বৃহস্পতিবার, ০৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২১, ১০:২২:৩০

‘অটোপাস’ বলে সন্তানদের তিরস্কার করা উচিত নয়

‘অটোপাস’ বলে সন্তানদের তিরস্কার করা উচিত নয়

মো. রহমত উল্লাহ্: সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা ২০২০ এর ফল। উত্তীর্ণ হয়েছে সবাই। জিপিএ ৫ পেয়েছে ১ লাখ ৬১ হাজার ৮০৭ জন; যা গত বছরের তুলনায় প্রায় তিন গুণ। আনন্দের বন্যা বয়ে যাওয়ার কথা এমন ফলাফলে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি!

 তোমাদের মনে রাখতে হবে, জীবন অনেক দীর্ঘ। জীবনে সফলতার পথ অবারিত। তোমাদের মেধা ও যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখার ক্ষেত্র অগণিত। মানুষের পুরো জীবনটাই পরীক্ষাক্ষেত্র। একটি পরীক্ষা দিতে পারোনি বলে হতাশ হলে চলবে না। 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটা পোস্ট দিয়েছে আমার ছোট ভাই। তার ছেলে এবার এইচএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়েছে। উৎসাহ-উদ্দীপনার চেয়ে উপহাস বা গুরুত্বহীনতাই অধিক লক্ষণীয় ছিল ঐ পোস্টের বিভিন্ন মন্তব্যে! শেষে দেখা গেল শুধু আমিই লিখলাম, 'জেএসসি ও এসএসসিতে ভালো ফলাফল করেছিল বলে সাজিদকে অনেক অনেক ধন্যবাদ এবং বর্তমান ফলাফলের জন্য অভিনন্দন।' অথচ, মন্তব্যকারীরা সবাই লেখাপড়া জানা মানুষ।

বাজারে গিয়ে কথা হয় দোকানির সাথে। খুব উৎসাহ নিয়ে হাসি মুখে তিনি বলেন- "স্যার, আমার মেয়ে আইএ পাস করছে, ভালা রিজাল করছে। খুব ভালা জিপি পাইছে। তারে আমি কইছি, আরও ভালা কইরা পড়, যাতে ভালা চান্স পাছ। আপনি তার লাইগা দোয়া কইরেন।" দোকানি কিন্তু লেখাপড়া জানেন না!

এ দুটি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমার বারবার মনে হচ্ছে, এক্ষেত্রে লেখাপড়া জানা মানুষের চেয়ে লেখাপড়া না জানা মানুষটাই অধিক শিক্ষিত। যিনি এত কিছু জানেন না, বুঝেন না, তিনি খুশি হয়েছেন। তার মেয়ে ভাল ফলাফল করেছে, এটাই তার আনন্দ! উচ্চশিক্ষার জন্য ভালো সুযোগ পাক এটাই তার চেষ্টা ও প্রত্যাশা। তার এই আনন্দের, এই উৎসাহের, এই প্রচেষ্টার, এই প্রত্যাশার প্রতিফলন অবশ্যই পড়বে মেয়ের উপর। মেয়েও হবে আনন্দিত, হবে উৎসাহিত, হবে সচেষ্ট। এগিয়ে যাওয়ার জন্য এই উৎসাহ অনেক বেশি প্রয়োজন।

অথচ আমরা যারা লেখাপড়া জানা মানুষ তারাই অনেক রকম সমালোচনা করছি এই ফলাফল নিয়ে। উপহাস করছি, তিরস্কার করছি, কটাক্ষ করছি, টিপ্পনী কাটছি, নানান রকম কথা বলছি আমাদের সন্তানদের। এমনকি অনেক শিক্ষকও প্রকাশ করছেন এমন মনোভাব! অটো পাস, করোনা পাস, পরীক্ষা ছাড়া পাস, মূল্যহীন পাস ইত্যাদি বলে বলে আমরা বারবার লজ্জিত করছি তাদের। এরই মধ্যে আবার কেউ জিপিএ কম পেয়েছে বলে তাকে করছি আরও বেশি তিরস্কার! এভাবেই আমরা ভেঙ্গে দিচ্ছি তাদের মন, চুপসে দিচ্ছি তাদের মনের বল। যা মোটেও কাম্য নয়।

পরীক্ষা হয়নি এ দায় কি শিক্ষার্থীর? শিক্ষার্থীরা তো প্রস্তুত ছিল পরীক্ষা দিয়ে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার জন্য। মহামারি করোনা পরিস্থিতির কারণে তাদের পরীক্ষা হয়নি। এখানে তাদের অপরাধ কোথায়, অক্ষমতা কোথায়, অযোগ্যতা কোথায়? জীবনে একটা পরীক্ষা দিতে পারেনি বলে কি তারা অযোগ্য হয়ে গেছে, অথর্ব হয়ে গেছে, ফেলনা হয়ে গেছে?

আমরা যেটিকে অটো পাস, করুণা পাস, পরীক্ষা বিহীন পাস, ইত্যাদি বলে পরিহাস করছি; সে পাস কি আমাদের সন্তানরা এমনি এমনি করতে পেরেছে? কারোর দয়ায় বা অনুগ্রহে কি তারা অর্জন করেছে এই সুফল? কোনই কি ভিত্তি নেই তাদের এই ফলাফলের? একই রকম ফলাফল কি অর্জন করেছে সবাই? একেবারেই কি করা হয়নি তাদের যোগ্যতার পরিমাপ?

আমাদের যে সন্তান জেএসসি বা সমমান পাস করেছে, এসএসসি বা সমমান পাস করেছে এবং এইচএসসির কোর্স সম্পন্ন করে পরীক্ষার্থী হয়েছে, কেবল সে-ই অর্জন করছে এইচএসসি বা সমমান। যারা জেএসসি ও এসএসসি পর্যায়ে ভালো করেছিল এখানেও ভালো করেছে তারা। অর্থাৎ পূর্ব যোগ্যতার ভিত্তিতেই তারা লাভ করছে এইচএসসি বা সমমান। অর্জন করছে যোগ্যতা অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন গ্রেড।

সবার রেজাল্ট এক নয়। এটি মোটেও অটো পাস নয়। বড়জোর বলা যেতে পারে, পূর্ব যোগ্যতায় পাস। কারো দয়ায় কোনভাবে শুধু পাস করিয়ে দেওয়া হয়নি তাদের। বরং নিজেদের যোগ্যতায়ই তারা পাস করেছে, বিভিন্ন মান বা গ্রেড অর্জন করেছে। এটি হচ্ছে, তাদের অর্জিত শিক্ষার ধারাবাহিক মূল্যায়নের ফলাফল। Continuous Assessment Result (CAR)

এমতাবস্থায় ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে তর্ক-বিতর্ক করে, এটা সেটা বলে, আমরা যদি সন্তানদের এমন বুঝিয়ে দিই যে, সঠিক নয় তোমাদের এইচএসসি পাস। তোমাদের যোগ্যতার ফসল নয় এটি। এইরূপ ফল লাভের যোগ্য নও তোমরা। তাহলে তারা হারিয়ে ফেলবে মনের জোর, হারিয়ে ফেলবে এগিয়ে যাওয়ার সাহস, হারিয়ে ফেলবে কর্মোদ্যম ও সফল হবার উদ্দীপনা। উচ্চশিক্ষায় বা কর্মে যাবার আগেই ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে অনেকের লালিত স্বপ্ন, থেমে যাবে যৌবনের জয়গান! ঊর্ধ্বমুখী জীবনের মাঝপথে হেরে যাবে তারা, সেইসাথে হেরে যাবো আমরাও।

আসুন আমরা উৎসাহিত করি, উজ্জীবিত করি আমাদের সন্তানদের। সবাই মিলে বলি- 'তোমাদের আস্থা রাখতে হবে নিজের উপর। নিজেকে নিজে খাটো ভাবা, অযোগ্য ভাবা উচিত নয়। মানুষ সর্বদাই তার উত্তম চিন্তা, চেতনা, চেষ্টা ও কাজের দ্বারা উত্তম। পরীক্ষা দিতে না পারার দায় তোমাদের নয়। তোমরা পরিস্থিতির শিকার। ভালো করার জন্য তোমাদের প্রস্তুতি ছিল, ইচ্ছা ছিল, চেষ্টা ছিল এবং নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দেওয়ার সৎসাহস ছিল; এখানেই তোমরা উত্তম। আগের পরীক্ষায় তোমরা উত্তীর্ণ হয়েছিলে বলেই এই পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হয়েছো; এখানেও তোমরা উত্তম।

মোটেও অটো পাস করোনি তোমরা। কেননা, এমনি এমনিই পাস করানো হয়নি তোমাদের। মুক্ত হস্তে দান করা হয়নি তোমাদের এই সুফল। কারো দয়া বা অনুগ্রহের ফসল নয় এটি। তোমাদের পূর্ববর্তী শিক্ষার মূল্যায়নের ভিত্তিতেই তোমরা অর্জন করেছ এই গ্রেড। মোটেও ভিত্তিহীন নয় তোমাদের সনদ। তোমাদের প্রস্তুতি ছিল, অধিকার ছিল, পরীক্ষা দিয়ে নিজেদের বাড়তি যোগ্যতা প্রমাণ করার। কিন্তু করোনা মহামারির হাত থেকে জীবন রক্ষার স্বার্থে তোমাদের পরীক্ষা নেওয়া হয়নি। এই ব্যর্থতার দায় মোটেও তোমাদের নয়। বরং মহান সৃষ্টিকর্তার অশেষ দয়ায় ২০২০ সালে তোমরা বেঁচে আছো এটিই সফলতা।

তোমাদের মনে রাখতে হবে, জীবন অনেক দীর্ঘ। জীবনে সফলতার পথ অবারিত। তোমাদের মেধা ও যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখার ক্ষেত্র অগণিত। মানুষের পুরো জীবনটাই পরীক্ষাক্ষেত্র। একটি পরীক্ষা দিতে পারোনি বলে হতাশ হলে চলবে না। তোমাদের যদি ঐকান্তিক ইচ্ছা থাকে, আন্তরিক প্রচেষ্টা থাকে, সঠিক পথে এগিয়ে যাওয়ার দিশা থাকে; তো অবশ্যই তোমরা সফল হবে জীবনের বিভিন্ন পরীক্ষায়। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, বিজয়ী হতে হবে মানুষ হবার পরীক্ষায়। সেখানে রাখতে হবে মেধার স্বাক্ষর, যোগ্যতার প্রমাণ, হতে হবে উত্তম।'

এখন ফলাফল যাই হোক, আমাদের এই রূপ উৎসাহে, উদ্দীপনায় যখন তারা উজ্জীবিত হবে, ভালো করার জন্য প্রতিজ্ঞ হবে, সর্বশক্তি দিয়ে সচেষ্ট হবে, সৎকর্মে নিবেদিত হবে, মানুষ হবার পরীক্ষায় বিজয়ী হবে; তখনই অর্জিত হবে চূড়ান্ত সফলতা।

লেখক : শিশু-সাহিত্যিক এবং অধ্যক্ষ- কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।
[email protected]

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে