এমরান হোসাইন শেখ : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভ্যাটবিরোধী আন্দোলনের রেশ কাটতে না-কাটতেই নিজেদের দাবি নিয়ে মাঠে নেমেছেন দেশের শিক্ষকরা। প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা প্রতিটি স্তরের শিক্ষকরা স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো, গ্রেড পুনঃনির্ধারণ, অষ্টম বেতন কাঠামোতে বাদ দেওয়া সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল পুনর্বহালসহ নানা দাবিতে আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। ইতোমধ্যে ক্লাস-বর্জনসহ কর্মবিরতিও শুরু করেছেন তারা।
এ সব দাবিতে শনিবার কর্মবিরতি কর্মসূচি পালন করেছেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও সরকারি কলেজের শিক্ষকরা। যে কারণে শনিবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন মাস্টার্সের নির্ধারিত পরীক্ষাসহ অভ্যন্তরীণ কোনও পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। রবিবারও তাদের এ কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।
সূত্রমতে, প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা প্রায় সব ধরনের পরীক্ষা বর্জনেরও হুমকি দিচ্ছেন শিক্ষকেরা। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নির্বিঘ্নে স্নাতক শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠান ও আগামী নভেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠান নিয়ে একটা শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
এদিকে, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ শনিবার আন্দোলনত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক প্রতিনিধিদের সঙ্গে তাদের দাবি-দাওয়ার বিষয়ে বৈঠক করলেও কোনও সিদ্ধান্ত ছাড়াই তা শেষ হয়েছে। সব মিলিয়ে এ সব পেশাজীবী সংগঠনের আন্দোলনে বেশ খানিকটা চাপে পড়েছে ক্ষমতাসীন সরকার।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যলয়ের টিউশন ফি’র ওপর শতকরা সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট আরোপের জের ধরে গত দুই সপ্তাহ টালমাটাল ছিল সারা দেশ। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে রাজধানীসহ দেশের বড়-বড় নগরীতে অবরোধ গড়ে তোলে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে সরকার প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর ভ্যাটের বিষয়টি চাপিয়ে দিলেও তাতে শেষ রক্ষা হয়নি। তীব্র আন্দোলনের মুখে গোটা রাজধানীর জনজীবন অচল হয়ে পড়ায় সরকার ওই ভ্যাট প্রত্যাহারে বাধ্য হন।
শিক্ষার্থীদের ভ্যাট প্রত্যাহারের আন্দোলনের রেষ থাকতেই দাবি আদায়ে এখন রাজপথে নেমে এসেছে দেশের প্রতিটি স্তরের শিক্ষকেরা। অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেলে তাদের ‘অবমূল্যায়নের’ অভিযোগ তুলে গত কয়েকদিন ধরেই স্ব-স্ব স্তরের শিক্ষকসমাজ পৃথক কর্মসূচির ডাক দিয়েছে।
শনিবার সরকারি কলেজের শিক্ষকেরা সারা দেশের সব সরকারি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে দিনব্যাপী কর্মবিরতি পালন করেছে। ঈদের আগের শেষ কর্ম দিবস রবিবারও তারা একই কর্মসূচি পালন করবেন বলে জানিয়েছেন। শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, শনিবার কোথাও তারা পাঠদান তো করেননি অভ্যন্তরীণসহ কোনও পরীক্ষাও তারা গ্রহণ করেননি। যে কারণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শনিবারের নির্ধারিত মাস্টার্স পরীক্ষাটিও অনুষ্ঠিত হয়নি।
রাজধানীর উত্তরাস্থ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারি কলেজের এক শিক্ষক প্রতিবেদককে জানান, শনিবার তারা সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ রাখেন। কলেজে একাদশ শ্রেণির একটি পরীক্ষা থাকলেও তা নেওয়া হয়নি বলেও ওই শিক্ষক জানান। রাজধানীর ঢাকা কলেজ, তিতুমীর কলেজ, ইডেন কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজসহ প্রতিটি সরকারি কলেজেই কর্মবিরতি পালিত হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। রাজধানীর বাইরে চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী, সিলেটসহ প্রতিটি বিভাগের সকল সরকারি কলেজে একই কর্মসূচি পালিত হয়।
চট্টগ্রামের হাজী মোহাম্মদ মহসীন কলেজের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক মো. ইদ্রিস আলী বলেন, নতুন স্কেলে বেতন বাড়লেও সেটা আমরা উপভোগ করতে পারছি না। কারণ, এটা আমাদের সম্মানের প্রশ্ন। শিক্ষকদের কর্মবিরতির কারণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে।
আন্দোলনের বিষয়ে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এ কে এম ফজলে রাব্বি এই প্রতিবেদককে জানান, শনিবার সারা দেশে তারা কর্মবিরতি পালন করেছেন। রবিবারও তাদের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। রবিবার ঈদুল আজহা উপলক্ষে কলেজ ছুটি হয়ে যাবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ঈদের পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার পর আমরা আবার কর্মসূচি শুরু করব।
দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে এই শিক্ষক নেতা বলেন, আমাদের দাবি মানা না হলে আমরা আরও কঠোর কর্মসূচি দিতে বাধ্য হব।
সমিতির মহাসচিব আই কে সেলিম উল্লাহ খন্দকার বলেন, অষ্টম জাতীয় বেতন কাঠামোয় সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল পুনর্বহাল এবং শিক্ষা ক্যাডারের বেতন বৈষম্য নিরসন করে অধ্যাপকদের গ্রেড উন্নীত করার দাবিতে দেশের ৩০৫টি সরকারি কলেজে কর্মরত প্রায় ১৪ হাজার শিক্ষক ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনসহ কর্মবিরতি পালন করবেন। দাবির পক্ষে সব শিক্ষকদের স্বাক্ষর সংগ্রহ করে প্রধানমন্ত্রী বরাবর জমা দেওয়ার লক্ষ্যে তা ১৮ অক্টোবর শিক্ষামন্ত্রীর কাছে পেশ করা হবে বলেও তিনি জানান।
স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো ও নতুন জাতীয় পে-স্কেলে বেতন বৈষম্য নিরসনসহ বিভিন্ন দাবিতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় চার লাখ শিক্ষক বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে শনিবার অর্ধদিবস কর্মবিরতি পালন করছেন। রবিবার তারা অর্ধদিবস ও সোমবার পূর্ণ দিবস কর্মবিতি পালন করবেন বলে জানিয়েছেন।
স্বতন্ত্র বেতন স্কেলসহ বিভিন্ন দাবিকে বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির কয়েকটি অংশ স্ব-স্ব ব্যানারে এ কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। দাবি পূরণ না হলে জাতীয় প্রেসক্লাব চত্বরে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করবেন এবং প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দেবেন বলে শিক্ষক নেতারা জানিয়েছেন।
সমিতির যুগ্ম সম্পাদক শেখ আব্দুস সালাম মিয়া দাবি আদায়ে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে প্রতিবেদককে বলেন, প্রয়োজনে আসন্ন বার্ষিক পরীক্ষা ও প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা বর্জন করে রাজপথে নেমে আমরা দাবি আদায় করব।
শনিবার কোনও সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের বৈঠক। তবে দুই পক্ষই সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আরও আলোচনা চলবে বলে জানিয়েছে। রাজধানীর মিন্টো রোডে শিক্ষামন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে বেলা ১১টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টার কিছু বেশি সময় ধরে এ বৈঠক চলে। এতে শিক্ষকদের প্রতিনিধি দলে নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি ফরিদ উদ্দিন আহমেদ ও মহাসচিব এ এস এম মাকসুদ কামাল।
মন্ত্রিসভায় অষ্টম বেতন স্কেল অনুমোদন হওয়ার পর পৃথক বেতন কাঠামো ও পদমর্যাদা সংক্রান্ত সমস্যা নিরসনের দাবিতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষামন্ত্রীর এটি প্রথম বৈঠক। বৈঠক শেষে মন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ আশা প্রকাশ করেন, বৈঠকে কোনও সিদ্ধান্ত না হলেও শিগগিরই এ ব্যাপারে একটি সুষ্ঠু সমাধানে পৌঁছানো যাবে। সবাই হাসিমুখে ঘরে ফিরতে পারবেন।
শিক্ষক নেতা ফরিদ উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, তাদের প্রথম ও প্রধান দাবি—স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো। এ দাবিতে আন্দোলনও চলবে, আলোচনাও চলবে। পরে এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, পৃথক বেতন কাঠামোর জন্য অবিলম্বে একটি কমিশন গঠন করতে হবে। এটি আমরা বলেছি।
এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ঈদুল আজহার ছুটি শুরু হয়ে যাওয়ায় আন্দোলনের কর্মসূচি সাময়িকভাবে স্থগিত হলে ঈদের পর তা আবার শুরু হবে বলে জানা গেছে। গত বৃহস্পতিবার ঈদের আগের শেষ কর্মদিবসে কুমিল্লা বিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় কর্মবিরতি পালন করা হয়।-বাংলা ট্রিবিউন
২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে