেকে তারা বহন করে এনেছে ভয়াবহ স্মৃতি আর স্বজন হারানোর বেদনা।
মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের তাদের দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকার না করে রোহিঙ্গাদের ‘বেঙ্বলি’ বলে সারাবিশ্বে অপপ্রচার চালাচ্ছে। অথচ মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শিশুরা বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্যাম্পে সাবলিলভাবে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ভাষা ও বার্মীজ ভাষায় তাদের শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গাদের উপরে জাতিগত নিধনমূলক অভিযানের পরে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া ওইসব শিশুদের বিশ্বাস তারা একদিন দেশে ফিরতে পারবে।
গত ২৫ আগস্ট থেকে রাখাইন রাজ্যে দমন-হত্যা অভিযান শুরুর পরে এখন পর্যন্ত প্রায় ৮ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এর মধ্যে তিন লাখের বেশি শিশু আছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। সমাজসেবা অধিদফতর প্রায় ৪০ হাজার এতিম রোহিঙ্গা শিশু শনাক্ত করেছে।
রোহিঙ্গা শিশুকে বার্মিজ ভাষায় ও ইংরেজি ভাষায় লেখাপড়া শেখানোর জন্য ইউনিসেফ, ব্র্যাক, সরকারের প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পাঁচ শতাধিক স্কুল স্থাপন করা হয়েছে বিভিন্ন ক্যাম্পে। সেখানে রোহিঙ্গা শিশুরা বয়স ও দক্ষতার ভেদে কয়েকটি গ্রেডে পড়ালেখা শিখছে।
স্কুলগুলোতে রোহিঙ্গা শিশুদের বর্ণ পরিচয় থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক চর্চার যথেষ্ট ব্যবস্থা রয়েছে। শিক্ষক হিসেবে সেসব স্কুলে কাজ করছেন কক্সবাজার জেলাসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামের স্থানীয় তরুণ-তরুণী, যারা রোহিঙ্গা ভাষা বুঝতে সক্ষম।
স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা মুক্তি কক্সবাজারের প্রধান নির্বাহী বিমল চন্দ্র দে চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ইউনিসেফের অর্থায়নে রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য স্থাপিত স্কুলগুলো পরিচালনা করছে মুক্তি কক্সবাজার। কুতুপালং ও বালুখালি ক্যাম্পের ওইসব স্কুলে বার্মীজ ও ইংরেজি ভাষায় শিশুদের শিক্ষা দান করা হয়ে থাকে। শিক্ষার পাশাপাশি তাদের মন থেকে মিয়ানমারে তাদের ও তাদের পরিবারের উপরে নির্যাতনের ক্ষত মুছে দিতে নানা আনন্দদায়ক কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে।
শুধুমাত্র বার্মিজ ভাষা ও ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি কিছু আরবী শিক্ষার জন্য কিছু মক্তব তৈরি হয়েছে। যারা আরবী শিক্ষার পাশাপাশি বার্মিজ ভাষা ও ইংরেজি ভাষায় শিক্ষা দানের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ওইসব মক্তব সাম্প্রতিক সময়ে দেশে আসা রোহিঙ্গা হাফেজদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে।
রোহিঙ্গা হাফেজ মোহাম্মদ আলী বলেন, এই মক্তবের কার্যক্রম রোহিঙ্গা হাফেজ ও মুরুব্বিদের দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশী অনেক মানুষ এই কার্যক্রমে সহায়তা করে থাকেন।
তবে এই স্কুলে শিশুদের মানসিক বিকাশ ও নির্যাতনের স্মৃতি কাটিয়ে উঠতে সহায়ক কোনো কার্যক্রম নেই বলে জানান তিনি।
রোহিঙ্গা ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয়ান ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত, যার সঙ্গে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার কিছুটা মিল রয়েছে। রোহিঙ্গা গবেষকগণ আরবি, হানিফি, উর্দু, রোমান এবং বার্মিজ স্ক্রীপ্ট ব্যবহার করে সফলতার সঙ্গে রোহিঙ্গা ভাষা লিখতে সক্ষম হয়েছেন। তবে আরাকান রাজ্যে রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন জাতীয় সার্টিফিকেট পরীক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে বার্মিজ ভাষা জানা আবশ্যক বলে চ্যানেল আই অনলাইনকে জানালেন ক্যাম্পে আসা আরেক শিক্ষিত রোহিঙ্গা যুবক ইউসুফ। ইউসুফ গতমাসে তার পরিবারের ৯ জন সদস্যকে নিয়ে ৪দিনের যাত্রায় বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের শিশু কসমিত আরা ও নজিমুল হাসানের ক্লাসের শিশুরা মিয়ানমারের সেই প্রচলিত ধারাতেই বার্মিজ ভাষাতে প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
স্কুলের বার্মিজ ভাষার শিক্ষক আমির ফয়সাল
পড়ালেখার পাশাপাশি আশার কথা হলো, একসময় রোহিঙ্গা শিশুরা তাদের আঁকা ছবিতে মিয়ানমারের ভয়াবহ যুদ্ধ, নির্যাতনের স্মৃতি তুলে আনলেও এখন আবার ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসছে বলে জানালেন জাতিসংঘ শিশু তহবিল ইউনিসেফের অনুদানে স্থাপিত ও মুক্তি কক্সবাজার পরিচালিত স্কুলের বার্মিজ ভাষার শিক্ষক আমির ফয়সাল। শিক্ষক আমির ফয়সাল নিজেও একজন রোহিঙ্গা। শিশুদের আঁকা বর্তমান ছবিগুলোতে শিশুসুলভ বিভিন্ন দৃশ্যপট ফুটে উঠতে শুরু করেছে বলে জানান তিনি।
শিশুদের আঁকা বর্তমান ছবিগুলোতে শিশুসুলভ বিভিন্ন দৃশ্যপট
রোহিঙ্গা শিশুদের মানসিক বিকাশে খাদ্য-বস্ত্রের পাশাপাশি কিছুটা আনন্দ দিতে ক্যাম্পের স্কুলের শিশুদের মধ্যে বিভিন্ন খেলনা বিতরণের কার্যক্রম পরিচালনা করেছে বাংলাদেশ ঘুড়ি ফেডারেশন।
ক্যাম্পের কয়েক হাজার শিশুর মধ্যে ফেডারেশন কর্মকর্তাদের দেয়া পুতুল, গাড়ি, বল, ঘুড়িসহ নানা উপকরণ পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে ওঠে শিশু রিজিয়া, ইসমত, আব্বাসসহ অনেক রোহিঙ্গা শিশু।
ঘুড়ি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান মৃধা বেনু চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, বিভিন্ন সংস্থা রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রীসহ বিভিন্ন কিছু দিচ্ছেন। কিন্তু শুধু খাদ্যই কিন্তু সব কিছু নয়, যে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের মধ্যে দিয়ে রোহিঙ্গারা আজকের এই পরিস্থিতির মধ্যে তা কাটিয়ে উঠতে কিছুটা বিনোদনও প্রয়োজন। বিশেষ করে রোহিঙ্গা শিশুদের তা আরও বেশি প্রয়োজন। সে লক্ষ্যই ক্যাম্পের শিশুদের মধ্যে আমরা পুতুল-ঘুড়িসহ কিছু ক্রিড়া ও বিনোদন সামগ্রী বিতরণ করেছি। ভবিষ্যতে এই কার্যক্রম আরও ক্যাম্পে ছড়িয়ে দেবার আশাবাদ জানান তিনি।
তাদের ওই কার্যক্রমের সঙ্গে প্রায় ৫০০ পরিবারের মধ্যে শিশু খাদ্য সহায়তা প্রদান করে বাংলাদেশ চীন চেম্বার অব কমার্স। ক্যাম্পের স্কুলের মাধ্যমে ওইসব খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে।
ক্যাম্পে অবস্থানরত রেজিষ্ট্রার্ড রোহিঙ্গাদের খাদ্যের মাসিক ব্যবস্থা ও বাসস্থানের সুবিধা জাতিসংঘের বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা ও বিদেশী উন্নয়ন সংস্থার আয়োজনে সুষ্ঠুভাবে করা হচ্ছে, যেসব কাজে সরাসরি সহায়তা ও তদারকি করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। তাদের দক্ষ ব্যবস্থাপনায় ত্রাণ থেকে শুরু করে নিরাপত্তা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। তবে ক্যাম্পে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের বিশেষ করে শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও মানসিক বিকাশের জন্য কার্যক্রম আরও বাড়ানো উচিত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
৮ নভেম্বর ২০১৭/এমটিনিউজ২৪/হাবিব/এইচআর