বুধবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৮, ০২:১২:০০

পতিতালয়ে হীরার আংটি, চাঞ্চল্যকর হত্যার রহস্য উন্মোচন

পতিতালয়ে হীরার আংটি, চাঞ্চল্যকর হত্যার রহস্য উন্মোচন

মির্জা মেহেদী তমাল : দেশের দুর্ধর্ষ একটি ডাকাত দলকে ধরতে পুলিশ প্রস্তুত। গোয়েন্দাদের কাছে খবর রয়েছে ফরিদপুর গোয়ালন্দ পতিতা পল্লীতে অবস্থান নিয়েছে সেই ডাকাত দল। এরা রাজধানী শুধু নয়, সারা দেশে ঘুরে ঘুরে ডাকাতি করে বেড়াচ্ছে।

পুলিশের দল ঢাকা থেকে রওনা হয় গোয়ালন্দের উদ্দেশে। ভোরে তারা পৌঁছে যায় সেখানে। ছদ্মবেশে তারা পতিতা পল্লীর ভিতর। গোয়েন্দাদের অধিকাংশ সদস্য লুঙ্গি পরা। কারও মাথায় গামছা। প্রত্যেকেই সশস্ত্র। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। বিভিন্ন কক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তাদের সঙ্গে রয়েছে স্থানীয় সোর্স।

১৯৮৭ সালে গোয়েন্দা পুলিশের একজন এসি আকরামের নেতৃত্বে ডাকাত দল অধীর আগ্রহে পতিতা পল্লীতে। হঠাৎ এক সোর্স এসে এসি আকরামকে একটি তথ্য দেয়। সোর্স জানায়, সেখানে একজন নারী আছেন। নাম শিউলি। যার কাছে মূল্যবান একটি হীরার আংটি রয়েছে। এই হীরার আংটি ঢাকা থেকে নিয়ে আসা।

এসি আকরাম বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে শিউলির সঙ্গে দেখা করেন। আকরামের দৃষ্টি যায় শিউলির হাতে। হ্যাঁ, দামি একটি হীরার আংটি তা তার আঙ্গুলে শোভা পাচ্ছে। আকরাম তাকে প্রশ্ন করেন, ‘তোমার এই আংটি কোথা থেকে এনেছ?’ জবাবে সেই শিউলি জানায়, ‘তার প্রেমিক তাকে আংটি দিয়েছে। নাম বুড্ডা।’

এসি আকরামের কাছে বুড্ডা নামটি খুব পরিচিত। পেশাদার কিলার। ঢাকার বহু খুনে জড়িত সেই বুড্ডা। কখন আসবে বুড্ডা? জানতে চায় আকরাম।

শিউলি তাকে জানায়, ঢাকায় আছে। সন্ধ্যার মধ্যে আসার কথা। এসি আকরাম তার পরিকল্পনা পাল্টে ফেলে। ডাকাত ধরবে না। তার দরকার এখন বুড্ডাকে। এসি আকরাম শিউলিকে জানায়, তারা সেখানেই আছে। বুড্ডার সঙ্গে তার প্রয়োজন। একটা কাজ করাবে তাকে দিয়ে।

শিউলি বলে, ঠিক আছে, আপনারা থাকেন। বুড্ডা আসলে আপনাদের খবর দিব। এসি আকরাম তার দলবল নিয়ে পতিতা পল্লী থেকে বেরিয়ে আশপাশে গিয়ে সময় কাটান। তারা নতুন করে পরিকল্পনা আঁটেন।

এসি আকরাম ভাবছে, আংটির কথা। কোথা থেকে এই দামি আংটি পেল। হয়তো কোনো তথ্য পাওয়া যেতে পারে। দুপুর গড়িয়ে বিকাল। সন্ধ্যায় খবর আসে বুড্ডা চলে এসেছে। এসি আকরাম তার ফোর্স নিয়ে আবারও ঢুকে পড়ে পল্লীতে। শিউলির রুমে। বুড্ডা সেখানে অবস্থান করছেন। আগে থেকে তাদের জন্য সেখানে খাওয়া দাওয়ার বড় আয়োজন করে রেখেছে শিউলি। বুড্ডা তাকে দেখে বসতে বলেন।

কিন্তু এসি আকরামের চিন্তা, এখানে বেশি দেরি করা যাবে না। বুড্ডা মদপান করার আমন্ত্রণ জানায়। এসি আকরাম বলেন, এগুলো পরে হবে। আগে আমাদের সঙ্গে চল। বুড্ডা মুখ তুলেই দেখে তার চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে সশস্ত্র পুলিশ। বুড্ডা এবং শিউলিকে নিয়ে পুলিশ রওনা হয় ঢাকার উদ্দেশে। গাড়ির ভিতরেই জেরা শুরু।

বুড্ডা এ সময় পুলিশের দলকে হুমকি দেয়। বলে, আপনারা চাকরি হারাবেন। বুঝতে পারছেন না, কাকে ধরেছেন। এসব কথা বলতে বলতেই গাড়ি ঢাকায়। গোয়েন্দা দফতরে নিয়ে জেরা করা হয়।

আংটি কার? গোয়েন্দাদের প্রশ্ন। মুখ খোলে না বুড্ডা। যেন পণ করে এসেছেন। মুখ খুলবেন না। কিন্তু এসি আকরামের মতো একজন চৌকস গোয়েন্দার কাছে মুখ না খোলার মতো অপরাধী নেই। কৌশলের কাছে পরাস্ত হয়ে মুখ খুলতেই হয়। বুড্ডাকেও খুলতে হয়েছিল মুখ।

গোয়েন্দারা যা জানতে পারল, তা ছিল কল্পনার বাইরে। ঘটনা শুনে গোয়েন্দারা স্তব্ধ। বিশ্বাস করতে পারছিল না। বুড্ডার তথ্য পেয়ে পুলিশ প্রশাসন শুধু নয়, সরকারের ভিতরেও তখন শুরু হয় তোলপাড়।

১৯৮৬ সালের নভেম্বর। আরিচা ঘাটের টয়লেটের কাছে পার্ক করা আছে একটি প্রাইভেট কার। কুয়াশায় ভিজে আছে গাড়ি। গাড়ির ব্যাকডালা থেকে টপ টপ রক্ত পড়ছে। প্রচণ্ড দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে। পরিবহন শ্রমিকদের চোখে পড়ে প্রথম। মালিকবিহীন গাড়িটি পড়ে আছে আগের দিন সন্ধ্যা থেকে। পরদিন দিনের বেলা সেটি থেকে রক্ত পড়ছে।

পরিবহন শ্রমিকরা পুলিশকে খবর দেয়। আসে মানিকগঞ্জের শিবালয় থানা পুলিশ। ব্যাকডালা ভাঙে। ভিতরে পুরুষের লাশ। মাথায় তিনটি পেরেক ঢোকানো। গলায় গুলির মতো ক্ষত। মুখে তুলা গোঁজা। নাক কেটে দেওয়া হয়েছে। পুরো শরীর অ্যাসিডে ঝলসানো। পা দুটি পেছন দিক থেকে ভেঙে কাঠের সঙ্গে শক্ত করে হাতসহ বাঁধা। পরনে মোজা ও একটি অন্তর্বাস। লাশ ছিল বস্তাবন্দী।

পিঠমোড়া বাঁধা মৃতদেহটি প্রথমে একটি পলিথিনে মুড়িয়ে দুই মণের চটের বস্তায় ভরে ফুল আঁকা একটি চাদর দিয়ে প্যাক করা ছিল। মৃতদেহটি এতটাই বিকৃত হয়ে আছে, আপনজন ছাড়া আর কেউ লাশটি শনাক্ত করা সম্ভব নয়। সঙ্গে ছিল একটি চিরকুট। চিরকুটে লেখা, এই লাশ নারায়ণগঞ্জের বাচ্চুর। বাচ্চু ভাইকে মারলাম। আরও নয়জনকে খাব। ...ইত্যাদি।

হ্যাঁ, লাশটি ছিল নারায়ণগঞ্জের নুরু মিয়া চৌধুরী বাচ্চুর। তিনি সেই সময়ে বাংলাদেশের ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের মধ্যে ছিলেন একজন। বাচ্চুর লাশ এমনভাবে উদ্ধার হওয়ায় সারা দেশে এনিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। নারায়ণগঞ্জে হরতাল পালন করা হয়। সকালে একটি ফোন কল পেয়ে ব্যতিব্যস্ত বাচ্চু ধানমন্ডির বাসা থেকে নিজ গাড়ি নিয়ে বের হয়েই নিখোঁজ হন বাচ্চু। সোবহানবাগ এলাকায় ড্রাইভার জাহাঙ্গীরকে নামিয়ে দিয়ে একাই তিনি গাড়ি নিয়ে যান। মোহাম্মদপুরে একটি বাসায় গিয়ে তিনি নিখোঁজ হন।

ওই বাসাটি তিনি কাউকে চেনাতেন না। ড্রাইভারও চিনত না। দুপুরের ভিতর বাসায় ফেরার কথা থাকলেও বাচ্চু ফিরেননি। রাত পেরিয়ে নতুন দিন। সারা দিনেও ফিরেনি। তারপরের দিন তার লাশ মিলে আরিচায়। পুলিশ তদন্ত শুরু করে। ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের জের ধরে তিনি খুন হতে পারেন বলে পুলিশের ধারণা। থানা পুলিশের পর এ মামলার তদন্ত করে সিআইডি।

সিআইডি তদন্তে এগিয়ে না নিতে পারলে তদন্তের ভার দেওয়া হয় গোয়েন্দা পুলিশকে। গোয়েন্দা পুলিশও হয় ব্যর্থ। নারায়ণগঞ্জের অত্যন্ত প্রভাবশালী বাচ্চুর মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে পুলিশ খুব একটা এগোতে পারে না। আর এ খুন নিয়ে চাঞ্চল্যকর বহু ঘটনার জন্ম দেয়। পত্রপত্রিকায় একের পর এক উড়ো চিঠি পাঠানো হয়। এ নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি না করতেও হুমকি দেওয়া হয়েছিল। এভাবেই মাসের পর মাস কাটে। বছর ঘুরে আসামি ধরা পড়ে না।

এক বছর পর ধরা পড়ে বুড্ডা। সে স্বীকার বরে, এই আংটি ছিল বাচ্চুর। মোহাম্মদপুরের বাসায় তাকে মাথায় পেরেক ঠুকে হত্যা করা হয়। সেসময় বাচ্চুর আঙ্গুল থেকে খুলে নেওয়া হয় সেই আংটি। সে পুলিশকে জানায়, এর পেছনে ছিল বাচ্চুর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ব্যবসায়িক পার্টনারও। বুড্ডা গ্রেফতারের পর সেই ব্যবসায়ী গা ঢাকা দেয়। কিন্তু সে একসময় ধরা পড়ে পুলিশের হাতে। একটি আংটি খুলে দিল চাঞ্চল্যকর হত্যার রহস্য। বিডি প্রতিদিন
এমটিনিউজ/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে