বিএনপি জোটের বাঁধন আলগা
সেলিম জাহিদ: বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির কাছে যথাযথ ‘মূল্যায়ন’ না পাওয়ায় জামায়াত ইসলামসহ বেশ কয়েকটি দলের ক্ষোভ আছে। অন্যদিকে জোটের ইসলামপন্থী দুটি দলের ওপর সরকারের দিক থেকে চাপ আছে জোট ছাড়ার। দুইয়ে মিলে বিএনপি জোটের বাঁধন কিছুটা আলগা হয়ে গেছে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, ২০১৩ সালে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের আকস্মিক উত্থানের পর ইসলামী ঐক্যজোট ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নেতাদের বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট ছাড়ার চাপ রয়েছে। জামায়াতের পর ইসলামপন্থীদের মধ্যে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক এ দুটি দলের ভালো প্রভাব আছে। প্রধানমন্ত্রীর একজন প্রভাবশালী উপদেষ্টা ও সরকারের দুটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার কর্মকর্তারা দল দুটির শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও যোগাযোগ রাখছেন। পবিত্র হজ পালনসহ কয়েকজন নেতাকে নানাভাবে সহযোগিতা দেওয়ার কথাও দলগুলোর ভেতরে আলোচনা আছে।
ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান ছিলেন প্রয়াত মুফতি ফজলুল হক আমিনী। এখন তাঁর ছেলে আবুল হাসানাত আমিনী এ দলের ভাইস চেয়ারম্যান, আবদুল লতিফ নেজামী চেয়ারম্যান। আর জমিয়তের নির্বাহী সভাপতি হলেন মুফতি মোহাম্মদ ওয়াক্কাছ, মহাসচিব নূর হোসাইন কাসেমী। দুজনই হেফাজতে ইসলামেরও কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির।
জমিয়ত ও ঐক্যজোটের তিনজন দায়িত্বশীল নেতা জানান, বিএনপির সঙ্গ ছাড়তে তাঁদের ওপর সরকারের চাপ আছে। জোট না ছাড়লে নেতাদের বিরুদ্ধে থাকা মামলা সক্রিয় করার পাশাপাশি তাঁদের নিয়ন্ত্রণাধীন মাদ্রাসাগুলোর দখল হারানোর হুমকি রয়েছে। এঁদের মধ্যে নূর হোসাইন কাসেমী বারিধারার জামেয়া মাদানিয়া মাদ্রাসা, মিরপুরের আজরাবাদ মাদ্রাসা, ইসলামী ঐক্যজোটের নেতারা লালবাগ জামেয়া কোরআনিয়া আরাবিয়া ও পুরান ঢাকার আশরাফুল উলুম বড় কাটারাসহ রাজধানী ঢাকায় অন্তত ২০টি মাদ্রাসা পরিচালনা করেন।
২০ দলের সূত্র জানায়, সরকারের তরফ থেকে এই চাপ তো আছেই; পাশাপাশি বিএনপির পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে অবজ্ঞা-অবহেলায় ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত জামায়াত, ইসলামী ঐক্যজোট, জমিয়ত ও খেলাফত মজলিসের নেতারা। ইসলামি দলগুলোর একাধিক নেতা বলছেন, ইসলামপন্থীদের ব্যাপারে বিএনপির ভূমিকা আগের চেয়ে বেশ উদাসীন বলে মনে হচ্ছে তাঁদের। নেতাদের ধারণা, দলটির বিদেশ-নির্ভরতা যত বাড়ছে, এ উদাসীনতা ততই বাড়ছে। অবশ্য এর পেছনে ইসলামের কট্টরপন্থী নিয়ে দেশে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গিও বিশেষভাবে প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করছেন নেতারা। তবে দলগুলোর নেতারা বলছেন, একটি বিশেষ পরিস্থিতি ও প্রয়োজনে জোট গঠন হয়েছিল। এখন জোটে কারও প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেলে বিএনপিকে তা স্পষ্ট করা উচিত।
তবে জানতে চাইলে ইসলামপন্থীদের ব্যাপারে বিএনপির উদাসীনতার অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এ ধরনের কথা কেউ বললে সেটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। আমরা জোট ভাঙার কোনো আশঙ্কা করছি না।’ আর দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় জোটের ভাঙনকে ‘গুজব’ মন্তব্য করে বলেন, ‘চেয়ারপারসনের সঙ্গে দীর্ঘ কথা হয়েছে। জোটে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে—এমন কোনো আভাস পাইনি।’
বিএনপির দুই নেতা এ কথা বললেও ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় পৌরসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপির সঙ্গে এ চারটি দলের ‘দূরত্ব’ তৈরি হয়েছে। এখন দলগুলোর এ ‘দূরত্ব’ স্থায়ী রাজনৈতিক রূপ নেয় কি না, তা নিয়ে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে জোটে। জামায়াত, খেলাফত মজলিস, জমিয়ত ও ইসলামী ঐক্যজোটের ৩৪ জন মেয়র ও ৮৬ জন কাউন্সিলর পদপ্রার্থী বিএনপির প্রার্থীদের সঙ্গে লড়ছেন। এর মধ্যে ২৭ জন মেয়র ও ৭২ জন কাউন্সিলর পদপ্রার্থী জামায়াতের। খেলাফত মজলিস টাঙ্গাইল, সিঙ্গাইর, কমলগঞ্জ, জকিগঞ্জ ও গোলাপগঞ্জ—এ পাঁচটি জায়গায় মেয়র পদে প্রার্থী দিয়েছে। পাঁচটিতেই বিএনপির প্রার্থী আছে। ঐক্যজোট বগুড়া সদরে ও বিভিন্ন স্থানে কাউন্সিলর পদে ১২ জন প্রার্থী দিয়েছে। জমিয়তও সিলেট অঞ্চলে কাউন্সিলর পদে আলাদা প্রার্থী দিয়েছে।
