বুধবার, ১৪ মার্চ, ২০১৮, ০৩:১৯:৪৯

‘দয়া করে আমাকে বাংলাদেশে নিয়ে যান, এখানে থাকলে আমি বাঁচব না’

‘দয়া করে আমাকে বাংলাদেশে নিয়ে যান, এখানে থাকলে আমি বাঁচব না’

নিউজ ডেস্ক : নেপালের ত্রিভুবন ইউনিভার্সিটি টিচিং হাসপাতালের আইসিইউর বেডে শুয়ে কাতরাচ্ছিলেন আলমুন নাহার অ্যানি। কাঠমান্ডুতে ইউএস-বাংলার বিমান বিধ্বস্ত হয়ে মারা গেছেন তার স্বামী প্রিয়ক আর মেয়ে তামাররা।

অ্যানির শয্যা পাশে দাঁড়াতেই তিনি বলে উঠলেন, ‘চোখের সামনে থেকে এভাবে উধাও হয়ে গেল! কোথায় গেল? আমি কিছুই করতে পারলাম না। আমার বাবুরে নিয়ে আসেন, ও একা থাকতে পারবে না। আমি বাঁচব কেমন করে! প্রিয়ক এখন কোথায়!’ তার এমন প্রশ্নের জবাব দেওয়ার ভাষা জানা ছিল না কারোই।

গতকাল মঙ্গলবার দুপুরের দিকে ওই হাসপাতালের অষ্টম তলার আইসিইউর ১০৮ নাম্বার বেডে দেখা যায় এই হৃদয়বিদারক দৃশ্য। এ হাসপাতালের বাইরে শোকার্ত স্বজনদের আহাজারি। ভেতরে মর্গে লাশের সারি। স্বজনদের কান্না-আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠছে পুরো হাসপাতালের পরিবেশ।

অ্যানির পাশের শয্যায় শুয়ে কাতরাচ্ছিলেন মেহেদী হাসান মাসুম। তিনি জানান, মেয়েকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ হারান গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার জৈনাবাজার এলাকার এফএইচ প্রিয়ক।

দুর্ভাগ্য যে তিনি তিন বছর বয়সী মেয়ে তামারাকেও বাঁচাতে পারেননি। মেহেদী বলেন, পাশাপাশি সিটে বসা ছিলেন প্রিয়ক, তার স্ত্রী ও মেয়ে। বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সহযাত্রী মাসুমের সহযোগিতায় অ্যানি বাইরে বের হয়ে আসেন।

আর তামারাকে নিয়ে বের হতে গিয়ে অঙ্গার হয়ে যান আলোকচিত্রী প্রিয়ক। মৃত্যুপুরী থেকে ফিরে আসা মেহেদী হাসান বলেন, ‘কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দরে সবাই নামার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। সিটবেল্ট খুলতেও শুরু করেছিলাম। কিছু বোঝার আগেই সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। হঠাৎ করেই বিকট শব্দ হয়। সময় মাত্র দুই-তিন সেকেন্ড। এরপর আর কিছু বলতে পারি না।’

বিকেলে কাঠমান্ডু মেডিকেল কলেজ (কেএমসি) হাসপাতালের আইসিইউতে গিয়ে দেখা যায়, অবর্ণনীয় কষ্টে আছেন বুয়েট শিক্ষিকা ইমরানা কবির হাসি। পুরো শরীর ফুলে-ফেঁপে গেছে। পুড়ে গেছে প্রায় ৪০ শতাংশ। অনেকটা মৃতের মতোই নিথর দেহ। বাংলাদেশ থেকে যাওয়া সামির হাসান নামের এক নিকটাত্মীয় হাসির শয্যাপাশে দাঁড়িয়ে চোখ মুছছিলেন।

সামির জানান, দুর্ঘটনায় হাসির স্বামী সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার রকিবুল হাসান মারা গেছেন। হাসিও মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। হাসির সুস্থ হওয়ার বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম আইসিইউ ইনচার্জের কাছে। তিনিও আশার বাণী শোনাতে পারেননি। হাসির পরিবারে চলছে শোকের মাতম।

শুধু হাসিই নন; নেপালে ইউএস-বাংলা বিমান ট্র্যাজেডিতে প্রাণে বেঁচে গেলেও কেএমসি হাসপাতালের আইসিইউতে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন ব্যবসায়ী কবির হোসেন, শেখ রাশেদ রুবায়েত ও সৈয়দা কামরুন্নাহার স্বর্ণা। স্বর্ণা গণস্বাস্থ্য মেডিকেল কলেজের পঞ্চম বর্ষের ছাত্রী।

কেএমসি হাসপাতালের পঞ্চম তলায় আইসিইউতে যখন কাতরাচ্ছিলেন স্বর্ণা, তখন চতুর্থ তলায় তার স্বামী মেহেদী হাসান সার্জারি ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন। সার্জারি ওয়ার্ডে যেতেই উৎকণ্ঠিত মেহেদী প্রতিবেদকের হাত চেপে ধরেই জানতে চান স্ত্রী স্বর্ণার কথা। এর আগে স্বর্ণাও আইসিইউতে একইভাবে ইশারায় জানতে চেয়েছিলেন স্বামীর কথা।

দুর্ঘটনায় গুরুতর জখম হয়েছেন স্বর্ণা। ভেঙে গেছে তার কোমর। ঘাড় মচকে গেছে মেহেদীর। আইসিইউতে থাকা রুবায়েদ রশিদের আঘাত আরও গুরুতর। জখম হয়ে রক্তক্ষরণ হওয়ায় তার বুকে রক্ত জমে গেছে।

কয়েক টুকরো হয়ে গেছে কবির হোসেনের পা। স্বর্ণার কাছে যেতেই তিনি হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। বলেন, দয়া করে আপনারা আমাকে বাংলাদেশে নিয়ে যান, এখানে থাকলে আমি বাঁচব না।

কেএমসি হাসপাতালের আইসিইউর ইনচার্জ ঐশ্বরী লুইরি বলেন, হাসির অবস্থা খুবই আশঙ্কাজনক। তবে এখানে চিকিৎসাধীন অন্য তিনজনের অবস্থা তুলনামূলক ভালো।

কবির হোসেনের ছেলে গতকাল কাঠমান্ডুতে পৌঁছেই ছুটে যান কেএমসি হাসপাতালে। বাবার শয্যাপাশে দাঁড়িয়ে নীরবে অশ্রুপাত করছিলেন তিনি। আইইউসিবিএটির ছাত্র শাওন সমকালকে বলেন, এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তার বাবা। সোমবারও ব্যবসার কাজে এসেছিলেন কাঠমান্ডুতে।

বিমান দুর্ঘটনায় এখন তিনি জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। বেঁচে থাকলেও স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারবেন কি-না সংশয় রয়েছে। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী কে এম শাহজাহান কামাল গতকাল হাসপাতালে এসে আহতদের খোঁজ-খবর নেন।

নেপালে বাংলাদেশ দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি অসিত বরণ সরকার সাংবাদিকদের বলেন, বিমান দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন ১০ বাংলাদেশি। তাদের সবার অবস্থাই সংকটাপন্ন।

ইউএস-বাংলা কর্তৃপক্ষের দেওয়া তালিকা অনুসারে, আহতদের মধ্যে কাঠমান্ডুর নরভিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ইয়াকুব আলী। মোহাম্মদ রেজওয়ানুল হক আছেন ওম হাসপাতালে। কাঠমান্ডু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আছেন শাহরিন আহমেদ, মো. কবির হোসাইন ও মো. শাহিন বেপারি।

ত্রিভুবন হাসপাতালে লাশের সারি : কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন ইউনিভার্সিটি টিচিং হাসপাতালে চলছে স্বজনদের আহাজারি। গতকাল ভোর থেকে এ হাসপাতালে ভিড় জমান নিহত বিমানযাত্রীদের স্বজনরা। দুপুর আড়াইটার দিকে তাদের সঙ্গে যোগ হন নিহত বাংলাদেশিদের স্বজনরাও। টিচিং হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে ৪৯ জনের মরদেহ। তাদের মধ্যে ২৬ বাংলাদেশিও রয়েছেন।

হাসপাতালটির ফরেনসিক বিভাগের সিনিয়র চিকিৎসক অসথিক বলেন, নিহতদের সবারই শরীরের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ পুড়ে গেছে, শনাক্ত করা কঠিন। শেষ পর্যন্ত ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে লাশ শনাক্ত করা লাগতে পারে।

এদিকে বাংলাদেশ থেকে স্বজনরা নেপালে গেলেও তারা লাশ দেখতে পাননি। তাদের ১৫ পৃষ্ঠার একটি ফরম ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে শনাক্তকরণে বিভিন্ন তথ্য চাওয়া হয়। সংশ্নিষ্ট চিকিৎসকরা বলছেন, এ তথ্যের ভিত্তিতে লাশের পোস্টমর্টেম করার সময় শনাক্ত করার চেষ্টা করা হবে।

গতকাল হতাহতদের ৩৯ জন আত্মীয়-স্বজনকে নেপালে নিয়ে আসে ইউএস-বাংলা কর্তৃপক্ষ। তাদের ত্রিভুবন ইউনিভার্সিটি টিচিং হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের পক্ষ থেকে ব্রিফিং দেওয়ার মাধ্যমে সার্বিক বিষয় জানানো হয়।

পরে তাদের হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতালের চিকিৎসক ও কাঠমান্ডু পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পোস্টমর্টেম সম্পন্ন করতে তিন থেকে চার দিন লাগতে পারে। এরপর স্বজনদের লাশ দেখানো হবে। তবে কবে লাশ বাংলাদেশে আসবে তা এখনও ঠিক হয়নি।

হাসপাতালে রয়েছে নজরুল ইসলাম ও তার স্ত্রী আকতারা বেগমের লাশ। গতকাল নেপালে আসেন আকতারা বেগমের ভাই ডা. আইনুদ্দিন ও তার মেয়ে নুসরাত ইয়াসমিন।

ডা. আইনুদ্দিন বলেন, নেপালে এসে কোনো লাভ হয়নি। কারণ লাশ দেখার সুযোগ হচ্ছে না তাদের। ফলে আজ-কাল ফিরে যেতে পারেন তারা। নুসরাত ইয়াসমিন জানান, রাজশাহীতে বসবাস করা নজরুল ইসলাম ও আখতারা বেগমের দুই মেয়ে রয়েছেন। তাদের একজনের নাম কাঁকন। তার বিয়ে হয়ে গেছে। আরেক মেয়ে কনক উত্তরা মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস পড়ছেন।

টিচিং হাসপাতালে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায় দুর্ঘটনায় পড়া ইউএস-বাংলার কেবিন ক্রু নাবিলার ভাসুর মো. বাবুলকে। দুর্ঘটনায় নিহত হন নাবিলা। বাবুল অভিযোগ করে বলেন, নাবিলা ইউএস-বাংলার কেবিন ক্রু। নিজেদের কর্মী হলেও আমাদের তারা তেমন কোনো সহযোগিতা করছেন না।

টিচিং হাসপাতালে দেখা হলে ইউএস-বাংলার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন  বলেন, ‘আমরা হতাহতদের পরিবারকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা দেওয়ার চেষ্টা করছি। যতদিন প্রয়োজন ততদিন সহযোগিতা দিয়ে যাব।’ গকাল বাংলাদেশ থেকে হতাহতদের ৩৯ স্বজনসহ ৪৬ জনকে নেপালে নিয়ে যাওয়া হয় বলে জানিয়েছেন তিনি।

টিচিং হাসপাতালে নিহতদের লাশ রাখায় ওই হাসপাতালে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করে নেপাল পুলিশ। মর্গের ভেতরে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। কাঠমান্ডু পুলিশের কর্মকর্তা শ্রেষ্ঠা জানান, গতকাল দুপুর পর্যন্ত আটজনের লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেছেন চিকিৎসকরা। অবশিষ্ট লাশের ময়নাতদন্ত করতে আরও তিন থেকে চার দিন সময় লেগে যেতে পারে। --সমকাল

এমটিনিউজ২৪/জয়নাল/ এস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে