তুষার কণা খোন্দকার : বাঙালি কেচ্ছাপ্রিয় জাতি। বাঙালি হিসেবে আমি নিজেও কেচ্ছা-কাহিনী শুনতে ভালোবাসি। কারণ আমি যেসব কেচ্ছা-কাহিনী এক সময় শুনেছি; কিংবা পড়েছি সেসব কেচ্ছা-কাহিনী প্রায়ই বাস্তবে ঘটতে দেখি এবং তাতে বেশ চমত্কৃত হই।
আরব্যরজনীর কেচ্ছা কিংবা বর্তমান আরব দুনিয়ার মানুষের দিনরাতের কেচ্ছা শুনতে আমার খুব ভালো লাগে। আরবের লোকেরা আগে গরিব ছিল এটা পাঠ্যপুস্তক এবং ইতিহাসের বই পড়ে আমরা সবাই জানি। সেই আরবীয়রা বিংশ শতাব্দীতে হঠাৎ ধনী হয়ে গেল।
এমন হঠাৎ ধনী হওয়াকে পুরান ঢাকার লোকেরা মজা করে বলে ‘আঁতকা মহাজন’। আরবীয়রা সিঙ্গাপুরিয়ানদের মতো গায়ে খেটে ধনী হয়েছে এমন নয়।
আসলে ১৯৩০-এর দশক থেকে ইউরোপ-আমেরিকার তেল কোম্পানিগুলো আরব দেশের মরুভূমির তলা থেকে তেল তুলে পিপা ভরে সারা দুনিয়ায় বেঁচতে শুরু করেছিল বলে আরবীয়রা তার ভাগ পেয়ে ধনী।
তেলের মাহাত্ম্যে দুনিয়ার চিরচেনা ভুখা-নাঙ্গা জাজিরাতুল আরব রাতারাতি সৌদ পরিবারের নিজস্ব সম্পদ সৌদি আরবে রূপান্তরিত হয়ে গেল। তেল কোম্পানিগুলোর অশেষ রহমতে সৌদি আরবের ছয় হাজার পরিবার রাতারাতি বেসুমার ধনের মালিক হয়ে একেকজন একেক কীর্তি করে বেড়াতে লাগল।
আমাদের আজকের কেচ্ছা একজন ধনী আরবকে নিয়ে। ১৯৩০-এর দশকে যারা ধনী হতে শুরু করল সেই ছয় হাজার ধনী আরব পরিবারের একজন তার অঢেল অর্থ অপচয় না করে জমিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নিল। প্রথমে সে পেট্রো-ডলার খরচ করে তার বাড়িঘর আসবাবপত্র সব সোনা দিয়ে মুড়িয়ে ফেলার পরে বাড়তি পেট্রো-ডলার দিয়ে সোনার বার কিনে গুদামঘরে জড়ো করতে লাগল।
এক সময় লোকটার মাথায় মৃত্যু-চিন্তা দেখা দিল। সে ভাবল, এত সোনা সব কী ইহকালে ফেলে রেখে শূন্য হাতে পরকালে চলে যাব? অন্তত এক বস্তা সোনার বার পরকালে নিয়ে যেতে পারলে ওগুলোর দিকে চেয়ে আমার সময়টা সেখানে আনন্দে কাটবে।
এক বস্তা সোনার বারের মালিক হিসেবে পরকালের প্রতিবেশীরাও আমাকে বিশেষ সম্মানের চোখে দেখবে। মরার পরে এক বস্তা সোনার বার সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি চেয়ে লোকটি সৃষ্টিকর্তার দরবারে একটা বিশেষ আরজি পেশ করল এবং তার আরজি বিশেষ বিবেচনায় মঞ্জুর হলো।
কিছুদিন পরে লোকটি মারা গেল এবং তার পরিবারের লোকজন তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী কবরে এক বস্তা সোনার বার দিয়ে দিল। মরার পরে লোকটির আত্মা এক বস্তা সোনার বার নিয়ে পরকালের দরজায় হাজির হতে ওখানকার দারোয়ান তো তাজ্জব।
শূন্য হাতে পরকালে যাওয়ার নিয়ম ভেঙে লোকটি দুনিয়া থেকে ভারী একটি বস্তা কেমন করে সঙ্গে নিয়ে এলো সেটি সে গুরুত্বের সঙ্গে জানতে চাইল। মৃত ব্যক্তি তার সৃষ্টিকর্তার কাছে পেশ করা আরজি মঞ্জুর হওয়ার বিষয়টি ভেঙে বলার পরে দারোয়ান তাকে এক শর্তে বস্তা সঙ্গে নেওয়ার অনুমতি দিল।
বলল, দুনিয়া থেকে তুমি কী জিনিস পরলোকে টেনে এনেছ এটা বস্তার মুখ খুলে আমাকে দেখাতে হবে। মৃত লোকটি ভাবল, এ আর এমন কী শর্ত। পরকালে আমি সবাইকে সোনার বার দেখিয়ে দেখিয়ে চমক লাগিয়ে দেব বলেই তো এত কষ্ট করে এগুলো বস্তায় ভরে দুনিয়া থেকে টেনে এনেছি।
দারোয়ানের আগ্রহ দেখে সে মহাআনন্দে বস্তার মুখ খুলে দারোয়ানের সামনে সোনার বারের ঝলকানি মেলে ধরতে দারোয়ান অবাক-বিস্ময়ে লোকটির মুখের দিকে চেয়ে বলল, এসব সোনার বার এখানে ফুটপাথ বানাতে ব্যবহার করা হয়েছে। পরকালের ফুটপাথ চিরস্থায়ী।
সুদূর ভবিষ্যতেও ওগুলো ভাঙার কোনো আশঙ্কা নেই। তুমি ফুটপাথ বানানোর সরঞ্জাম এত কষ্ট করে দুনিয়া থেকে টেনে আনলে কোন আক্কেলে! এটি এখানে তোমার কী কাজে লাগবে?
কেচ্ছাটি কেন মনে পড়ল আর সেটি এমন বাখান করে কেন বলছি তার একটা টাটকা কারণ আছে। এ বছর অক্টোবর মাসে সৌদি আরবের বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ রাশিয়া সফরে গিয়েছিলেন। পৃথিবীর সব এয়ারপোর্টে প্লেন থেকে উঠা-নামার সিঁড়ি আছে।
মস্কো এয়ারপোর্টেও যথারীতি প্লেন থেকে উঠা-নামার মতো যথেষ্ট সিঁড়ি মজুদ আছে। তবুও বাদশা নামদার সৌদি আরব থেকে রওনা হওয়ার সময় মস্কো এয়ারপোর্টে প্লেন থেকে নামার জন্য খাঁটি সোনার তৈরি একটি সিঁড়ি সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন।
তিনি যেহেতু বাদশাহ তাই তার সফর মধ্যযুগীয় বাদশাহী কেতায় হওয়াই স্বাভাবিক। তিনি তো আর সাধারণের মতো লোহার সিঁড়ি বেয়ে মস্কোর মাটিতে পা ফেলতে পারেন না। বাদশাহ নামদারের প্ল্যান এ পর্যন্ত ঠিক ছিল কিন্তু ঘটনায় বাদ সাধল আধুনিক টেকনোলজি।
বাদশা নামদারের সোনার সিঁড়িটি আধুনিক কেতা অনুযায়ী ঘূর্ণায়মাণ করে তৈরি করা হয়েছিল। ঘূর্ণায়মাণ সিঁড়ি আজকের দিনে আমাদের দেশেও কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা নয়। এমন ঘূর্ণায়মাণ সিঁড়ি বাংলাদেশের বড় স্থাপনাগুলোতে লোকে হামেশা ব্যবহার করছে।
বাদশা নামদারের সোনার সিঁড়ি দুনিয়াব্যাপী মুখরোচক আলোচনার খোরাক হয়েছে। কারণ সিঁড়িটি ঘুরতে গিয়ে মাঝপথে আটকে গেছে। প্লেন থেকে নামার রাজকীয় বন্দোবস্ত মাঝপথে আটকে যাওয়ায় সিঁড়ির বাকি ধাপগুলো বাদশা নামদারকে পায়ে হেঁটে নামতে হয়েছে।
খবরটি জেনে লোকে ভাবছে, বাদশা নামদারের জন্য তৈরি সিঁড়িতে সোনার কমতি ছিল না এটা ঠিক কিন্তু ওটি বানানোর ক্ষেত্রে কারিগরি জ্ঞানের অভাব ছিল। সৌদি কারিগরি জ্ঞান দিয়ে তৈরি সোনার সিঁড়ি মস্কো এয়ারপোর্টে কাজ করেনি।
চলন্ত সিঁড়িটি মাঝপথে আটকে যাওয়ায় অশীতিপর বৃদ্ধ বাদশাহ নামদারকে মধ্যযুগীয় কায়দায় পায়ে হেঁটে মাটিতে নামতে হলো। বাদশাহ নামদারের কষ্ট দেখে মনে হলো, সোনার সিঁড়িটি সৌদি টেকনোলজিতে তৈরি না করে জার্মান কিংবা জাপানি টেকনোলজিতে কিংবা রাশানদের হাতে তৈরি হলেও ওটি ঠিকঠাক কাজ করত।
সৌদি আরবের বাদশাহ নামদার সোনার সিঁড়ি দেখিয়ে রাশিয়ানদের চোখ ধাঁধাতে চেয়েছিলেন; কিন্তু দুনিয়াবাসী সৌদি আরবের কারিগরি জ্ঞানের স্বল্পতা দেখে হাসাহাসি করছে। ভাবছে, তেল বেচে পাওয়া ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করে সৌদি আরব টন টন সোনা কিনেছে।
কিন্তু দেশটির কারিগররা মধ্যযুগের সীমা পেরিয়ে আধুনিক কারিগরি জ্ঞানের প্রথম ধাপও পার হতে পারেনি। বর্তমান সৌদি আরবের জন্ম ১৯৩২ সালে। অ্যারাবিয়ান আমেরিকান অয়েল কোম্পানি, আরামকোর ব্যবসার প্রয়োজনে এক সময়ের জাজিরাতুল আরব বর্তমানে সৌদি আরব।
সৌদি আরব যখন জাজিরাতুল আরব ছিল তখন ওখানে মাটির তলে তরল সোনার নহর ঠিকই বয়ে যেত, তবে আমেরিকান তেল কোম্পানি আরামকো তখনো মাটির তলের তেলকে মাটির ওপরে টেনে তুলে ব্যারেলে ভরে সৌদ পরিবারের ভাগ্য খুলে দেয়নি।
দেশটি যখন সৌদি আরব হয়নি স্রেফ জাজিরাতুল আরব ছিল তখন মানুষ খেয়ে না খেয়ে কোনোমতে বেঁচে থাকত। হজ মৌসুমে দেশ-বিদেশের হাজীদের জন্য সার্ভিস দিয়ে আরব মুল্লুকের মানুষ যৎসামান্য যা আয় করত তাই দিয়ে সংসার চালিয়ে নিত।
সে সময় পেট্রো-ডলারের রমরমায় ও দেশে হীরার গাছে মতির ফুল ঝুলত না সত্য; তারপরও জাজিরাতুল আরব সংস্কৃতির দিক থেকে এমন বেহাল দেউলিয়া ছিল না। ধর্মীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্য হিসেবে পৃথিবীর মুসলমানদের কাছে মক্কা-মদিনা শহর দুটোর বিশেষ সম্মান ছিল।
গত দুই দশক ধরে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বিবাদ কিংবা যুদ্ধে জড়িয়ে সৌদি আরব মুসলিম দুনিয়ায় তার অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। সৌদি আরব তার তেল বেচা টাকায় সোনার তাল আর যুদ্ধাস্ত্র কিনে সৌদ কিংবা আবদ ওয়াহাব পরিবারের এক জনমের ভোগ-বিলাস নিশ্চিত করতে পেরেছে, তবে মুসলিম দুনিয়ার আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব হারিয়ে ফেলেছে।
অক্টোবর মাসে বাদশা সালমান তেল বেচা টাকায় রাশিয়ার কাছ থেকে যুদ্ধের অস্ত্র কিনতে গিয়েছিলেন। আমেরিকা, ইংল্যান্ড কিংবা ফ্রান্সের কাছ থেকে সৌদি আরব যত অস্ত্র কিনেছে কিংবা কিনছে, এখন রাশিয়ার কাছ থেকে যত অস্ত্র কেনা হবে সেগুলো নিশ্চয়ই ইয়েমেন, কাতার, লেবানন কিংবা ইরানের মুসলমানদের ওপর প্রয়োগ করা হবে।
সেই অস্ত্র প্রয়োগ শুরু হলে মধ্যপ্রাচ্যের পরিণাম কী হবে সেটি ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেনের পরিণাম দেখে মানুষ সহজেই অনুমান করতে পারে। মানুষ জানে, যুদ্ধে সৈন্য যত মারা যায় তার চেয়ে অনেক বেশি মারা পড়ে নিরীহ মানুষ।
আমরা অনুমান করছি, আগামী দিনগুলোতে সৌদ পরিবার মধ্যপ্রাচ্যে মানুষের মৃত্যুর মিছিল আরও দীর্ঘ না করে থামবে না। ষোড়ষ শতাব্দীতে অটোমান সম্রাটরা হেজাজ দখল করে আরব পেনিন্সুলার ওপর তাদের আধিপত্য কায়েম করতে চেয়েছিলেন।
অনেক সম্পদশালী দেশের ওপর অটোমান শাসন কায়েম থাকার পরেও জাজিরাতুল আরব তারা দখল করেছিলেন। কারণ তারা মুসলিম দুনিয়ার আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব পেতে চেয়েছিলেন। অটোমানদের কাছে জাগতিক সম্পদের চেয়ে নিষ্ফলা মরুভূমির দেশ আরবের আধ্যাত্মিক মূল্য অনেক বড় ছিল।
কিন্তু আজকের আরবীয়দের কাছে আধ্যাত্মিকতার কী মূল্য সেটা আমরা জানি না; কিন্তু সৌদ এবং আবদ ওয়াহাবের উত্তরাধিকারীদের কাছে সোনার তাল এবং সমরাস্ত্রই যে শেষ ভরসা, সেটি বুঝতে দুনিয়ার মানুষের বাকি নেই।
বর্তমান সময়ে সৌদি আরব তার প্রতিবেশী ইয়েমেন, লেবানন, কাতার এবং ইরানজুড়ে যে আগুনের বলয় তৈরি করেছে তাতে মনে হচ্ছে, এত বছর ধরে তারা তেল বেচা টাকায় যত সোনার তাল জড়ো করেছিল, এবার তার সবই পুড়ে শেষ হবে। -বিডি প্রতিদিন
লেখক : কথাসাহিত্যিক।
এমটিনিউজ/এসবি