আলোচনা আছে, এ ক্ষোভ থেকেই গত শনিবার গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ২০ দলের মহাসচিব পর্যায়ের বৈঠকে জামায়াত ও ইসলামী ঐক্যজোটের কেউ যাননি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইসলামী ঐক্যজোটের সহকারী মহাসচিব আহলুল্লাহ ওয়াছেল বলেন, বিএনপি একজন প্রার্থী কি কাউকে জিজ্ঞেস করে দিয়েছে? এখন পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে এই, মিটিংয়ে উপস্থিত থাকলে ২০ দল। আর না থাকলে জোট ভেঙে গেছে।
অবশ্য খেলাফত মজলিস সেই বৈঠকে অংশ নিয়েছিল। তবে তারা প্রার্থিতা নিয়ে শরিকদের সঙ্গে সমন্বয় না করায় বিএনপির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। জানতে চাইলে মজলিসের মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রার্থী নিয়ে আমাদের সঙ্গে বিএনপির কোনো আলোচনা হয়নি। আমরা সমন্বয়ের জন্য নানাভাবে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। এখন এর প্রয়োজন আছে বলেও মনে করি না।’
অবশ্য বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেছেন, প্রার্থী নিয়ে তাঁদের কাছে শরিকদের কারও অভিযোগ নেই। তিনি বলেন, ‘সেদিন মহাসচিবদের বৈঠকে ইসলামী ঐক্যজোট আসতে পারেনি তাদের সম্মেলনের কারণে। আর জামায়াতের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগটা ঠিকমতো হয়নি।’
পৌর নির্বাচনে বিএনপির একক প্রার্থিতা নিয়ে ক্ষুব্ধ হলেও প্রকাশ্যে বক্তব্য নেই জামায়াতের। এর আগে সিটি করপোরেশন, উপজেলা ও বিগত পৌরসভা নির্বাচনের অভিজ্ঞতায় দলটির মূল্যায়ন হচ্ছে, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে স্থানীয়ভাবে সমঝোতা না হলে কেন্দ্রীয়ভাবে সমঝোতা করে কোনো লাভ হয় না। বিএনপিতে কেউ কারও কথা শোনে না, কেউ কারও দায়িত্বও নেয় না। সে জন্য তালিকা নিয়ে কারও কাছে ছোটাছুটি না করে নির্দিষ্ট কিছু পৌরসভায় মেয়র পদে স্বতন্ত্রভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেন জামায়াতের নীতিনির্ধারকেরা। তাঁরা মনে করেন, মাঠপর্যায়ে সংগঠন ধরে রাখতে এককভাবে নির্বাচন করাই ভালো।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘জামায়াত আমাদের কোনো তালিকা দেয়নি। তারা ৪৪টিতে মেয়র পদে প্রার্থী দিয়েছে, ৩৪টিতে টিকেছে। তারা হয়তো মনে করেছে, কেন্দ্রীয়ভাবে সমঝোতা না করে স্থানীয় পর্যায়ে প্রার্থী ঠিক করাই ভালো। তাই তারা বিষয়টি এড়িয়ে গেছে।’
কথা বলে জানা গেছে, ইসলামী ঐক্যজোট পৌর নির্বাচন নিয়ে বিএনপির সঙ্গে আর আলোচনায় আগ্রহী নয়। দলটির নেতারা ব্যস্ত ৭ জানুয়ারি রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে অনুষ্ঠেয় ত্রিবার্ষিক সম্মেলন নিয়ে। ওই সম্মেলনে বিএনপির আচরণে কিছু ক্ষোভের প্রকাশ হতে পারে বলে জানান একজন দায়িত্বশীল নেতা। তবে এর পরিণতি সম্পর্কে তিনি কোনো ধারণা দিতে পারেননি। শীর্ষ পর্যায়ের অন্য দুজন নেতা বলেছেন, সম্মেলনের আগে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে তাঁদের একটি প্রতিনিধিদল দেখা করে কিছু কথা বলবে।
এ প্রসঙ্গে ‘আপনাদের নিয়ে বিপদে আছি’—আবদুল লতিফ নেজামীকে উদ্দেশ করে বলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের একটি বক্তব্যের উল্লেখ করেন ইসলামী ঐক্যজোটের ভাইস চেয়ারম্যান আবুল হাসানাত আমিনী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কাউকে তো বেশি দিন বিপদে রাখা যায় না। গতকাল বুধবার বগুড়ায় দলীয় মেয়র প্রার্থীর পক্ষে গণসংযোগের সময় তিনি বলেন, বিকৃত রুচির কিছু মানুষের কারণেই বিএনপির আজ এই দুরবস্থা। তাদের মনে রাখা উচিত, এ দেশের ইসলামপন্থীরা কারও গোলাম নয়।
আর হাসানাতেরই ভগ্নিপতি ও দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সাখাওয়াত হোসাইন বলেন, এত বৈরিতার পর এত দিন জোট আছে কি করে?-প্রথম আলো
২৪ ডিসেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪ডটকম/জুবায়ের রাসেল