শনিবার, ০৫ ডিসেম্বর, ২০১৫, ০৬:৫৯:২৯

‘প্রেসিডেন্ট পাকিস্তানকে সহায়তা করতে চেয়েছিলেন’

‘প্রেসিডেন্ট পাকিস্তানকে সহায়তা করতে চেয়েছিলেন’

এস এম নন্দ : এটা সত্য যে সেই সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন স্যাটেলাইটের মাধ্যমে মার্কিন জাহাজের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে আমাদের খবর দিত। ১১ থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত বেশ কিছু বড় ঘটনা ঘটে, যার বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া প্রয়োজন। আমরা পরিষ্কার জানতাম যে ইসলামাবাদ পূর্ব পাকিস্তানের হাইকমান্ডকে এই বলে আশ্বস্ত করেছিল যে বন্ধু শক্তিগুলো তাদের দিকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে যাচ্ছে। তারা কখনো কখনো এই বন্ধু শক্তিকে ‘সাদা’ আবার কখনো ‘হলুদ’ বলে অভিহিত করত। ওই পরিস্থিতিকে আমরা হালকাভাবে নিতে পারতাম না, কারণ তাদের কোডের অর্থ আমরা পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারছিলাম। ১১ থেকে ১৩ ডিসেম্বর আমরা ওই এন্টারপ্রাইজের অবস্থানের বিষয়ে একটু সন্দিহান ছিলাম, কিন্তু ১৪ ডিসেম্বর মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ হলে আমরা বুঝতে পারলাম, মার্কিন সেনারা মালাক্কা প্রণালিতে অবস্থান করছে। আমরা জানতাম, পূর্ব পাকিস্তানের পতনের আগে ও পরে সপ্তম নৌবহরের ভূমিকা একদম ভিন্ন হবে। সে সময় আমাদের যতই আত্মবিশ্বাস থাকুক না কেন, পূর্ব পাকিস্তানের পতনের পর সপ্তম নৌবহর কী করবে, সে বিষয়ে আমরা সত্যি তেমন কিছু জানতাম না। যুদ্ধের পর বেশ কিছু ভাষ্য পেয়েছিলাম, যার মধ্যে ছিল মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের স্মৃতিকথা ও অ্যাডমিরাল এলমো জুমওয়াল্টের বই অন ওয়াচ। এসব ভাষ্যে ঘটনার নতুন বিবরণ পাওয়া যায়। অধিকাংশ ভাষ্যই বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতে একমত হয়, কিন্তু বিস্তারিত বিবরণে তাদের মধ্যে ভিন্নতা দেখা যায়। আর এই বিস্তৃতিই আসলে যেকোনো ঘটনার পরিণতি নির্ধারণ করে। অ্যাডমিরাল জুমওয়াল্ট তাঁর স্মৃতিকথা অন ওয়াচ-এ বলেছেন, ১৯৭১ সালের মার্চ মাস থেকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সম্পর্কের দ্রুত অবনতি হতে শুরু করে। সে সময় ভারত মহাসাগর–বিষয়ক মার্কিন নীতি প্রণয়নের ব্যাপারটাও একাডেমিক রূপ লাভ করে। ওয়াশিংটন অ্যাকশন গ্রুপ ভারত-পাকিস্তানের দ্রুত অবনতিশীল সম্পর্ক নিয়ে কয়েকবার বৈঠক করে, ১৭ আগস্ট, ৮ সেপ্টেম্বর, ৭ অক্টোবর, ২২ নভেম্বর ও ১, ৩, ৪, ৬ ও ৮ ডিসেম্বর তারা এ বিষয়ে বৈঠক করে। বৈঠকের সূচি দেখেই বোঝা যায়, এ ব্যাপারে মার্কিন প্রশাসনের উদ্বেগ নিতান্ত সামান্য ছিল না। মার্কিন প্রশাসন একটি মতৈক্যে আসার জন্য অন্ধের মতো পথ হাতড়ে ফিরছিল, কিন্তু তারা সব সময় সময়ের চেয়ে এক কদম দূরেই ছিল, ফলে তারা ঘটনাপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিল না। মনে হচ্ছিল কোনো কিছুই কাজ করছে না। ‘শক্তিশালী’ কূটনৈতিক উপস্থিতি নিশ্চিত করে বা ২১ নভেম্বর ভারতে অর্থনৈতিক সহায়তা বন্ধ করেও লাভ হয়নি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ভারত তার জাতীয় স্বার্থেই কাজ করবে, তা সে ‘বিশ্ব সম্প্রদায়ের মতামত যা-ই হোক না কেন’, আর ভারত ঠিক তা-ই করেছে। ভারতকে ভিন্ন পথে প্রবাহিত করতে না পেরে কিসিঞ্জার রাগে গরগর করেছেন, অ্যাডমিরাল জুমওয়াল্টের মতে, এটি আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। সুপরিচিতি লেখক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার জ্যাক অ্যান্ডারসন আরও কিছু বলেছেন। তার মতে, অ্যাডমিরাল জুমওয়াল্ট যুক্তরাষ্ট্রের এই পাকিস্তানঘেঁষা নীতির বিরোধিতা করায় দেশটির প্রশাসন আরও খেপে যায়। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্টের নির্দেশে টাস্ক গ্রুপ ৭৪ গঠিত হয়, যে বিষয়ে নৌবাহিনীর সঙ্গে আগে কোনো কথা বলা হয়নি। এর মধ্যে ছিল পারমাণবিক অস্ত্রসংবলিত বিমান পরিবাহক এন্টারপ্রাইজ ও এসকর্টস। নির্দেশ ছিল, সেগুলোকে ভারত মহাসাগরে মোতায়েন করা হবে। ১২ ডিসেম্বর এন্টারপ্রাইজ দলকে মালাক্কা প্রণালি দিয়ে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু পরের দিনই এই আদেশ বদলে ফেলা হয়। আরও কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার হলো এই দলকে ঢাকা থেকে মার্কিন নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এটা একরকম ছলনা ছিল, কারণ অবশিষ্ট ব্যক্তিদের ১২ ডিসেম্বরের মধ্যে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। একদমই দৈবক্রমে তখন ভারত মহাসাগরে দুটি বিমান পরিবাহকসহ বিপুলসংখ্যক ব্রিটিশ সেনা অবস্থান করছিল। দিল্লিতে অবস্থানরত ব্রিটিশ নৌ অ্যাটাশে আমার সঙ্গে দেখা করে বললেন, দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে যে ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ ছিল, পূর্ব পাকিস্তান থেকে ব্রিটিশ নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে সেটা ভারত মহাসাগরের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি তাকে বললাম, আমি যত দূর জানি, সেখান থেকে সব ব্রিটিশ নাগরিককে ইতিমধ্যে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। আমি তাঁকে পরামর্শ দিলাম, যেহেতু ব্রিটেন এই দ্বন্দ্ব-সংঘাত থেকে দূরে রয়েছে, সেহেতু তাঁর এমন অপ্রয়োজনীয়ভাবে যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়ে নিজের সুনাম নষ্ট করা ঠিক হবে না। কারণ, কিছুদিনের মধ্যেই পূর্ব পাকিস্তান আত্মসমর্পণ করবে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে একটি সোভিয়েত ডেস্ট্রয়ার ও মাইনসুইপার মালাক্কা প্রণালি দিয়ে ওই এলাকায় প্রবেশ করে। সোভিয়েতদের প্রশান্ত মহাসাগরের নৌবহর থেকে আরও কিছু জাহাজ তার সঙ্গে যোগ দেয়। ফলে নৌবহরের ব্যাপারটা বেশ জটিল হয়ে ওঠে। জুমওয়াল্টের পরামর্শক্রমে এন্টারপ্রাইজকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়, তাকে শ্রীলঙ্কার দক্ষিণে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়। দ্বিতীয় দলের উপস্থিতিতে সোভিয়েত নৌবাহিনী আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে, তাদের কারণে আমেরিকান টাস্ক গ্রুপ ঢাকা পড়ে যায়। মার্কিনরা ১৯৭২ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ওই এলাকা ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত সেই পরিস্থিতি বিরাজ করেছে। জুমওয়াল্ট নিজের কথা বলেছেন এভাবে, তিনি এন্টারপ্রাইজের লক্ষ্য সম্পর্কে একদমই পরিষ্কার ছিলেন না। যুক্তরাষ্ট্র নিজের মিত্রের সংকটের সময় তার পাশে দাঁড়ায়—পৃথিবীকে এটা দেখানো ছাড়া তার আর কোনো লক্ষ্য থাকতে পারে না। অ্যাডমিরাল জুমওয়াল্ট ইউনাইটেড সার্ভিস ইনস্টিটিউটে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য ১৯৮৯ সালের নভেম্বরে ভারতে এসেছিলেন। যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, ১৯৭১ সালে ভারত মহাসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠানোর উদ্দেশ্য কী ছিল। তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, কিসিঞ্জার তাকে বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট পাকিস্তানকে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন। পারমাণবিক বিমান পরিবাহক এন্টারপ্রাইজসহ প্রয়োজনীয় এসকর্ট জাহাজ ও সরবরাহ দিয়ে ১০ ডিসেম্বর এক টাস্ক গ্রুপ গঠন করা হয়, এরপর সেটা সিঙ্গাপুরে মোতায়েন করা হয়। এই টাস্ক গ্রুপের লক্ষ্য কী ছিল, তা পরিষ্কার নয়। জুমওয়াল্ট কিসিঞ্জারকে জিজ্ঞেস করেন, ভারতীয় নৌবাহিনীর সম্মুখীন হলে তারা কী করবেন। কিসিঞ্জার উত্তর দিয়েছিলেন, ‘সেটা আপনাদের সমস্যা।’ ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর জুমওয়াল্টকে ভারত মহাসাগরে জাহাজ পাঠানোর কথা বলা হয়, আরও বলা হয়, দিনের আলো থাকতেই মালাক্কা প্রণালি পাড়ি দিতে হবে, যাতে সারা পৃথিবী তা দেখতে পারে। কিসিঞ্জারের নির্দেশ ছিল আসলে অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিকর। বক্তৃতার পর আমি জুমওয়াল্টকে আমার বাড়িতে মদ্যপানের দাওয়াত দিই, সেখানে আমাদের বিস্তারিত কথা হয়। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, ওই খবর পাওয়ার পর আমার প্রতিক্রিয়া কী হয়েছিল, আর আমার পরিকল্পনাই বা কী ছিল। আমি বললাম, খবরটা পাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী আমাকে ডেকে পাঠান, তিনি আমাকে বলেন, নৌবাহিনী কী করতে যাচ্ছে। এরপর আমি প্রয়োজনীয় খুঁটিনাটি বিষয়গুলোও স্মরণ করলাম। জুমওয়াল্ট হাসলেন। যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গিয়ে তিনি একটি নিবন্ধ লিখলেন। তার একটি কপিসহ ও নিজের আত্মজীবনী অন ওয়াচ-এর একটি কপি তিনি আমাকে পাঠিয়েছিলেন, বইটিতে তিনি লিখেছিলেন ‘অ্যাডমিরাল নন্দকে, যিনি ১৯৭১ সালে জানতেন, বিঘ্ন এড়াতে হলে কী করতে হবে।’ শ্রদ্ধাসহ ই আর জুমওয়াল্ট। লেখক : অ্যাডমিরাল এস এম নন্দ: ভারতীয় নৌবাহিনীর সাবেক প্রধান। -প্রথম আলো ০৫ ডিসেম্বর,২০১৫/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে