বিপ্লবী নেতা সিরাজ সিকদারের ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ
নিউজ ডেস্ক : আজ সিরাজ সিকদার ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী। ৪১ বছর আগের এই দিনে বন্দী অবস্থায় পুলিশ হেফাজতে গুলি করে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় বিপ্লবী শহীদ কমরেড সিরাজ সিকদার।
সশস্ত্র বলপ্রয়োগের মধ্য দিয়ে গরিব-মেহনতি মানুষের ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে গঠিত পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি।
একাত্তরের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষনার আগেই মুক্তিযুদ্ধের সূচনাকারী কমরেড সিরাজ সিকদার একদিকে পাকিস্তানের অধীনতার বিরুদ্ধে লড়েছেন, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের সুযোগে ভারতের সম্প্রসারণবাদী-আধিপত্যবাদী তৎপরতার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময়েই প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
১৯৭২ সালে সিরাজ সিকদার ঘোষণা করেন, “পূর্ব বাংলার জনগণ স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিয়েছে, ভারতের উপনিবেশ হওয়ার জন্য নয়। ”
এমতাবস্থায় ভারতীয় আধিপত্যে ক্রমবর্ধমান হয়ে পড়লে ৭৩ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় দিন ১৬ ডিসেম্বরকে ঢাকাসহ পূর্ব বাংলায় ভারতের উপনিবেশ কায়েম বিরোধী সম্প্রসারণবাদ প্রতিরোধ দিবস ঘোষণা করে হরতালের ডাক দেন সিরাজ সিকাদর। একই কর্মসূচি ৭৪ সালেও পালন করে পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি। সংবাদ মাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে ১৬ ডিসেম্বরের হরতাল কর্মসূচিকে সমর্থন জানান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী।
১৬ ডিসেম্বর হরতাল পালনের দুই সপ্তাহ পর সিরাজ সিকদারকে প্রথমে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে বন্দী অবস্থায় পুলিশ হেফাজতে গুলিতে নিহত হন তিনি। এ হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে হত্যার ধারা শুরু হয়। ২ জানুয়ারি তাকে হত্যার ২২ দিনের মাথায় পচাত্তরের ২৪ জানুয়ারি বাংলাদেশের সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এক দলীয় শাসন ব্যবস্থা বাকশাল কায়েম হয়।
একনজরে সিরাজ সিকদার
বিপ্লবী সিরাজ সিকদার ১৯৪৪ সালের ২৭ অক্টোবর শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জের লাকার্তা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
কৃষি বিভাগের কর্মকর্তা বাবার কাজের সূত্রে তার শৈশব কেটেছে বিভিন্ন অঞ্চলে। ১৯৫৯ সালে বরিশাল জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। বরিশালের ব্রজমোহন কলেজ থেকে ১৯৬১ সালে আইএসসি ও ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে ১৯৬৭ সালে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন।
ছাত্রাবস্থায় সিরাজ পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে জড়িত হন। ১৯৬৭ সালে ছাত্র ইউনিয়নের মেনন গ্রুপের কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
১৯৬৮ সালের ৮ জানুয়ারি তিনি সমমনা কয়েকজনকে নিয়ে ‘পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠনের লক্ষ্য ছিল বিদ্যমান কমিউনিস্ট পার্টির বিপরীতে সত্যিকারের বৈপ্লবিক কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা। মূল প্রত্যয় ছিল ‘জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের’ মাধ্যমে পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটানো। ওই বছরের শেষদিকে ঢাকায় মাও সে তুং গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৭০ সালে তার বিপ্লবী পরিষদ বিভিন্ন জেলায় পাকিস্তানী প্রশাসন ও শ্রেণী শত্রুর বিরুদ্ধে গেরিলা অপারেশন চালায়। ওই বছরের ৮ জানুয়ারি ঢাকা, মুন্সীগঞ্জ ও ময়মনসিংহ জেলায় স্বাধীন পূর্ব বাংলার পতাকা ওড়ান।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ। পাকিস্তান সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করতে থাকে। শেখ মুজিবুর রহমানকে আলোচনার ডাক দেয় জান্তা সরকার।
১৯৭১ সালের ২ মার্চ বিপ্লবী পরিষদ শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের উদ্দেশে একটি খোলা চিঠি লেখে, যা লিফলেট আকারে সারাদেশে প্রচার করা হয়। এর চার নম্বর দফাটি ছিল পূর্ব বাংলার দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক পার্টি ও ব্যক্তিদের প্রতিনিধি সমন্বয়ে ‘জাতীয় মুক্তি পরিষদ’ বা ‘জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট’ গঠন।
এ সময় দলটি কয়েকটা গেরিলা গ্রুপ করে কয়েকটি সরকারি অফিসে বোমাবাজি করে ও দেয়াল লিখনে বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। বিশেষ করে সিরাজ সিকদারের থিসিস আকৃষ্ট করেছিল ছাত্র-তরুণদের। থিসিস শুরুই করেছিলেন পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের উপনিবেশ হিসেবে চিহ্নিত করে।
১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিল সিরাজ সিকদার বরিশালের পেয়ারা বাগানে গড়ে তোলেন ‘জাতীয় মুক্তিবাহিনী’। ৩ জুন পার্টির নতুন নাম দেওয়া হয় ‘পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি’। আগস্টের শুরুতে সর্বহারা পার্টির অন্যতম কেন্দ্রীয় সদস্য এবং বর্তমান বাংলাদেশের পতাকার নকশাকার সাইফুল্লাহ আজমীসহ পাঁচজন যোদ্ধাকে সাভারে পাঠানো হয় মুজিববাহিনীর সঙ্গে বৈঠকের উদ্দেশ্যে। মুজিববাহিনী তাদের হত্যা করে।
অক্টোবরে সর্বহারা পার্টি দলের গেরিলাদের নির্দেশ দেওয়া হয় পাকস্তানী বাহিনী, ভারতীয় বাহিনী ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করতে। তিনি পাকিস্তানকে উপনিবেশবাদী, ভারতকে আধিপত্যবাদী এবং আওয়ামী লীগকে ভারতপন্থী আধিপত্যবাদী শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেন।
বরিশাল থেকে শুরু করে দেশের কয়েকটি উপকূলীয় অঞ্চল, ফরিদপুর, বিক্রমপুর, মানিকগঞ্জ, পাবনা, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন এলাকায় সর্বহারা পর্টির গেরিলারা পাক-বাহিনীর সঙ্গে বীরত্বপূর্ণ লড়াই করে। নভেম্বরের মধ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থক মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে সর্বহারা পার্টির বহু সদস্য নিহত হন।
১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মাওবাদী গ্রুপগুলোর মধ্যে রণনীতি নিয়ে বিভেদ দেখা দেয়। শিগগিরই শুরু হয়ে যায় পরস্পরকে বহিষ্কার ও মৃত্যুদণ্ডের ঘোষণা।
১৯৭৩ ও ৭৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের দিনে সর্বহারা পার্টি সারাদেশে হরতালের ডাক দেয়। পার্টির মুখপত্র ‘স্ফুলিঙ্গ’ ও প্রচারপত্রে বলা হয়, ১৬ ডিসেম্বর হচ্ছে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদী শক্তির কাছে মুজিব সরকারের আত্মসমর্পণ দিবস। একমাত্র জনযুদ্ধের মাধ্যমেই জনগণের বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠা করে প্রকৃত বিজয় আসতে পারে। মাওবাদীদের বিরুদ্ধে তৎকালীন সরকারের দমন-পীড়নের প্রতিবাদে সর্বহারা পার্টি ঢাকায় হরতাল আহ্বান করলে সন্তোষ থেকে মাওলানা ভাসানী বিবৃতি দিয়ে সমর্থন জানান এবং হরতাল সফল হয়। এরপর সিরাজ সিকদার আত্মগোপনে যান।
কিন্তু দু সপ্তাহের মধ্যে কমরেড সিরাজ সিকদারকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর ২ জানুয়ারি রাতে সাভারে বন্দী অবস্থায় গুলি করে হত্যা করা হয় তাকে। সরকারি ভাষ্য মতে, ১৯৭৫ সালের ২ জানুয়ারি পালাতে গিয়ে ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হন সিরাজ সিকদার।
এদিকে কমরেড সিরাজ সিকদারকে হত্যার ঘটনায় বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে গভীর মনোবেদনার সৃষ্টি হয়। এই হত্যার প্রতিবাদে শামিল না হওয়ার গ্লানি অনেকে আমৃত্যু যন্ত্রণাবিদ্ধ থেকেছেন।
মরহুম বুদ্ধিজীবী ড. আহমদ শরীফ বিপ্লবী বীর সিরাজ সিকদার প্রসঙ্গে শিরোনামে এক লেখায় বলেন, সিরাজ সিকদার আজ আর কোনো ব্যক্তির নাম নয়। সিরাজ সিকদার একটি সংকল্পের, একটি সংগ্রামের, একটি আদর্শের, একটি লক্ষ্যের ও একটি ইতিহাসের অধ্যায়ের নাম। এ মানবতাবাদী সাম্যবাদী নেতাকে হাতে পেয়ে যেদিন প্রচণ্ড প্রতাপ শঙ্কিত সরকার বিনা বিচারে খুন করল, সেদিন ভীতসন্ত্রস্ত আমরা তার জন্য প্রকাশ্যে আহা শব্দটি উচ্চারণ করতেও সাহস পাইনি। সেই গ্লানিবোধ এখনও কাঁটার মতো বুকে বিঁধে।
২ জানুয়ারি, ২০১৬/এমটি নিউজ২৪ডটকম/এসএম/ডিআরএ