ঢাকা : ঈদের আর মাত্র চার দিন বাকি। বৃষ্টির কারণে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার গরু ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়েছেন। একদিকে পশুর হাটে ক্রেতা শুন্যতা অন্যদিকে বৃষ্টির প্রকোপে গরুর রোগবালাইয়ের শংকায় রয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এসব কারণে ব্যবসায়ীদের কপালে চিন্তার ভাজ পড়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন পশুহাট ঘুরে দেখা গেছে নানা চিত্র।
তবে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের প্রভাবে মুষলধারার বৃষ্টিতে অধিকাংশ হাট কাদাপানিতে তলিয়ে যাওয়ায় দিনভর ক্রেতাদের প্রায় কেউই সেমুখো হয়নি। হাতেগোনা সামান্য কিছু ক্রেতা হাটে এলেও বৃষ্টির ভোগান্তিতে তারাও বেশিক্ষণ সেখানে থাকেননি।
দু-চারজন ঝুঁকি নিয়ে গরু কিনলেও তারা পড়েছেন মহাবিপাকে। নগরীর অধিকাংশ জলাবদ্ধ সড়কে ভয়ঙ্কর যানজটের মাঝে গরু নিয়ে বৃষ্টি মাথায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থেকে তাদের অনেকেরই নাভিশ্বাস উঠেছে।
রোববার সকালে রাজধানীর একমাত্র স্থায়ী পশুহাট গাবতলীতে গিয়ে দেখা যায়, ক্রেতার উপস্থিতি সংখ্যা খুবই কম। তারওপর বৃষ্টি বেপারীদের দারুন বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে।
এদিকে, আনুষ্ঠানিকভাবে হাট শুরুর দ্বিতীয় দিনেও বেচাকেনা না হওয়ায় গরুর বেপারিদের মাথায় হাত পড়েছে। এর ওপর খোলা আকাশের নিচে দিনভর বৃষ্টির পানিতে ভিজে বিপুল সংখ্যক গরু-ছাগল জ্বরসহ নানা রকম রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ায় পশু ব্যবসায়ীদের মাঝে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে যেসব কৃষক সামান্য কিছু বেশি লাভের আশায় হালের দু-তিনখানা গরু নিয়ে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে ঢাকার হাটে এসেছেন, তারা রয়েছেন চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায়।
আবহাওয়ার আগাম বার্তা অনুযায়ী, বৃষ্টি আগামী আরো দুই দিন অব্যাহত থাকলে কোরবানির পশুর হাটের বেচাকেনা শিকেয় উঠবে_ এই আশঙ্কায় গরুর বড় খামারি এবং বেপারিরাও ভেঙে পড়েছেন।
তাদের ভাষ্য, এভাবে বৃষ্টি ঝরতে থাকলে বড় ধরনের ঝক্কি-ঝামেলার ভয়ে বিত্তশালীদের অনেকেই একাধিক পশু কোরবানির প্রত্যাশা থেকে সরে আসবে। নিম্ন এবং মধ্যবিত্তরাও ভোগান্তির শঙ্কায় ভাগে গরু কোরবানি দেবে। এছাড়া বৃষ্টিতে গরু রাখার স্থান সংকটের কারণে অধিকাংশ ক্রেতা শেষ সময়ে গরু কেনার চেষ্টা করবেন। এতে বাজার পরিস্থিতি হঠাৎ বেসামাল হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করেন বেপারিরা।
রোববার দুপুরে শাজাহানপুর হাট ঘুরে দেখা গেছে, গরুর বেপারিরা ছোট-বড় পলিথিন ও ত্রিপল টাঙিয়ে বৃষ্টির পানি থেকে গরু রক্ষার চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ ব্যস্ত গামলা দিয়ে পানি সেচে গরু বেঁধে রাখার জায়গাটুকু শুকনো রাখতে। তবে দুপুরের পর আবারো মুষলধারে বৃষ্টি হওয়ার পর আর কারো কোনো চেষ্টাই কাজে লাগেনি। হাটের পাশাপাশি আশপাশের রাস্তাও বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বিকালের পর ক্রেতাদের কেউ আর শখ করেও সেদিকে পা বাড়ায়নি। তাই সেই সময় থেকে গভীর রাত পর্যন্ত অধিকাংশ বেপারিই মস্নানমুখে গরুর দড়ি ধরে বসে থেকেছেন।
কুষ্টিয়ার মিরপুর থেকে মাঝারি সাইজের ১১টি গরু নিয়ে শাজাহানপুর হাটে আসা গরুর বেপারি নূরুজ্জামানের কাছে বাজারদর জানতে চাইলে তিনি মস্নানমুখে বলেন, 'কাস্টমারই তো হাটে নাই, দাম জিগ্যাইবো ক্যাডা?' রোববার সারাদিনে মাত্র চারজন ক্রেতা তার গরু হাতিয়ে দেখেছেন। তাদের মধ্যে শুধু একজন দাম জিজ্ঞেস করেছেন। তবে দাম চাওয়ার আর কোনো কথা না বলেই ওই ক্রেতা চলে গেছেন বলে জানান নূরুজ্জামান। তার মতোই হতাশার সুরে কথা বলেন পাবনার গরুর বেপারি জামাল উদ্দিন শেখ।
তিনি জানান, রোববার সকালে ট্রাকে গরু আনার পথে খড়-ভুসির সঙ্গে তার সব গরুও ভিজে চুপসে গেছে। হাটে এসেও পানি-কাদার মধ্যে গরু রাখতে হয়েছে। দুপুরের পর থেকে তার ১৬টি গরুর মধ্যে ২টি গরু প্রচন্ড জ্বরে কাঁপছে। ৫-৭ জন ক্রেতা গরুর পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও বিকাল পর্যন্ত কেউ দরদাম করেনি।
রাজধানীর মেরাদিয়া হাটের বেপারিদের চোখেমুখেও দিনভর একই ধরনের হতাশার ছাপ দেখা গেছে। সেখানকার ইজারাদারের একাধিক প্রতিনিধি জানান, দুপুর পর্যন্ত ছোট-বড় মিলিয়ে ৪০-৪৫টি গরু বিক্রি হয়েছে। বড় বেপারিরা সাহস করে চড়া দাম হাঁকলেও গৃহস্থরা সামান্য লাভ হাতে রেখেই গরুর দাম চাইছেন। তাদের অনেকেই সেই লাভ কিছুটা কমবেশি করে গরু বিক্রিও করছেন। তবে বৃষ্টির কারণে হাটে ক্রেতা না থাকায় বেপারিদের পাশাপাশি খোদ হাট ইজারাদারও আতঙ্কে রয়েছেন।
রাজীব হোসেন নামে গোড়ানের একজন ক্রেতা জানান, গরু কেনার উদ্দেশ্য নিয়েই তিনি সকালে হাটে এসেছিলেন। কিন্তু কাদাপানিতে হাটের অধিকাংশ স্থান তলিয়ে যাওয়ায় গরু না কিনেই তিনি বাড়ি ফিরছেন। বৃষ্টির ভোগান্তিতে হাটে হাটে ঘুরে দেখেশুনে কোরবানির গরু কেনার শখ তার মিটে গেছে।
কমলাপুর হাটে গিয়ে দেখা গেছে, ইজারাদারের লোকজন কংক্রিট ফেলে কাদাযুক্ত জায়গাগুলো ভরাট করছে। গরুর বেপারির সহকর্মীরাও এতে হাত লাগিয়েছে। খুঁটিতে বেঁধে রাখার পশুর মাথার ওপর পলিথিনের ছাউনি তৈরি করা হয়েছে। সারি সারি পশুর ফাঁকে বিক্রেতারা ছাতা-মাথাল মাথায় দিয়ে ঘাড় গুজে বসে আছেন। দেড়-দুইশ' ক্রেতা হাটের শুকনো রাস্তা ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাদের অনেকে গরু-মহিষ হাতিয়ে দেখলেও দরদাম করছেন সামান্য কয়েকজন। তবে শেষ পর্যন্ত গরু কিনে নিয়ে বাসায় ফিরেছেন_ এমন ক্রেতার সংখ্যা একেবারেই নগণ্য।
তবে বৃষ্টির ভোগান্তির জন্য কেনাবেচা এখনো জমে না উঠলেও হতাশ নন সেখানকার হাট ইজারাদারদের প্রতিনিধিরা। তাদের ভাষ্য, দিনরাত অঝর ধারায় বৃষ্টি না হলেও এই হাটে তেমন কোনো সমস্যা হবে না। অন্য যে কোনো হাটের চেয়ে এর রাস্তাঘাট প্রশস্ত এবং উঁচু থাকায় ক্রেতারা এখানেই বেশি আসবেন বলে আশা করেন তারা।
এদিকে, দুপুর ও বিকালের মুষলধারার বৃষ্টির মধ্যেও গাবতলী হাটে বিপুল সংখ্যক গরু-মহিষ ও ছাগল-ভেড়া বিক্রি হয়েছে বলে দাবি করেন সেখানকার হাট ইজারার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাদের ভাষ্য, পশুর স্থায়ী এই হাটটিতে সারা বছরই বেচাকেনা চলে। এছাড়া এখানে পশুর আমদানিও বেশি। তাই রাজধানীর বিপুল সংখ্যক ক্রেতা গরু-ছাগল কিনতে সেখানেই ঢু মারেন আগে।
এই হাট ঘুরে দেখা গেছে, দেশি এবং ভারতীয় গরুতে গোটা হাট ভরা। এরপর বিভিন্ন এলাকা থেকে ট্রাকে ট্রাকে গরু আসছে। ছোট ও মাঝারি সাইজের ৬০-৭০ থেকে এক-দেড় লাখ টাকার গরুর পাশাপাশি ৫-৭ লাখ থেকে ১৫-১৬ লাখ টাকারও বিপুল সংখ্যক গরু রয়েছে। বৃষ্টির মাঝেও ছাতা কিংবা পলিথিন মাথায় দিয়ে ক্রেতারা গরু দরদাম করছেন। সাধ ও সাধ্যের সমন্বয় করে অনেকেই গরু কিনে নিয়ে ঘরে ফিরছেন।
চুয়াডাঙ্গার কৃষক জাহাঙ্গীর মিয়া জানান, তারা ৮ জন মিলে ১৮টি গরু হাটে বিক্রির জন্য এনেছেন। রোববার সকালেই ৩টি গরু আশানুরূপ দামে বিক্রি করেছেন। আরো দুটি গরুর ক্রেতাও মোটামুটি ঠিকঠাক। এক-দেড় হাজার টাকা দাম বাড়লেই এই দুটি গরু তারা ক্রেতাদের হাতে তুলে দেবেন।
জাহাঙ্গীরের দাবি, গরুর দাম মোটামুটি ভালোই। বৃষ্টির কারণে রোববার বাজার না জমলেও সোমবার থেকে এ অবস্থার আশানুরূপ পরিবর্তন ঘটবে বলে মনে করেন তিনি।
কুষ্টিয়ার আলমডাঙ্গা থেকে আসা আবদুর রহমান জানান, তারা ১৩টি গরু নিয়ে হাটে এসেছেন। এর মধ্যে একটি সাড়ে ৪ লাখ টাকার। বৃষ্টির কারণে কিছুটা শঙ্কার কথাও শোনা গেল তার মুখে।
তবে তার সঙ্গীদের আশা, হাট জমে ওঠার আগে বৃষ্টি পুরোপুরি বিদায় নেবে। এবারকার বাজারদর সহনীয় পর্যায়েই থাকবে।
২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে