রবিবার, ২২ নভেম্বর, ২০১৫, ০৮:২০:৫৪

সেই রাজপাট থেকে যেভাবে ফাঁসির কাষ্ঠে সাকা

সেই রাজপাট থেকে যেভাবে ফাঁসির কাষ্ঠে সাকা

ঢাকা: বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। সব আনুষ্ঠনিকতা শেষে শনিবার দিবাগত রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ছয়বারের নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরী ছিলেন অবিভক্ত পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের স্পিকার। বলা চলে, চট্টগ্রামের রাজ পরিবারে সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম নেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে নানা কারণে আলোচিত-সমালোচিত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে পরিচিতি পেলেও বাকপটু এই রাজনীতিক বিভিন্ন সময়ে নানা মন্তব্যের জন্য বিতর্কিত হয়েছেন। কিন্তু আগাগোড়াই তার জীবনের সবচেয়ে বিতর্কিত অধ্যায় ছিল ১৯৭১। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ১৯৪৯ সালের ১৩ মার্চ চট্টগ্রামের রাউজান থানার গহিরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরীর কারণে তার রাজনীতির শুরুও মুসলিম লীগ থেকে। পরে জাতীয় পার্টি ও এনডিপি হয়ে বিএনপিতে আসেন। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর জন্ম চট্টগ্রামে, বেড়ে উঠেছেন সেখানেই। পড়াশোনা করেছেন চট্টগ্রামের ফৌজদার হাট ক্যাডেট কলেজে। সেখান থেকে ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পাকিস্তানে। পিতার রাজনৈতিক আদর্শ অনুসরণ করে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীও রাজনীতি শুরু করেন মুসলিম লীগের মাধ্যমে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে মুসলিম লীগ সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নেয়। স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রায় পুরোটা সময়জুড়েই চট্টগ্রামে ফজলুল কাদের চৌধুরী এবং তার পরিবার বহু মানুষকে অত্যাচার-নির্যাতন করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। স্বাধীনতার পরপরই ফজলুল কাদের চৌধুরী এবং সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে হত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগে মামলা হয়। ফজলুল কাদের চৌধুরী দালাল আইনে কারাগারে বন্দি অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। আর সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ছিলেন পলাতক। ২০০১ সালে দলীয় প্রধান খালেদা জিয়াকে নিয়ে এক কটূক্তির জের ধরে বহিষ্কৃত হন। পরে ওই বছরই আবার দলীয় মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। ওই নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসলে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী নিযুক্ত হন প্রধানমন্ত্রীর সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা। আর ২০০৪ সালে ওআইসি মহাসচিব পদে নির্বাচন করে পরাজিত হন তিনি। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় সংসদে মুসলিম লীগ থেকেই প্রথমবারের মত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর সামরিক শাসক এরশাদের জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে মন্ত্রী হন। ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টি থেকে বেরিয়ে নিজেই দল গঠন করেন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনডিপি)। পরে নিজের দল বিলুপ্ত করে ১৯৯৬ সালে যোগ দেন বিএনপিতে। সবমিলে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বিভিন্ন দল থেকে এ পর্যন্ত মোট ছয়বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। ১৯৭৯ সালে মুসলিম লীগ থেকে তিনি প্রথম রাউজানের এমপি নির্বাচিত হন। সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সময়ে তিনি জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন এবং কার্যত এর মধ্য দিয়েই মূলধারার রাজনীতিতে তার পুনর্বাসন ঘটে। ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টির টিকেটে নির্বাচন করে নিজের এলাকা রাউজান থেকে এমপি নির্বাচিত হন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। কিন্তু পরে দল থেকে বহিষ্কৃত হন তিনি। এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালে তিনি নির্বাচন করেন নিজের গঠন করা দল এনডিপি থেকে। আবারো তিনি সেখানকার এমপি হন। এর কিছুদিন পর এনডিপি বিএনপির সঙ্গে একীভূত হয় এবং ১৯৯৬ সালে বিএনপির টিকেটে এমপি নির্বাচিত হন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। পরে ২০০১ সালেও তিনি নির্বাচিত হন চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া থেকে। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে মন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সংসদবিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্বও তিনি পালন করেন। এর আগে স্বৈরশাসক এরশাদের শাসনামলে ত্রাণ ও পুনর্বাসন, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এমপি থাকা অবস্থায় ট্রাইব্যুনালে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসির রায় আসে। ফজলুল কাদের চৌধুরীর চার ছেলের মধ্যে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীই সবার বড়। তার সেজ ভাই গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক। তিনিও এক সময় এমপি ছিলেন। বাকি দুই ভাইয়ের মধ্যে সাইফুদ্দিন কাদের চৌধুরী মারা গেছেন। আর জামাল উদ্দিন কাদের চৌধুরী একজন ব্যবসায়ী। ২০১০ সালে ১৬ ডিসেম্বর হরতালে গাড়ি পোড়ানোর একটি মামলায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে ১৯ ডিসেম্বর একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ২০১২ সালের ৪ এপ্রিল অভিযোগ গঠনের মধ্যদিয়ে তার বিচার শুরু করে ট্রাইব্যুনাল। ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদণ্ডের রায় দিলে এর ২৮ দিনের মাথায় আপিল করেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। চলতি বছরের ২৯ জুলাই আপিল বিভাগ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি বহাল রাখে। এরপর গত ৩০ সেপ্টেম্বর তার মানবতাবিরোধী মামলার চূড়ান্ত রায় প্রকাশ করা হয়। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর নিয়ম অনুযায়ী ১৫ দিনের মধ্যে রিভিউ আবেদন করেন তার আইনজীবীরা, যেটি গত ১৮ নভেম্বর খারিজ করে ফাঁসি বহাল রাখা হয়। আর ২১ নভেম্বর (শনিবার) দিবাগত রাত ১২টা ৪৫ মিনিটে ফাঁসি কার্যকরের মধ্যদিয়ে সমাপ্তি ঘটল ৬৬ বছর বয়সী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আলোচিত-সমালোচিত জীবনের। ২২ নভেম্বর,২০১৫/এমটি নিউজ২০১৫/এসএম/ডিআরএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে