বৃহস্পতিবার, ০৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮, ১১:৫৫:০৮

আত্মপক্ষ সমর্থন করে যা বলেছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন

আত্মপক্ষ সমর্থন করে যা বলেছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন

নিউজ ডেস্ক : জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আত্মপক্ষ সমর্থন করে আদালতে বলেছিলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আনা সকল অভিযোগ বানোয়াট ও অপ্রমাণিত। আমি দৃঢ়ভাবে সকল অভিযোগ অস্বীকার করছি। আমি প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন থাকার সময়ে কোনোভাবে বা কোনো মাধ্যমেই আমার পদের অপব্যবহার করিনি। আমার পদের অন্যায় প্রভাব খাটাইনি। আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ এবং এ মামলায় বেকসুর খালাস পাওয়ার যোগ্য।’

রাজধানীর বকশীবাজারের আলিয়া মাদরাসা মাঠে স্থাপিত ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ জজ আদালতে আত্মপ সমর্থন করে খালেদা জিয়া গত ১৯ ও ২৬ অক্টোবর এবং ২, ৯, ১৬ ও ২৩ নভেম্বর এবং ৫ ডিসেম্বর মোট সাত দিন বক্তব্য রাখেন।
খালেদা জিয়া আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেন, সব ধরনের উপস্থাপিত দালিলিক সাক্ষ্যের আলোকে এটি দৃশ্যমান হবে যে, আমি প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিলসংক্রান্ত বিষয়ে কোনো দিনই কোনোভাবেই সম্পৃক্ত ছিলাম না।

প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিল নামে কোনো দিন কোনো তহবিল ছিল না এবং এটি অস্তিত্ববিহীন। এর কোনো অ্যাকাউন্টের প্রমাণপত্র, কোনো মূল নথিপত্র, কোনো নোটশিট উপস্থাপিত হয়নি। কতকগুলো সই-স্বাক্ষরবিহীন ঘষামাজা ফাইল নম্বর উল্লেখ করে কিছু রেডর্ক প্রস্তুত করে দুদক কর্মকর্তা এ মামলায় আমাকে হয়রানিমূলকভাবে জড়িত করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন।

তিনি বলেন, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট একটি প্রাইভেট ট্রাস্ট। এ নিয়ে কারো কোনো ভিন্নমত নেই। এই প্রাইভেট ট্রাস্টটির কোনোরূপ আর্থিক অনিয়ম হয়েছে বলে ট্রাস্ট সংশ্লিষ্ট কারো কোনো অভিযোগ নেই। সরকারের কোনো ফান্ড দিয়ে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট গঠন হয়নি। কুয়েতের আমিরের এককালীন অনুদান স্বীকৃত মতে তদানীন্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান কর্তৃক আনীত হয় মর্মে সাক্ষ্য প্রমাণে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দুদকের তদন্তে বৈদেশিক অনুদান প্রাপ্তির বিষয়ে কোনোরূপ ভিন্ন দাবি কেউ করেননি। প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিল নামে কোনো দিনই কোনো বাস্তবভিত্তিক কোনো তহবিল ছিল- এ-জাতীয় ডকুমেন্ট প্রধানমন্ত্রীর দফতর হতে আসেনি এবং প্রধানমন্ত্রীর দফতর হতে কোনো অভিযোগও কেউ করেননি। নিয়মিত ও আইন বর্ণিত পন্থায় কোনো অডিট আপত্তিও বিজ্ঞ আদালতে উপস্থাপন করা হয়নি। আমাকে, জিয়া পরিবারকে ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে সম্পূর্ণরূপে হয়রানি করার প্রয়াস হিসেবে এবং রাজনীতি থেকে দূরে রাখার অপপ্রয়াস হিসেবে অনুমান নির্ভর ও কল্পিত অভিযোগে এ মামলায় মিথ্যা বর্ণনায় আমাকে জড়িত করা হয়েছে।

খালেদা জিয়া বলেন, আমি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের কোনো সেটেলর বা ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য নই। এই ট্রাস্ট গঠন, এর তহবিল সংগ্রহ, ট্রাস্ট পরিচালনা এবং কোনো ধরনের কোনো লেনদেনের সাথেও আমার ব্যক্তিগতভাবে বা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কখনো কোনো রকম সম্পর্ক ছিল ও নেই কোনো পর্যায়ে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের নামে বগুড়ায় জমি ক্রয় বা আশুলিয়ায় জমি ক্রয়-বিক্রয়ের সাথেও আমার কোনো সম্পর্ক নেই। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের এসটিডি হিসাব নম্বর ৭ খোলা এবং ওই হিসাবের লেনদেন পরিচালনা করা ইত্যাদির সাথেও আমার কোনো সম্পর্ক নেই।

তিনি বলেন, এ মামলার অনুসন্ধান বা তদন্তকালে পিডব্লিউ ১ হারুন-অর-রশীদ এমন কোনো দালিলিক প্রমাণ ও স্যাপ্রমাণ সংগ্রহ করতে পারেননি, যার মাধ্যমে তিনি দেখাতে পারেন যে, আমি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট গঠন করেছি। অথচ কোনো রকম প্রমাণাদি ছাড়া সাী হারুন-অর-রশীদ মামলার এজাহার, অভিযোগপত্র ও তার জবানবন্দীতে আমার বিরুদ্ধে এই ভিত্তিহীন অভিযোগ এনেছেন যে, আমি নাকি আমার পুত্রদ্বয় ও আমাদের আত্মীয় মোমিনুর রহমানকে দিয়ে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট গঠন করেছি। আমাদের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষ, বিশেষ করে বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রিপরিষদের কিছু সদস্য প্রায়ই আমাকে জড়িয়ে জনসম্মুখে মিথ্যা বক্তব্য প্রচার করেন। পিডব্লিউ ১ হারুন-অর-রশীদের জবানবন্দীতে আমার বিরুদ্ধে যেসব মনগড়া ও মিথ্যা বক্তব্যে দিয়েছেন, তার সাথে সেসব অপপ্রচারণার একটি সামঞ্জস্যতা পাওয়া যায়। যা থেকে আপনি সহজেই অনুধাবন করতে পারবেন যে, হারুন-অর-রশীদকে একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে এ মামলার অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা, মামলার বাদি এবং তাকেই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে আমার বিরুদ্ধে কাজে লাগানো হয়েছে।

আদালতে তিনি বলেন, বিএনপি সরকার একজন বিচারপতির নেতৃত্বে একটি স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠার ল্েয দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ প্রণয়ন করে। আপনি জানেন, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪-এর ৩(২) ধারার বিধানমতে কমিশন হবে একটি স্বাধীন ও নিরপে কমিশন। অথচ এ মামলায় কমিশনের কর্মকর্তা হিসেবে সাক্ষী হারুন-অর-রশীদ কমিশনের সেই স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতার প্রমাণ দিতে পারেননি। আমি আরো উল্লেখ করতে চাই যে, এই সাক্ষী হারুন-অর-রশীদকে কমিশনের সেটআপে অন্তর্ভুক্ত না করায় পরে আমার বিরুদ্ধে মামলা করা এবং সাক্ষী দেয়ার জন্য তাকে আবার কমিশনে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। প্রথম অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা আমার বিরুদ্ধে কোনো তথ্যপ্রমাণ ও অভিযোগ পাননি এবং আমাকে অভিযোগের তালিকাভুক্ত করেনি এবং একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দাখিল করে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টকে একটি প্রাইভেট ট্রাস্ট হিসেবে বর্ণনা করেন এবং দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের তালিকাভুক্ত কোনো অপরাধ হয়নি বলে সুস্পষ্ট মতামত দিয়ে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দাখিল করেন। অথচ সাী হারুন-অর-রশীদ দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের ৩(২) ধারায় উল্লিখিত নিরপেতার বিধান লঙ্ঘন করে কোনোরূপ দালিলিক প্রমাণ ছাড়া মাত্র ১৫ দিনের ব্যবধানে আমার বিরুদ্ধে একটি হয়রানিমূলক ও মিথ্যা রিপোর্ট দাখিল করেন এবং তারই ধারাবাহিকতায় তিনি আপনার আদালতেও কোনো তথ্যপ্রমাণ বা দালিলিক প্রমাণাদি ছাড়া আমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন মিথ্যা অভিযোগ করেছেন।

তিনি বলেন, একজন তদন্তকারী কর্মকর্তার সাক্ষ্যের ভিত্তিতে মামলার অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এরূপ দাবির সমর্থনে ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় কোনো নজির পাওয়া যাবে না। একজন তদন্তকারী কর্মকর্তা কোনো ঘটনার সাক্ষী হতে পারে না; বরং তদন্ত কর্মকর্তার উত্থাপিত অভিযোগের সমর্থনে বিভিন্ন সাক্ষী যে বক্তব্য দিয়ে থাকে, সেটিই সাক্ষ্য। প্রধানমন্ত্রীর কথিত এতিম তহবিলের জন্য বিদেশী অনুদান সংগ্রহ করা অথবা সেই অনুদানের অর্থ দিয়ে অ্যাকাউন্ট খোলা অথবা সেই অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করা বা সেই অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা উত্তোলন করার বিষয়ে আমার বিরুদ্ধে কোনো বর্ণনা অন্য কোনো সাক্ষীর মাধ্যমে মাননীয় আদালতে আসেনি।

বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, এই সাক্ষী স্বীকার করেন যে, জব্দকৃত আলামতগুলোয় আমার অর্থাৎ বেগম খালেদা জিয়ার নামের উল্লেখ নেই। এই সাক্ষী স্বীকার করেন যে, বিদেশ থেকে কোনো রেমিট্যান্স এলে তা রেকর্ড করে কাগজপত্রাদি সংরক্ষণ করা হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে রেমিট্যান্স-সংক্রান্ত কোনো তথ্যাদি বিজ্ঞ আদালতে সাক্ষ্য হিসেবে আসেনি।

মামলা সম্পর্কে আরো বিশদ বিবরণ দিয়ে খালেদা জিয়া আরো বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনা সকল অভিযোগ বানোয়াট ও অপ্রমাণিত। আমি দৃঢ়ভাবে সকল অভিযোগ অস্বীকার করছি। আমি প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন থাকার সময়ে কোনোভাবে বা কোনো মাধ্যমেই আমার পদের অপব্যবহার করিনি। আমার পদের অন্যায় প্রভাব খাটাইনি। আমার পারিবারিক বাসস্থান, ৬ মইনুল রোড, এখানে আমার পরিবারের সকলেই থাকতেন। এটা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন নয়। আমি আমার পদে থাকার সময় আমার অধীনস্থ কারো মাধ্যমে আমার পদের প্রভাব খাটাইনি।

আমি কাউকে কোনো অন্যায় আদেশ প্রদান করিনি। আমি আমার পদে আসীন থাকাকালে কারো কোনো অর্থের দ্বারা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হইনি কিংবা কাউকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান করিনি। আমি আমার পদে আসীন থেকে নিষ্ঠা ও সততার সাথে দায়িত্ব পালন করেছি এবং কোনো আইনভঙ্গ ও অপরাধ করিনি। আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ এবং এ মামলায় বেকসুর খালাস পাওয়ার যোগ্য।

আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থন করে দেয়া বক্তব্যে শেষে খালেদা জিয়া বলেন, আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি পবিত্র কুরআনের সূরা নিসার ১৩৫ নম্বর আয়াতের বাংলা তরজমা উল্লেখ করে।  বাংলা তরজমা : হে ঈমানদারগণ, তোমরা ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাক; আল্লাহর ওয়াস্তে ন্যায়সঙ্গত সাক্ষ্যদান করো, তাতে তোমাদের নিজের বা পিতা-মাতার অথবা নিকটবর্তী আত্মীয়স্বজনের যদি ক্ষতি হয়, তবুও। কেউ যদি ধনী কিংবা দরিদ্র হয়, তবে আল্লাহ তাদের শুভাকাক্সক্ষী তোমাদের চাইতে বেশি। অতএব, তোমরা বিচার করতে গিয়ে রিপুর কামনা-বাসনার অনুসরণ করো না। আর যদি তোমরা ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা বলো কিংবা পাশ কাটিয়ে যাও, তবে আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজকর্ম সম্পর্কেই অবগত। এরপর খালেদা জিয়া আদালতে উপস্থিত সবাইকে ধন্যবাদ জানান।
এমটিনিউজ২৪.কম/টিটি/পিএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে