সোমবার, ২৩ নভেম্বর, ২০১৫, ০৩:০২:৩৪

নতুন দেশ নতুন জীবন

নতুন দেশ নতুন জীবন

ঢাকা : অবশেষে কুড়িগ্রাম বাগভাণ্ডার সীমান্ত দিয়ে প্রথম দফায় ট্রাভেল পাসধারী ৭২ জন নাগরিক ভারতে প্রবেশ করেন রোববার বেলা সাড়ে ১১টায়। শুরু হলো তাদের নতুন দেশে নতুন জীবন। কেমন হবে সে জীবন? সে আশঙ্কা মেনে নিয়েই অনেক সুখস্মৃতি রয়ে গেল বাংলাদেশে।হৃদয়ভাঙা মন আর অশ্রু চোখে অব্যক্ত উচ্চারণ ‘গুড বাই বাংলাদেশ’। তাদের বহন করে ২টি বাস এবং ১০টি মালামালের পিকআপ ভ্যান সরাসরি ভারতের অভ্যন্তরে যায় অস্থায়ী আশ্রয় ক্যাম্পে। এভাবেই পরিসমাপ্তি ঘটলো ৬৮ বছরের বন্দিদশার। সুযোগ হলো পছন্দের দেশে বসবাসের। বাপ-দাদার ভিটেমাটি চিরতরে ফেলে রেখে এক আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টি করে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ির বিলুপ্ত ছিটমহল দাশিয়ারছড়ার ১০ পরিবারের ৪৯ জন নারী পুরুষ ও শিশু কালিরহাট বাজারে জড়ো হয়ে তারা তাদের মূল ভূ-খণ্ড ভারতে চলে যান। সে দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণকারী ৪৯ জন রোববার সকালে সাড়ে নয়টায় তাদের মালামালসহ কালিরহাট বাজার থেকে বাস ও ট্রাক যোগে ভূরুঙ্গামারীর বাগভাণ্ডার পৌঁছেন সোয়া দশটার দিকে। একইভাবে ভূরুঙ্গামারীর ছোট গাড়লঝোড়ার ৫ পরিবারের ২৩ জন মালামাল নিয়ে বাগভাণ্ডার সীমান্তে পৌঁছে।এ সময় তাদের তদারকি করেন ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তা অভিজিৎ রায়, ফারুক আজম ও অরুপ চক্রবর্তী। বাগভাণ্ডার সীমান্তে এসব ভারতীয় নাগরিকদের বিদায় অভ্যর্থনা জানান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) রফিকুল ইসলাম সেলিম, ৪৫ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল জাকির হোসেন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহাব উদ্দিন, ভূরুঙ্গামারী ইউএনও মামুন ভূইয়া, ফুলবাড়ীর ইউএনও নাসির উদ্দিন মাহমুদ, নাগেশ্বরীর ইউএনও আবু হায়াত মো. রহমত উল্লাহ, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সোলেহ মারফ, নবি নেওয়াজ, ওসি জিয়া লতিফ, সাবেক ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা প্রমুখ। তারা মিষ্টি খাইয়ে এবং ফুল ও বিভিন্ন উপহার সামগ্রী দিয়ে ৭২ জন ভারতীয় নাগরিককে বিদায় জানান। ভারতের সাহেবগঞ্জ সীমান্তের অভ্যন্তরে তাদের এই নতুন নাগরিকদের বরণ করতে প্যান্ডেল সাজানো হয়েছে। তারাও ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়ে বরণ করে নেন। এ সময় ভারতের কুচবিহার জেলার ডিএম শ্রী পিউল গানাথন, ১০১ সাহেবগঞ্জ কোম্পানি কমান্ডার অনিন্দ ঘোষসহ সরকারি কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সীমান্তবর্তী পূর্ব সাহেবগঞ্জের সাধারণ মানুষ হাত নেড়ে তাদের সাদর অভ্যর্থনা জানায়। চোখের জলে বিদায় হলেও হাসিমুখে বরণ অনুষ্ঠান বেদনা ভুলতে সহায়ক হবে বলে সবার ধারণা। আন্তর্জাতিক সীমান্ত পিলার ৯৬২-এর ১-এসের পাশ দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় সীমান্তবর্তী শত শত বাংলাদেশী নারী পুরুষ হাত নেড়ে বিদায় জানান। ভারতীয় নাগরিকদের বিদায় জানাতে আসেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক এমপি মো. জাফর আলী। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল ইসলাম মঞ্জু মণ্ডল, বীর মুক্তিযোদ্ধা আক্তারুজ্জামান মণ্ডল, ভূরুঙ্গামারী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি খোকন চৌধুরী, অধ্যক্ষ রাশেদুজ্জামান বাবু, এম এ চাষী করিম প্রমুখ। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কোচবিহার জেলার এমএলএ রবীন্দ্রনাথ ঘোষ বলেন, বঞ্চিত ৬৮বছরের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাওয়া এসব মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য আমাদের সরকার কাজ করে যাচ্ছে। আমরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা সাবেক ছিটমহল হতে যারা ভারতে আসছে তাদের গ্রহণ করা শেষে আমরা তাদের জন্য বরাদ্দে থাকা ফ্লাট নির্মাণে উদ্যোগ নেয়া হবে। এছাড়াও ইতিমধ্যে যারা ভারতে প্রবেশ করেছে তাদের সন্তানদের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করা হয়েছে। দুই দেশের সরকার এবং প্রধানদের আমরা ধন্যবাদ জানাচ্ছি তারা এই অর্ধলক্ষাধিকের বেশি মানুষের ৬৮ বছরের গ্লানি দূর করেছেন। রোববার সকালে দেশের সবচয়ে বড় বিলুপ্ত ছিটমহল দাশিয়ারছড়ায় গিয়ে দেখা যায়, যারা ভারতে যাচ্ছেন না তাদেরকে ঘিরে সান্ত্বনা দিচ্ছে। যারা ভারতে যাচ্ছেন বিদায়লগ্নে তাদের কান্নায় যেন আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে যারা ভারতে যাচ্ছেন তাদের এপারে রেখে যাওয়া আত্মীয়-স্বজনদের বিদায় জানাতে এসে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছেন। ভূরুঙ্গামারী ইউএনও মামুন ভূইয়া জানায়, যারা দাশিয়ারছড়া থেকে তাদের মূল ভূ-খণ্ড ভারতে চলে যাচ্ছেন তাদের বরণ করে নিতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ওপারের সাহেবগঞ্জ রঙিন সাজে সাজিয়ে রেখেছে। ইমিগ্রেশন শেষে দিনের মধ্যেই একে একে সবাইকে ভারতের অভ্যন্তরে অস্থায়ী ক্যাম্পে নেয়া হয়। জেলা প্রশাসক কন্ট্রোল রুমের দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তা সোহেল মারুফ জানান, চলতি বছরের গত ৩১ জুলাই মধ্যরাতে কুড়িগ্রামের অভ্যন্তরে ১২টিসহ বাংলাদেশে ১১১টি ছিটমহল একীভূত হয়। গত ৬-১৬ জুলাই এ জনপদগুলোতে দুই দেশের যৌথ সমীক্ষা পরিচালিত হয়। যৌথ সমীক্ষায় হেড কাউন্টিং হালনাগাদ এবং অধিবাসীদের নাগরিকত্ব বিষয়ে মতামত গ্রহণ করা হয়। এ সময় কুড়িগ্রাম জেলায় অন্তর্ভুক্ত ১২টি ছিটমহলের ৩০৫ জন, লালমনিরহাট জেলায় অন্তর্ভুক্ত ৫৯টি ছিটমহলের ১৯৭ জন এবং পঞ্চগড় জেলার ৩৬টি ছিটমহলের ৪৮৭ জন নিয়ে মোট ৯৮৯ জন ভারতের নাগরিকত্ব বহাল রেখে সে দেশে যাওয়ার জন্য মতামত প্রদান করেন। ১১ দিন যৌথ জনগণনা জরিপ চলাকালীন ভারত যেতে কুড়িগ্রামের ৩টি ছিটমহলের ৩শ ৫ জন মতামত প্রদান করেন। এদের মধ্যে রয়েছে ফুলবাড়ির দাশিয়ারছড়া থেকে ৫৮টি পরিবারের ২৮১ জন এবং ভূরুঙ্গামারীর ২টি ছিটের ৬ পরিবারের ২৪ জন সদস্য। ভারতের নাগরিকত্ব বহাল রাখার জন্য ৩০৫ জনের মধ্যে ২৮১ জন ট্রাভেল পাস সংগ্রহ করেছেন। এদের মধ্য থেকে দাশিয়ারছড়ার ১৯টি পরিবারের ৭০ জন নাগরিক তাদের মত পাল্টিয়ে এ দেশে থাকতে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত বরাবর আবেদন করেছেন। জেলা প্রশাসক খান মো. নুরুল আমিন জানান, ট্রাভেলপাস প্রাপ্তদের ভারতে যাওয়ার সব প্রস্তুতি ছাড়াও কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। কিন্তু যারা এখন ভারতে যেতে চায় না তাদের ব্যাপারে সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে সিদ্ধান্ত জানায়নি। তবে নির্দেশনা রয়েছে কাউকে ভারতে যেতে বাধ্য করা হবে না। এ অর্থে ভারতের ট্রাভেল পাসধারীরা ভারতে যেতে না চাইলে বাংলাদেশে থেকে যেতে পারবেন। ২৩ নভেম্বর,২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসএম/ডিআরএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে