ভূমিকম্পের পূর্ব প্রস্তুতি, কয়েকটা উপায় ও কৌশল
অধ্যাপক আবু এন. এম. ওয়াহিদ: গত দু’ তিন শ’ বছরের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, যে ভূখন্ড নিয়ে আজকের বাংলাদেশ রাষ্ট্র,
সেখানে এবং তার আশপাশ অঞ্চলে অর্থাৎ পশ্চিম বঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, নেপাল, ভুটান, মনিপুর,
মিয়ানমার, এবং বঙ্গপোসাগরে ছোট বড় অনেকগুলো ভূমিকম্প হয়েছে। তাতে জান মালের ক্ষয়
ক্ষতিও হয়েছে বিস্তর। সিস্মোলোজিস্টদের ধারণা, এ অঞ্চলে রিক্টার স্কেলে ৮/৯ মাত্রার আরেকটা
বড় ভূমিকম্প যে কোনো সময় হানা দিতে পারে, যার ধ্বংসলীলা থেকে বাংলাদেশ যে রেহাই পাবে
তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এ ব্যাপারে পত্র পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখিও হচ্ছে। ভূমিকম্পের
প্রস্তুতি স্বরূপ সরকার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজে হাত দিয়েছে, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, জনগণ এখনো
ভূমিকম্পের ব্যাপারে একেবারেই গাফেল, আর আল্লাহ্ না করুন, অঘটন যদি ঘটেই যায়, তাহলে
দুর্যোগ উত্তরণে পুরো দেশে প্রযুক্তিগত, প্রশিক্ষণগত, অর্থনৈতিক, ও সামাজিক প্রস্তুতি এখনো
সন্তোষজনক পর্যায়ের অনেক নিচে।
সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে ভূমিকম্প সচেতনতা বৃদ্ধির উপায় ও কৌশল নিয়ে আলাদা একটা লেখার
ইচ্ছে আছে। তবে এ নিবন্ধের বিষয়বস্তু বাংলাদেশে ভূমিকম্পের আগাম প্রস্তুতি। বড় মাপের
ভূমিকম্প একটা মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যা প্রতি বছর পৃথিবীর কোথাও না কোথাও আঘাত
হানছে এবং সর্বনাশী ধ্বংসলীলার চিহ্ন রেখে যাচ্ছে। এর মধ্যে পড়লে দুর্ভোগ থেকে রেহাই
পাওয়ার কোনো উপায় নেই, তবে সঠিক পূর্ব পরিকল্পনা এবং ভাল প্রস্তুতি থাকলে, জান মালের ক্ষয়
ক্ষতি ও জনদুর্ভোগ সহনীয় পর্যায়ে কমিয়ে রাখা সম্ভব।
ভূমিকম্পের পূর্ব প্রস্তুতি দু’ ধরণের। একটা প্রাতিষ্ঠানিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সরকারি প্রস্তুতি এবং
আরেকটা ব্যক্তি ও পারিবারিক পর্যায়ে সাধারণ জনগণের প্রস্তুতি। সরকারি প্রস্তুতির ব্যাপারে
আরেকটা পৃ ক প্রবন্ধ লেখা যেতে পারে। তবে এখানে থাকছে পারিবারিক পর্যায়ে সাধারণ
জনগণের প্রস্তুতির বয়ান। পৃথিবীর উনড়বত দেশ সমূহে সাধারণ জনগণ ভূমিকম্পের প্রস্তুতি নিয়ে
থাকে তিন স্তরে। প্র ম স্তরে থাকে ভূমিকম্প ঘটে যাওয়ার আগের করণীয়, দ্বিতীয় স্তরে থাকে
ভূমিকম্প চলাকালীন সময়ের সাবধানতা, এবং শেষ স্তরে থাকে ভূমিকম্পের পরে কী কী করতে হয়
তার ফিরিস্তি। আমার আজকের আলোচনা অবশ্য ভূমিকম্পের আগে কী কী করণীয় তার মধ্যেই
সীমাবদ্ধ থাকবে।
শুরুতে যে কথাটা বলে রাখা প্রয়োজন, তা হল বোধগম্য কারণে গ্রামাঞ্চলের তুলনায় শহরে ও
নগরে ভূমিকম্প জনিত ক্ষয় ক্ষতি এবং জনদুর্ভোগের পরিমাণ হয় অনেক বেশি। আর তাই, এখানে
যেসব উপায় পদ্ধতির আলোচনা করব, তা নাগরিক জীবনের জন্য যতটা প্রাসঙ্গিক, গ্রামীণ জীবনের
জন্য সঙ্গত কারণেই ততটা প্রযোজ্য হবে না।
প্রস্তুতির প্রাথমিক পর্যায়ে, পরিবারের সবাইকে জানিয়ে রাখা দরকার, ভূমিকম্প আঘাত হানলে
তাৎক্ষণিকভাবে কী কী করা উচিৎ। ভূমিকম্পের সময় যারা ঘরে থাকবে তারা কিভাবে ঘর থেকে
বেরোবে এবং যারা ঘরের বাইরে অথবা অন্য কোথাও আটকা পড়বে তাদের সাথে পরিবারের
অন্যান্য সদস্যদের কোথায় এবং কিভাবে যোগাযোগ হবে তার সুষ্ঠু পরিকল্পনা করে পরিবারের সব
সদস্যদের জানিয়ে রাখা প্রয়োজন। যে কোনো কারণে, সরাসরি নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে
না পারলে, নিজ শহরের ভেতরে এবং বাইরে এক বা একাধিক জায়গায় নির্দিষ্ট আত্মীয় স্বজন অথবা
বন্ধু বান্ধবের সাথে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সবার যোগাযোগ করা উচিত। এতে পরিবারের সব সদস্য
পরস্পরের অবস্থা এবং অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারবে। এ যোগাযোগ মানসিক ভারসাম্যের
জন্য প্রাথমিকভাবে খুবই দরকার।
নাগরিকদের ভেবে দেখতে হবে, তারা যে সব সিঙ্গল ইউনিট বাড়িঘরে, অথবা বহুতল ভবনের
ফ্ল্যাটে থাকেন, তাদের বাসস্থান উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পের জন্য কতটা নিরাপদ। দালানগুলো যদি নতুন
হয়, তাহলে সেগুলো ভূমিকম্প কোড মেনে তৈরি হয়েছি কিনা তার খোঁজ খবর নেওয়া উচিৎ। যদি
হয়ে থাকে, তো ভাল কথা। না হলে, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাড়ির মালিকদের সংশ্লিষ্ট
নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ও সরকারি সংস্থার সাথে যোগাযোগ করা প্রয়োজন। থাকার দালান কোঠা যদি
বেশি পুরনো হয়, তা হলে তা ভেঙ্গে ভূমিকম্প কোড মেনে নতুন ঘর বানাবার জন্য দেরি না করে,
দীর্ঘ অথবা মধ্য মেয়াদি পরিকল্পনা শুরু করে দেওয়া দরকার। পুরান ঢাকার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে
ঝুঁকিপূর্ণ বাড়ি ঘর ভেঙ্গে ভূমিকম্প কোড মেনে নতুন বাড়ি বানানোর জন্য সরকারের উচিৎ এখন
থেকেই একটা নীতিমালা তৈরি করে ব্যাপকভাবে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা।
বাড়ির ভেতর, বাহির, আশপাশ, এবং রাস্তাঘাট যতদূর সম্ভব পরিস্কার পরিচ্ছনড়ব ও জঞ্জালমুক্ত করে
রাখা উচিৎ, যাতে দুর্যোগ অবস্থায় মানুষ এবং যান বাহন চলাচল সহজতর হয়। ঘরে এবং কাজের
জায়গায় নিরাপদ আশ্রয়স্থল দেখে রাখা প্রয়োজন। ঘরে এবং কাজের জায়গা থেকে জরুরি অবস্থায়
দ্রুত নিরাপদে বেরোনোর পথ চিনে রাখা দরকার। ঘরের পানি, গ্যাস এবং বিদ্যুত লাইন বন্ধ করার
সুইচ কোথায় কোথায় আছে এবং কিভাবে সেগুলো অন অফ্ করতে হয়, তা পরিবারের সবার জেনে
রাখা উচিৎ। নিকটবর্তী থানা, ফায়ার স্টেশন, হাসপাতাল, অথবা ক্লিনিক চিনে রাখা নিতান্তই
প্রয়োজন।
ঘরের ভেতর জিনিসপত্র রাখার তাকগুলোকে দেয়ালের সাথে সেঁটে অথবা বেঁেধ রাখা প্রয়োজন।
ভারি জিনিস নিচের তাকে রাখা উচিৎ। কাঁচের বাসন কোসন নিরাপদ জায়গায় অথবা ক্যাবিনেটের
ভেতর বন্ধ করে রাখা দরকার। দেয়ালের ছবি বিছানা এবং বসার জায়গা থেকে নিরাপদ দূরত্বে
টাঙ্গিয়ে রাখা উচিৎ। ঘরের ছাদের লাইট এবং ফ্যান ফিক্সার নড়বড়ে হচ্ছে কিনা তা সময় সময়
পরখ করা দরকার। অবহেলা না করে ত্রুটিযুক্ত পানি, গ্যাস, এবং বিদ্যুতের লাইন যত তাড়াতাড়ি
সম্ভব মেরামত করে ফেলা দরকার। ঘরের ভিতে, মেঝে, ছাদে, অথবা দেয়ালে ফাটল থাকলে তা
সুষ্ঠুভাবে মেরামত করতে দেরি করা উচিৎ নয়। বাসার প্রতিটা কক্ষে, ভূমিকম্পের সময় আশ্রয়ের
জন্য, চৌকি, খাট, পালঙ্ক, অথবা মজবুত টেবিলের তলা পরিস্কার পরিচ্ছনড়ব থাকা উচিৎ। ঘরের
ভেতরে অথবা গ্যারাজে কোনো ধরণের দাহ্য পদার্থ থাকলে তাকে নিরাপদে রাখতে হবে যাতে
গড়িয়ে পড়ে এখান থেকে আগুন না লাগে।
জরুরি অবস্থার কারণে যদি ঘর থেকে বেরোনো না যায়, তাহলে পারিপার্শিক অবস্থা জানা, বোঝা,
এবং করণীয় ঠিক করতে সরকারি নির্দেশাবলী শোনার জন্য বাড়তি ব্যাটারি সহ একটা ব্যাটারি
চালিত ট্রেন্জিস্টার ঘরে রাখা দরকার। ঘরে আটকা পড়লে অন্তত কয়েক দিনের খাদ্য, পানীয়,
অষুধ সহ অতি প্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের একটা জরুরি বাক্স তৈরি করে পরিবারের সবাইকে
জানিয়ে ঘরের মধ্যে কোনো নিরাপদ জায়গায় রাখা উচিৎ। এ জরুরি বাক্সে থাকবে নি¤ড়বলিখিত
দ্রব্যাদি। এক বাক্স ডিসপোজেবল ভেজা টাওয়েল, তুলো, ব্যান্ড এইড, এন্টি স্যাফটিক ফ্লুইড,
ব্যান্ডেজের জন্য গজ কাপড়, নিত্য ব্যবহারের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ অষুধ, জনপ্রতি ৫ গ্যালন করে
বোতলের পানি (কিছুদিন অন্তর অন্তর পুরনো পানি ব্যবহার করে নতুন পানির বোতল এনে রাখা
উচিৎ), পানি বিশুদ্ধকরণ বড়ি, পাউডার দুধ, পর্যাপ্ত পরিমাণ চিড়া, মুড়ি, বিস্কুট জাতীয় শুকনো
খাবার, বাড়তি ব্যাটারি সহ টর্চ লাইট, নগদ ২৫ হাজার টাকা, দিয়াশলাই, মোমবাতি, ফেস মাস্ক,
ভারি গ্লাভ্স, সান গ্লাস, হাতুড়ি, পাইপ রেঞ্চ, প্লার্য়াস, সুঁই, সুতো, ছুরি, কাঁচি, আগুন নেভাবার
যন্ত্র, ধ্বংসস্তুপের নিচে আটকা পড়লে, উদ্ধার কর্মীদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য হুইসেল, ইত্যাদি। ঘর
থেকে বেরোতে পারলেও, রাস্তায় যে গাড়ি ঘোড়া চলবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই, দীর্ঘ পথ
হাঁটার নিমিত্তে প্রত্যেকের জন্য আরামদায়ক জুতো থাকা বাঞ্ছনীয়। এ ছাড়া সব সময় প্রতিবেশীদের
সাথে ভাল সম্পর্ক এবং ভাল যোগাযোগ রাখা দরকার যাতে বিপদের সময় একে অপরকে সাহায্য
করতে পারে।
এসব প্রস্তুতির কথা সরকারি এবং বেসরকারি রেডিও ও টিভি চ্যানেল, জাতীয় পত্রিকা, স্কুল কলেজ,
মসজিদ, মাদ্রাসা, মন্দির, গীর্জা, পেশাজীবি সংগঠন সমূহের সভা সমাবেশ, গণজমায়েত ও
রাজনৈতিক সমাবেশের মাধ্যমে দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া উচিৎ। এ প্রসঙ্গে সবারই একটা কথা
মনে রাখা উচিৎ, এ প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে একটি জীবনও যদি রক্ষা পায়, তাইবা কম কী ?
আল্লাহ্ তা’লা পবিত্র কোরান শরিফে বলেননি? “.. যে ব্যক্তি একটা জীবন বাঁচাল, সে যেন সমস্ত
মানব জাতিকেই বাঁচাল...”।
লেখক: টেনেসী স্টেইট ইউনিভার্সিটি
৫ জানুয়ারি, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/প্রতিনিধি/এইচএস/কেএস