জুলকার নাইন : বিশ্ব ক্ষমতার মানদণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ছয় দেশের হেভিওয়েট প্রতিনিধিরা আসছেন ঢাকা সফরে। ১৮ থেকে ২১ নভেম্বরের মধ্যে আসছেন চীন, জাপান, জার্মানি, সুইডেন ও কানাডার পররাষ্ট্র ও উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রী এবং মার্কিন সিনেটের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির সদস্য হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সিনিয়র কয়েকজন রাজনীতিক।
মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদোতে ২০ ও ২১ নভেম্বর এশিয়া ইউরোপ মিটিং-আসেম পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলন উপলক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা একই সময়ে এ অঞ্চলে আসছেন। প্রথমেই তারা বাংলাদেশে আসবেন, পরে যাবেন অন্যান্য সূচিতে।
মূলত রোহিঙ্গা সংকট থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের বিষয়াদি নিয়েই আলোচনা হবে এসব সফরে। কেউ কেউ সরেজমিন দেখতেও যাবেন রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি। তবে বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী এসব শক্তিশালী রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সফরে বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের দ্বিপক্ষীয় বিষয়গুলোও থাকবে আলোচনার অগ্রাধিকার তালিকায়।
প্রাথমিকভাবে চূড়ান্ত সফরসূচি অনুসারে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই, জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিগমার গ্যাব্রিয়েল ও সুইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারগট ওয়ালস্টার ১৮ নভেম্বর ঢাকা এসে পৌঁছবেন। পরদিন ১৯ নভেম্বর ঢাকায় পৌঁছবেন জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তারো কোনো।
কানাডার আন্তর্জাতিক উন্নয়নমন্ত্রী মারি ক্লদ বিবু আসবেন ২১ নভেম্বর। এর আগে ১৮ বা ১৯ নভেম্বর ঢাকা আসবেন মার্কিন সিনেটের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির প্রতিনিধি দল। হেভিওয়েট এই প্রতিনিধিরা ঢাকায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে বৈঠক করবেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ সূচি নির্ধারণের বিষয় নিয়েও কাজ করছেন সংশ্লিষ্ট কূটনীতিকরা। এর বাইরে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠক করবেন অতিথি পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি ও অন্যান্য মানবিক বিষয়াদি সরেজমিন ঘুরে দেখবেন কানাডার আন্তর্জাতিক উন্নয়নমন্ত্রী মারি ক্লদ বিবু ও মার্কিন সিনেটের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির সদস্যরা।
আলাদাভাবে তারা সরেজমিন কক্সবাজারের কুতুপালং ক্যাম্প পরিদর্শন করে নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের মুখেই তাদের ওপর চালানো বর্বরতার কথা শুনবেন। ঢাকায় ফিরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে বৈঠক করবেন উত্তর আমেরিকার এসব শীর্ষ রাজনীতিক।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ ছয় দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ও প্রতিনিধিদের ঢাকা সফরকে গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী তার মিয়ানমার সফরও পিছিয়ে দিয়েছেন। আসেম সম্মেলনের আগে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলীকে ১৬-১৭ নভেম্বর সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল মিয়ানমার। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেই সূচি পিছিয়ে ২৩ নভেম্বর দ্বিপক্ষীয় আলোচনার কথা জানিয়ে দিয়েছে মিয়ানমারকে।
অবশ্য আসেমের বৈঠক উপলক্ষে এর আগেই তিনি নেপিদো পৌঁছবেন। ঢাকা সফর শেষ করে চীন, জাপান, সুইডেন ও জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রীরাও একই সময়ে নেপিদো পৌঁছবেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, শক্তিধর রাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের দায়িত্বে থাকা মন্ত্রীদের সফর সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এবারের ভিন্ন পরিস্থিতিতে এর আলাদা মাত্রা রয়েছে।
কারণ রাখাইন সংকটে এখন ভারগ্রস্ত বাংলাদেশ। সংকটের স্রষ্টা মিয়ানমারের ওপর তৈরি করা হয়েছে বৈশ্বিক চাপ। সেই মিয়ানমারে অনুষ্ঠেয় আসেম সম্মেলনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে অংশ নিতে যাচ্ছেন এসব দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জার্মানি ও সুইডেন ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের পাশে জোরালোভাবে অবস্থান নিয়ে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে।
পশ্চিমা এই চাপ উপেক্ষা করা মিয়ানমারকে তারা নতুনভাবে বার্তা দেওয়ার আগে বাংলাদেশ ঘুরে যাওয়ার বিষয়টি অবশ্যই বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু ও শক্তিশালী অংশীদার চীন ও জাপানের কাছে বাংলাদেশের প্রত্যাশা নতুনভাবে উপস্থাপনের সুযোগ তৈরি হবে দেশ দুটির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সফরে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে হেভিওয়েট এসব মন্ত্রী ও প্রতিনিধিদের সফরকে ‘সুযোগ’ হিসেবেই দেখছেন জাতিসংঘে বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি ড. এ কে আবদুল মোমেন।
তিনি গতকাল রাতে বলেন, অবশ্য তাদের এ দেশে আসাটাই বিশ্বের জন্য একটা বার্তা। কারণ বাংলাদেশ যে বিশাল সংখ্যক রোহিঙ্গা ফিরিয়ে দেওয়ার চ্যালেঞ্জে আছে বিশ্ব ইতিমধ্যেই তা জানে। মানবিক কারণে এ ভার বহন করা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অতিথি পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মাধ্যমে মিয়ানমারের ওপর আরও চাপ সৃষ্টির প্রত্যাশার কথা জানানোর সুযোগ পাবে। স্পষ্ট করা সম্ভব হবে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে সংকটের স্থায়ী সমাধানের বিষয়টিও।
এ ছাড়া বিশেষত যে চীনের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে মিয়ানমার এসব করছে সেই চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বাংলাদেশ চীনের কাছে নিজের গুরুত্ব তুলে ধরারও একটি সুযোগ পাবে।
এমটিনিউজ/এসবি