শুক্রবার, ১০ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:৩৩:২৪

আদালতে দেওয়া খালেদার পুরো বক্তব্য

আদালতে দেওয়া খালেদার পুরো বক্তব্য

নিউজ ডেস্ক : সাহস ও সততার সঙ্গে সরকারের প্রভাবমুক্ত থেকে আইন অনুযায়ী ন্যায়বিচারের আহবান জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।

দেশের বিচার ব্যবস্থা প্রতিনিয়ত প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে দাবি করে ও ইতিহাসের কিংবদন্তিদের বিচারের ঘটনাগুলো তুলে ধরে তিনি আদালতের প্রতি এ অনুরোধ জানান।

খালেদা জিয়া বলেন, তার বিরুদ্ধে বিচারাধীন এ মামলার রায়ের মাধ্যমে প্রমাণিত হবে, বিচারকগণ স্বাধীনভাবে, বিবেকশাসিত হয়ে এবং আইনসম্মতভাবে বিচারকার্য পরিচালনা করতে সক্ষম কিনা?

ঢাকার বকশিবাজার আলীয়া মাদরাসা মাঠে স্থাপিত বিশেষ আদালতে ফৌজদারী কার্যবিধির ৩০৪২ ধারায় আত্মপক্ষ সমর্থন করে দেয়া ৪র্থ দিনের বক্তব্যে তিনি এসব মন্তব্য করেন।

আদালতে দেওয়া বেগম খালেদা জিয়ার অসমাপ্ত জবাববন্দির পূর্ণ বিবরণ তুলে ধরা হল:

শাসক মহলের ইচ্ছা অনুযায়ী আমাদের বিরুদ্ধে কোনো একটা রায় দেওয়া হবে। কিন্ত আমি বিশ্বাস করতে চাই যে, আপনি সাহস ও সততার সঙ্গে সরকারের প্রভাব থেকে মুক্ত থেকে আইন অনুযায়ী ন্যায়বিচার করবেন। আমাদের বিচারব্যবস্থা সম্পূর্ণ স্বাধীন দাবি করা হলেও সাম্প্রতিক বিভিন্ন উদাহরণ সেই দাবিকে প্রতিনিয়ত প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

এই স্বাধীনতার দাবির বিশ্বাসযোগ্যতা বর্তমান মামলাতেও অনেকখানি বোধগম্য হবে। প্রমাণিত হবে, বিচারকগণ স্বাধীনভাবে, বিবেকশাসিত হয়ে এবং আইনসম্মতভাবে বিচারকার্য পরিচালনা করতে সক্ষম কিনা।

মাননীয় আদালত,
আমাদের এই দেশে ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায়ে বিচারের নামে অবিচারের বিভিন্ন নমুনা আমরা দেখেছি। আমাদের জাতীয় ইতিহাসের একজন প্রভাবশালী নির্মাতা মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান। তাকেও দুর্নীতির মামলার বিচারে কারাদন্ড দেয়া হয়েছিল।

মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও অলি আহাদের মতো জাতীয় নেতৃবৃন্দকেও কারাদ- ভোগ করেতে হয়েছে।আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে কবিতা রচনার দায়ে রাষ্ট্রদ্রোহী সাব্যস্ত করে কারাদ- দেয়া হয়েছিল।

এই উপমহাদেশে মহাত্মা গান্ধী, মওলানা শওকত আলী-মোহাম্মদ আলী, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, চিত্তরঞ্জন দাস ও জওহর লাল নেহেরুর মতো নেতাদেরকেও কোনো না কোনো আদালতের রায়েই কারাদন্ড ভোগ করতে হয়েছে। নেলসন ম্যান্ডেলা, মার্টিন লুথার কিং, বার্ট্রান্ড রাসেল এবং বেনিগনো আকিনোর মতো মানুষদেরকেও কোনো না কোনো বিচারেই সাজা দেওয়া হয়েছে।

তথাকথিত সেইসব রায়ের পিছনেও কোনো না কোনো যুক্তি, অজুহাত ও আইন দেখানো হয়েছিলো। হযরত ইমাম আবু হানিফা ও সক্রেটিসের মতো মহামানবদেরকেও তো বিচারের নামেই সাজা দেয়া হয়েছিল। সেই সব বিচারকে কি বিশ্ববাসী ন্যায়বিচার বলে মেনে নিয়েছে? ইতিহাসের ধোপে সে সব রায় কি টিকেছে?

যাদেরকে অপরাধী সাব্যস্ত করে সাজা দেয়া হয়েছিল, বিশ্বমানবতা ও ইতিহাস তাদেরকেই দিয়েছে অপরিমেয় মহিমা। ইতিহাস রায় দিচ্ছে, নিরপরাধকে অপরাধী সাব্যস্ত করে যারা রায় দিয়েছিলেন তারাই প্রকৃত অপরাধী। তাদের জন্য পারলৌকিক সাজা তো নির্ধারিত আছেই।

এই পৃথিবীতেও তাদের নাম ও স্মৃতি যুগ যুগ ধরে অগণিত মানুষের ঘৃণা ও ধিক্কার কুড়াচ্ছে। এ জগত যতদিন থাকবে, মানুষ যতদিন থাকবে, ইতিহাস যতদিন পাঠ করা হবে এবং যতদিন মানুষের স্মৃতি থাকবে, ততদিনই তাদের প্রতি চলতে থাকবে এই ঘৃণা ও ধিক্কার।

মাননীয় আদালত,
ইতিহাসের এই সব শিক্ষা থেকে কেউ কেউ শিক্ষা নেন। আবার কেউ কেউ কোনো শিক্ষা গ্রহণ করেনা। যারা শিক্ষা নেন, মানুষ ও ইতিহাস তাদেরকে সম্মানিত করে। আর যারা কোনো শিক্ষা নেয় না, তাদের ঠাঁই হয় ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে, আর মানুষের ঘৃণা ও ধিক্কারে। সময়ের পরিক্রমায় আজকের সময়ও এক সময় ইতিহাস হবে।

আলোচ্য এ মামলাটিও নিশ্চয়ই ইতিহাসের এক মূল্যবান উপকরণ হবে। কাজেই এই পটভূমিতে আপনি ইতিহাসের শিক্ষা থেকে কোনো শিক্ষা গ্রহন করবেন কি-না, সেই সিদ্ধান্ত আপনাকেই নিতে হবে। এরজন্য আপনাকে নির্ভর করতে হবে সুবিবেচনা, প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা, সাহস ও সততার ওপর। অনাগত দিন বলে দেবে, আইন ও বিবেক দ্বারা পরিচালিত হয়ে আপনি সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে পেরেছিলেন কি-না।

মাননীয় আদালত,
আপনিও নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে একমত হবেন যে, মতবৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য ও সমন্বয়ই হচ্ছে গণতান্ত্রিক সমাজের সৌন্দর্য্য। ভিন্নমত দলন ও দমন নয়, প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসা নয়, বরং ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহ-অবস্থানকে উৎসাহিত না করলে গণতন্ত্র টেকানো যায় না। আমরা সে কথা জানি, বুঝি এবং মানি।

আপনি জানেন, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষগুলোর মধ্যে ভিন্নমত ও দাবি আদায়ের পন্থা এ দেশে বারবার কতোটা সহিংস হয়ে উঠেছে। আমি বেশি পেছনে ফিরে যাবো না। সাম্প্রতিক অতীত থেকেই আমি কিছু উদাহরণ দেব। আজ যারা ক্ষমতায় আছে, সেই আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি এবং তাদের এক সময়কার ঘনিষ্ঠ মিত্র ও সহযোগী জামায়াতে ইসলামী মিলে দেশে কী ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল তা আপনি জানেন।

নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদের নির্বাচনের বিধানের দাবিতে তারা আন্দোলনের নামে দেশে কী সহিংস হানাহানি ও নৈরাজ্যকর অবস্থার সৃষ্টি করেছিল তা সকলেই জানে। দিনের পর দিন হরতাল-অবরোধে তারা জনজীবনকে অচল করেছে।

আমাদের জাতীয় অর্থনীতির ‘লাইফ লাইন’ সমূদ্রবন্দরকে দীর্ঘদিন বন্ধ করে রেখেছে। রেলস্টেশন জ্বালিয়ে দিয়েছে। সাধারণ মানুষকে বহনকারী যানবাহনে বোমা মেরেছে এবং আগুন দিয়ে পুড়িয়েছে। গান পাউডার দিয়ে আগুন ধরিয়ে চলন্ত বাসের বহু নিরাপরাধ যাত্রীকে তারা জ্যান্ত পুড়িয়ে মেরেছে।

বিভিন্নভাবে আরো বহু মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। কর্তব্যরত পুলিশ অফিসারের মাথা তারা ইট দিয়ে থেঁৎলে দিয়েছে। অফিসগামী বয়স্ক মানুষকে রাস্তায় ধরে প্রকাশ্যে দিগম্বর করেছে। মেয়েদেরকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করেছে। সচিবালয়ের ভেতরে হাঙ্গামা করেছে এবং বিভিন্ন জায়গায় নোংরা ছড়িয়ে দিয়েছে।

দীর্ঘদিন ধরে রাস্তা অবরোধ করে টানা অবস্থান নিয়ে জনচলাচল বন্ধ করে রেখেছে। সিভিল প্রশাসনে বিদ্রোহ ও বিশৃঙ্খলা উস্কে দিয়েছে। সর্বোপরি, গণতন্ত্র ধ্বংস করে সশস্ত্র বাহিনীকে ক্ষমতা দখলের জন্য প্রকাশ্যে উস্কানি দিয়েছে। আমি বিস্তারিত বিবরণ দিতে চাই না। ২০০১ সালে জনগণের বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে আমরা আবারো সরকারে আসি।

তারপর আবারো শুরু হলো রাজপথে আন্দোলনের নামে সহিংস হানাহানি। যা আমাদের পুরো মেয়াদ জুড়ে অব্যাহত ছিল। সেই সহিংসতা থেকে পুলিশ, বিচার বিভাগ, সুপ্রিমকোর্ট, প্রধান বিচারপতির এজলাস পর্যন্ত কোনো কিছুই রেহাই পায়নি। সেই ধারাবাহিক সন্ত্রাসের পরিসমাপ্তি ঘটে প্রকাশ্য রাজপথে পৈশাচিক কায়দায় লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে অনেক মানুষকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে।

এসব কর্মকান্ডের পরিণামও শুভ হয়নি। হানাহানির অজুহাতে জাতীয় নির্বাচনের প্রক্রিয়াকে স্থগিত করে দিয়ে তখনকার সেনাপ্রধান অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে নেয়। তার অনুগত একটি গোষ্ঠীকে নিয়ে তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা জরুরি সরকার গঠন করে। তাদেরকে সামনে রেখে সেনাপ্রধান সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। নির্বাচন পিছিয়ে সেই অবৈধ শাসনকে দুই বছর পর্যন্ত প্রলম্বিত করা হয়।

আপনি জানেন, আমি এই অবৈধ প্রক্রিয়াকে সমর্থন করিনি। বরং এখন যারা জনগণের ভোট ছাড়াই অবৈধভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত, তারাই সেদিন বিপুল উৎসাহ ও উল্লাস নিয়ে সেদিনের অবৈধদের সমর্থন করেছিলেন।

বলেছিলেন, ওটা তাদেরই আন্দোলনের ফসল। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই ঐ অবৈধ শাসকদের আসল চেহারা ও উদ্দেশ্য সকলের সামনে পরিষ্কার হয়ে যায়। আমি এবং শেখ হাসিনা, এই দু’জনকেই জোর করে ‘মাইনাস’ করার উদ্দেশ্যে তারা সব ধরণের তৎপরতা শুরু করে। আমাকে গৃহবন্দী করা হয়।

বিদেশ সফররত শেখ হাসিনার দেশে ফেরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়। তিনি দেশে ফিরে এলে তাকে গ্রেফতার করা হয়। আদালত প্রাঙ্গণেই তিনি চরম অশোভন আচরণের শিকার হন। আমি কিন্তু তখন চুপ করে থাকতে পারতাম। কিন্ত অন্যায়কে আমি মেনে নেইনি। গৃহবন্দী অবস্থা থেকেই আমি শেখ হাসিনার প্রতি সেই অন্যায় আচরণের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম।

আমি আমার বিবৃতিতে তার মুক্তি দাবি করেছিলাম। এই প্রসঙ্গে সে সময়কার কিছু কথা বলতে হয়। মঈনউদ্দিন-ফখরুদ্দিনের জরুরি সরকার কোনো বৈধ সরকার ছিলো না। সেই সরকার সংবিধান অনুযায়ী গঠিত হয়নি। জোর করে অস্ত্রের মুখে তারা ক্ষমতা নিয়েছিলো। প্রায় দুই বছর জরুরি অবস্থা জারি করে অবৈধভাবে ক্ষমতায় ছিলো।

আমি কখনো কোনোভাবে তাদেরকে সমর্থন করতে পারিনি। তারা আমার সমর্থন চেয়েছিলো। আমাকে সপরিবারে নিরাপদে দেশত্যাগ করার জন্য তারা বলেছিলো। আমি তাদের কথা মানিনি। আমার নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভাবিনি। আমি তাদেরকে স্পষ্টভাষায় বলেছি, বাংলাদেশের বাইরে আমার কোনো ঠিকানা নেই।

জীবনে-মরণে আমি বাংলাদেশেই থাকতে চাই।শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ সেই অবৈধ সরকারকেই সমর্থন করেছিলো। তারা তাদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানেও সানন্দে যোগ দিয়েছিলেন। তাদের পরামর্শে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়েছিলেন।

যাবার সময় বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের কাছে বলে গিয়েছিলেন যে, সেই অবৈধ সরকার তাদেরই আন্দোলনের ফসল। তিনি তাদের সকল কাজের বৈধতা দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন। এমনকি, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও আমার বড় ছেলে তারেক রহমানের দিকে ইঙ্গিত করে তাকে গ্রেপ্তার করার জন্যও সেই অবৈধ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন।

মাননীয় আদালত,
আপনি জানেন, ফখরুদ্দিন-মঈনউদ্দিনের অবৈধ সরকার মিথ্যা মামলায় আমাকে এবং আমার দুই ছেলেকে গ্রেফতার করেছিলো। বন্দী অবস্থায় পৈশাচিক নির্যাতন চালিয়ে তাদেরকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিলো। আমার বড় ছেলে তারেক রহমান সেই নির্যাতনে পঙ্গু হয়ে এখনও বিদেশে চিকিৎসাধীন। আমার ছোট ছেলেটি আর সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন ফিরে পায়নি। বিদেশে চিকিৎসাধীন অবস্থাতেই সে অকালে আমাদেরকে ছেড়ে চিরবিদায় নিয়েছে। সন্তানের অকাল মৃত্যুর সেই দুঃসহ ব্যথা বুকে চেপে আমি এখনও দেশের জন্য, মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছি।

মঈনউদ্দিন-ফখরুদ্দিনের অবৈধ সরকারের জুলুম-নির্যাতন ও স্বেচ্ছাচারি কার্যকলাপের কথা নিশ্চয়ই আপনি ভুলে যাননি। ব্যবসায়ীসহ যাকে-তাকে মিথ্যা অজুহাতে ধরে নিয়ে সে সময় তারা টাকা আদায় করতো। রাজধানী ঢাকার অভিজাত এলাকায় জমি-বাড়ি দখলের কাজেও তারা বিভিন্ন পক্ষে প্রভাব খাটিয়েছে।

আইন-আদালত ও বিচার ব্যবস্থাকে তারা তাদের নির্দেশে চালিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষক এবং সাংবাদিকদের উপর তারা নির্যাতন করেছে। এতো অপকর্ম করেও মঈনউদ্দিন-ফখরুদ্দিনরা বিদেশে আরাম-আয়েশে দিন কাটাচ্ছে। আজ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগও দায়ের করা হয়নি।

তাদের অন্যতম দোসর মাসুদউদ্দিন চৌধুরীকে দীর্ঘদিন রাষ্ট্রদূত হিসাবে বহাল রেখে লালন-পালন করা হয়েছে। এ সবের কারণ, আওয়ামী লীগ তাদের সঙ্গে আঁতাত করে ক্ষমতায় এসেছিলো। ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনকে নানাভাবে প্রভাবিত করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনা নিশ্চিত করা হয়েছিলো।

অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করলেও মঈনউদ্দিন-ফখরুদ্দিনের পক্ষে যখন আর ক্ষমতায় থাকার কোনো উপায় ছিলো না, তখন তারা নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। কেননা আমাদের বলিষ্ঠ ভূমিকার কারণে দেশের ভিতরে ও বাইরের পরিস্থিতি অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিলো। তারা আমার সঙ্গেও সমঝোতার চেষ্টা করেছে।

নানা রকম প্রস্তাব নিয়ে আমার কাছে গেছে। আমি তাদের কোনো প্রস্তাবে রাজি হইনি। আমি স্পষ্ট বলে দিয়েছি, অবৈধ শাসকদের সঙ্গে কোনো রকম সমঝোতা আমি করবো না। জরুরি অবস্থা তুলে দিয়ে তাদেরকে নির্বাচন দিয়ে চলে যেতে হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ তাদের সঙ্গে আতাত করেই ক্ষমতায় গিয়েছিলো।

তারপরেও আমরা সাংবিধানিক শাসন ও গণতন্ত্রের স্বার্থে ওই কারসাজির নির্বাচনের ফল মেনে নিয়েছিলাম। আমরা সরকারকে সহযোগিতা করার কথা বলেছিলাম। কিন্ত আমাদের সহযোগিতার আহ্বানের বিনিময়ে তারা আমাদের সঙ্গে কী আচরণ করেছে তা সকলেরই জানা।

মাননীয় আদালত,
প্রতিহিংসার বিপরীতে সংযম, সহিষ্ণুতা ও সমঝোতার পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা আমি বরাবর করে এসেছি। কিছুদিন আগেও আমি একটি সংবাদ-সম্মেলন করে অতীতের সকল তিক্ততা ভুলে ক্ষমার কথা তুলে ধরি।

আমি পরিষ্কার ভাষায় ঘোষণা করি যে, আমার এবং শহীদ জিয়াউর রহমানসহ আমার পরিবারের অন্যান্য সদস্যের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার ক্রমাগত অশোভন উক্তি এবং প্রতিহিংসামূলক বৈরী আচরণ সত্বেও আমি ব্যক্তিগতভাবে তাকে ক্ষমা করে দিচ্ছি।

আমি তার প্রতি কোনো প্রতিহিংসাপ্রবণ আচরণ করবো না। আমি আহ্বান জানিয়েছিলাম, আসুন, রাজনীতিতে একটি সুন্দর, শোভন ও সহিষ্ণু সংস্কৃতি গড়ে তুলি। যা গণতন্ত্রের জন্য খুবই প্রয়োজন।

ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে আমাদের কাছ থেকে ভালো কিছু শিখতে পারে। পারষ্পরিক শ্রদ্ধা ও সমঝোতার পরিবেশ গড়তে আমাদের মরহুম জাতীয় নেতৃবৃন্দকে সম্মানিত করার ব্যাপারে ঐক্যমতের ভিত্তিতে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হবার জন্যও আমি বিভিন্ন সময়ে প্রস্তাব দিয়েছি।

এছাড়াও, বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ খোঁজার ব্যাপারেও আমাদের প্রস্তাব সব সময় ছিল এবং এখনো আছে। ইতিমধ্যে আমি সমঝোতার মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনা, জনগণের ক্ষমতা তাদের হাতে ফিরিয়ে দেয়া, সামাজিক ইনসাফ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার রূপকল্প ভিশন-২০৩০ ঘোষণা করেছি।

কিন্তু এসব উদারতার জবাব আমাদেরকে কোন্ ভাষায় দেয়া হচ্ছে, তার প্রমাণ সকলেই পাচ্ছেন এবং আপনিও জানেন। তাদের কী অবস্থ? দেশে গণতন্ত্র নেই। কার্যকর সংসদ নেই। নির্বাচনী ব্যবস্থাকে প্রহসনে পরিণত করা হয়েছে।

খুন, অপহরণ, গুম, নির্যাতন ও বিচারহীনতার এক স্বেচ্ছাচারী রাজত্ব চলছে। দেদারছে চলছে ক্ষমতার অপব্যবহার। কারাগারগুলো রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও ভিন্নমতের মানুষ দিয়ে ভরে ফেলা হয়েছে। কথায় কথায় মামলা-হামলা, গ্রেফতার ও নির্যাতন চলছে। প্রতিবাদের কোনো সুযোগ নেই।

টু-শব্দটি করলেই নির্যাতনের খড়গ নেমে আসছে। চলছে সন্ত্রাস, দখল ও দলীয়করণের বিভীষিকা। বয়োবৃদ্ধ মানুষদের পর্যন্ত দিনের পর দিন পুলিশী রিমান্ডে নেয়া হচ্ছে। সংবাদ-মাধ্যম শৃঙ্খলিত। সম্পাদক ও সাংবাদিকরা বন্দী হচ্ছেন। ব্যাপকভাবে আলোচিত সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি নৃশংসভাবে খুন হলেও বিচার হচ্ছে না।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এবং যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মানবাধিকার বিষয়ক প্রতিবেদনে পরিস্থিতি সম্পর্কে নিয়মিত উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে। নারী-শিশুরা নির্যাতিত ও নিহত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ব্লগার, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও বিভিন্ন ধর্মের লোক, এমনকি বিদেশীরা খুন হচ্ছেন। সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত হচ্ছে, তাদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে।

কোথাও কারো কোনো নিরাপত্তা ও অধিকার নেই। অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে নির্বিচারে গুলি করে প্রতিবাদী মানুষদের হত্যা করা হচ্ছে। ছাত্র ও শিক্ষকদের হত্যা করা হচ্ছে। এগুলো কি ক্ষমতার অপব্যবহার নয়? ক্ষমতার অপব্যবহার আমি করেছি? শেয়ার বাজার লুঠ করে লক্ষ কোটি টাকার তছরূপ হয়ে গেল। নিঃস্ব হলো নিন্ম আয়ের মানুষ। ব্যাংকগুলো লুঠপাট করে শেষ করে দেয়া হচ্ছে।

একটি বেসরকারি সংস্থার হিসেবে গত ৭ বছরে ব্যাংক থেকে চুরি হয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী ব্যাংকলুটের হাজার হাজার কোটি টাকাকে ‘সামান্য’ বলে অভিযোগ উড়িয়ে দিচ্ছেন। কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের নামে দায়মুক্তি দিয়ে সীমাহীন দুর্নীতির সুযোগ করে দেয়া হয়েছে।

দুর্নীতির প্রমাণিত অভিযোগের সাজা সুপ্রিম কোর্টে বহাল থাকা ব্যক্তিরও মন্ত্রিসভায় ও সংসদে সদস্যপদে বহাল থাকছে। জনগণের অর্থ এবং জনস্বাস্থ্যের তোয়াক্কা না করে পচা গম আমদানির জন্য দায়ী লোকও বহাল তবিয়তে মন্ত্রিত্ব করছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার নামে আইটি খাতে বিশাল দুর্নীতি চলছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকে গচ্ছিত রিজার্ভের অর্থ থেকে ৮শ’ কোটি টাকা কারসাজি করে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে সম্পন্ন বিচারের নথিতে প্রধানমন্ত্রীর প্রবাসীপুত্রের সন্দেহভাজন একটি একাউন্টেই প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ অর্থের কথা এসেছে।

সে ব্যাপারে কোনো উচ্চবাচ্য না করে অপ্রমাণিত অভিযোগে মামলা করে সাংবাদিকদের গ্রেফতার ও হেনস্তা করা হচ্ছে। অপপ্রচার করা হচ্ছে বিএনপির বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের গরীব মনুষের অর্থ চুষে সুইস ব্যাংকের একাউন্টগুলোতে জমানো টাকার স্তুপ ফুলে ফেঁপে উঠছে। ২০১৫ সালে শুধু এক বছরেই এই সব একাউন্টে বেড়েছে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। গত ১০ বছর ধরে বিএনপি ক্ষমতায়

এই দশ বছরে ওয়াশিংটন-ভিত্তিক গবেষনা সংস্থা ‘জিএফআই’-এর হিসাবে দেশ থেকে প্রায় সাড়ে চার লক্ষ কোটি টাকার বেশি বিদেশে পাচার হয়েছে। ফাঁস হওয়া পানামা পেপার্সে বিদেশে অবৈধ পথে ক্ষমতাসীনদের পাচার করা বিপুল অর্থের খবর প্রকাশিত হয়েছে। অফসোর কোম্পানিগুলোতে কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে। এই কেলেংকারি নিয়ে দুদক একটি মামলাও দায়ের করেনি।

দেশে এখন কোনো খাতই অবাধ লুটপাট থেকে মুক্ত নয়। অথচ এখনো প্রচারণা ও মামলা চলছে আমাদের বিরুদ্ধে। দেশের সম্পদ লুট করে কারা, আর মামলা দিয়ে হেনস্তা করা হয় কাদেরকে? অপপ্রচার চলে কাদের বিরুদ্ধে? আমাদের বিরুদ্ধে তো কম অপপ্রচার করা হয়নি।

সারা দুনিয়ায় চষে বেড়িয়ে এবং সব তন্নতন্ন করে দেখে কয় লাখ বা কয় কোটি টাকার অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ আজ পর্যন্ত আনতে পেরেছে? অথচ তাদের বিরুদ্ধে এক-একটি ঘটনাতেই শত শত, হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ আজ সকলের মুখে মুখে।

মাননীয় আদালত,
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশে তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ও প্রতিপক্ষরা কখনো সহ্য করতে পারে না। সে কারণেই শহীদ জিয়ার নাম ও তার স্মৃতি বিজড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোকে টার্গেট করে ধ্বংসের চেষ্টা চলছে।

শহীদ জিয়ার আদর্শের উত্তরাধিকারী হিসাবে আমাকে এবং আমার পরিবারের সদস্যদের হেয় ও হেনস্তা করার অব্যাহত চেষ্টা সম্পর্কেও সকলে ইতিমধ্যে জেনে গেছেন। সেই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবেই যে এ মামলা দায়ের করা হয়েছে তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। এমজমিন
এমটিনিউজ/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে