মাহবুব হাসান ও হাবিবুর রহমান খান : আগামী ২৮ মার্চ আওয়ামী লীগের ২০তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। শনিবার গণভবনে অনুষ্ঠিত দলটির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়। শাসক দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সর্বোচ্চ ফোরাম কার্যনির্বাহী সংসদ সম্মেলনের তারিখ নির্ধারণ করেছে। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সম্মেলনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটি চূড়ান্ত হবে। বর্তমান কমিটি থেকে বাদ পড়বেন অনেক নেতা। আসবে নতুন মুখ। বাদ পড়া ঠেকাতে এবং নতুন অন্তর্ভুক্তির জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে চলছে লবিং-তদবির। এসব নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন নেতারা। এদিকে সম্মেলন সফল করতে উপকমিটি গঠন করা হয়েছে। শীর্ষ নেতারা আশা করছেন সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব পাবে আওয়ামী লীগ। যারা দলকে সঠিক নেতৃত্ব দিয়ে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।
আওয়ামী লীগের সর্বশেষ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় ২০১২ সালের ২৯ ডিসেম্বর। নিয়ম অনুযায়ী গত বছর ২৯ ডিসেম্বর ওই কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে। গতকাল অনুষ্ঠিত বৈঠকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত এ কমিটির মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে। এছাড়াও বৈঠকে সম্মেলন প্রস্তুত কমিটি গঠন নিয়ে আলোচনা হয়।
ডিসেম্বরে দেশব্যাপী ২৩৪ পৌরসভায় নির্বাচনের কারণে সম্মেলন পিছিয়েছে। পৌর নির্বাচনের পরদিন ৩১ ডিসেম্বর রাতে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা সভানেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি সম্মেলন আয়োজনের ওপর জোর দেন।
সূত্র জানায়, শেখ হাসিনা মনে করেন, দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোতে গণতন্ত্র থাকা অপরিহার্য। আর তার পূর্বশর্ত হল ধারাবাহিকভাবে যথাসময়ে সম্মেলন হওয়া। এজন্যই তিনি গতকালের বৈঠকে সম্মেলনকে এজেন্ডা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশ দেন।
বৈঠকে উপস্থিত এক নেতা জানান, ২৮ মার্চ সম্মেলনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। দেশের সার্বিক রাজনৈতিক অবস্থা এবং বিভিন্ন ইস্যুকে মাথায় রেখে আলোচনা হয়। অবশ্য এর আগে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামসহ একাধিক শীর্ষস্থানীয় নেতা বিভিন্ন বক্তব্যে যথা সময়েই সম্মেলন হবে বলে উল্লেখ করেছিলেন।
দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনাও একাধিক বৈঠকে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেন। জেলা সম্মেলন শেষ করার জন্য সাংগঠনিক সম্পাদকদের বারবার তাগাদা দেয়া হয়। সে অনুযায়ী প্রস্তুতি চলছিল। পুরো ২০১৫ সালেই জেলা সম্মেলন নিয়ে ব্যস্ত ছিল আওয়ামী লীগ।
জানা গেছে, ৭৩টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে ৬৫টি জেলার সম্মেলনও শেষ করে আনে দলটি। আর নিয়ম অনুযায়ী জেলার মর্যাদাসম্পন্ন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয় কেন্দ্রীয় সম্মেলনের আগের দিন। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ শনিবার বলেন, বাকি জেলাগুলোর সম্মেলনও কেন্দ্রীয় সম্মেলন সম্পন্নের আগেই শেষ হয়ে যাবে।
সূত্র জানায়, বৈঠকে সম্মেলনের তারিখ নির্ধারণের আলোচনায় সম্মেলন না হওয়া জেলাগুলোর কথাও উঠে আসে। সিদ্ধান্ত হয়, যে ক’টি জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডের সম্মেলন হয়নি সেগুলোর সম্মেলন সম্পন্নের উদ্যোগ নেয়া হবে। দলটির নেতারা মনে করছেন, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সম্মেলনের মাধ্যমে আরও গতিশীল হবে আওয়ামী লীগ।
মার্চে কাউন্সিলের লক্ষ্যে এগোচ্ছে বিএনপি
আপাতত আন্দোলন নয়, দল পুনর্গঠনের দিকেই নজর দিচ্ছে বিএনপি। এর অংশ হিসেবে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে তৃণমূল পুনর্গঠনের কাজ শেষ করা হবে। মার্চের প্রথম সপ্তাহে ৬ষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলের টার্গেট নিয়ে কাজ গুছিয়ে আনছে দলটি। এর পরপরই জাতীয় স্থায়ী, নির্বাহী ও উপদেষ্টা পরিষদের নতুন কমিটি গঠন করা হবে। কাউন্সিলের দিনক্ষণ নির্ধারণ এবং তৃণমূল পুনর্গঠনের সবশেষ অবস্থা জানতে শিগগিরই সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
পৌরসভা নির্বাচন শেষে আবার পুরোদমে শুরু হচ্ছে তৃণমূল পুনর্গঠনের কাজ। দল পুনর্গঠন ও কাউন্সিলকে সামনে রেখে নেতাকর্মীদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে চাঙ্গাভাব। গুরুত্বপূর্ণ পদ পেতে অনেকে শুরু করেছেন লবিং ও তদবির। আবার অনেকেই বর্তমান পদ ধরে রাখতে নানা প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। ফের সক্রিয়দের পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে নিষ্ক্রিয় নেতারাও পদের আশায় লবিং-তদবির শুরু করেছেন। বিএনপির নীতিনির্ধারণী সূত্রে এসব জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, দ্রুত জাতীয় কাউন্সিল করার লক্ষ্যে প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, তৃণমূলের মতামতের ওপর ভিত্তি করেই নেতৃত্ব নির্বাচন করা হবে। যারা যোগ্য, ত্যাগী তাদেরই জায়গা দেয়া হবে। দল পুনর্গঠন একটি চলমান প্রক্রিয়া হলেও এই মুহূর্তে পুনর্গঠনকে অধিক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
মির্জা ফখরুল বলেন, জাতীয় কাউন্সিল করার জন্য এর আগে উদ্যোগ নেয়া হলেও সরকারের বাধার কারণে তা সম্ভব হয়নি। কাউন্সিলের প্রস্তুতির সব কাগজপত্র নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে পুলিশ নিয়ে যায় বলে তিনি উল্লেখ করেন।
২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চরম ভরাডুবির পর দল পুনর্গঠন করেছিল বিএনপি। ২০০৯ সালের জুন মাসে একসঙ্গে ৭২টি সাংগঠনিক জেলা কমিটি ভেঙে দিয়ে আহ্বায়ক কমিটি করা হয়। ওই বছর ৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিল। পরের বছর জানুয়ারিতে গঠন করা হয় ৩৮৬ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় নির্বাহী কমিটি।
তিন বছরের কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে তিন বছর আগে। ২০১২ সালের মার্চ মাসে জাতীয় কাউন্সিল করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। এ লক্ষ্যে তখন প্রাথমিক কাজও শুরু হয়েছিল। কিন্তু ওই সময় পুলিশ নয়াপল্টনের দলীয় কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে ৫৪ নেতাকে আটক করে। দলটির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, অভিযানের সময় পুলিশ কাউন্সিলের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে গেছে।
সূত্র জানায়, এবারের কাউন্সিলে ভারমুক্ত হচ্ছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তাকে পূর্ণাঙ্গ মহাসচিব করার বিষয়ে নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কাউন্সিলের পরপরই জাতীয় স্থায়ী, নির্বাহী ও উপদেষ্টা পরিষদের নতুন কমিটি গঠন করা হবে। ১৯ সদস্যের স্থায়ী কমিটির মধ্যে দু’জন মারা গেছেন। তিনজনের শারীরিক অবস্থা গুরুতর। এ ধরনের অসুস্থ ও বয়সের কারণে নিষ্ক্রিয় কয়েকজনকে স্থায়ী কমিটি থেকে বাদ দেয়া হবে। এদের জায়গায় আসবে নতুন মুখ।
এবার নির্বাহী কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে তরুণ ও নতুনদের প্রাধান্য দেয়া হবে। ৫ম কাউন্সিলের পর ৩৮৬ সদস্যের জাতীয় নির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ ওঠে। এমন অনেককে নেতা বানানো হয়, যারা এর আগে কখনও বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। বিগত আন্দোলনে নির্বাহী কমিটির ৮৬ জন সদস্যকেও রাজপথে দেখা যায়নি। এবার পুরনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা হবে।
গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে কাউন্সিলরের মাধ্যমে তৃণমূলের সব কমিটি পুনর্গঠনের জন্য গত ৯ আগস্ট কেন্দ্র থেকে চিঠি পাঠানো হয়। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অর্ধেক কাজও শেষ হয়নি। পরে আরও কয়েক দফা সময় বাড়িয়েও তৃণমূল পুনর্গঠন শেষ করা সম্ভব হয়নি। অনেক জেলায় কাজই শুরু করেনি।
পুনর্গঠনের মাঝামাঝিতে পৌরসভা নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। ফলে অলিখিতভাবেই বন্ধ ছিল পুনর্গঠনের কাজ। এখন পর্যন্ত রাঙ্গামাটি, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, নেত্রকোনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও সৈয়দপুরসহ আরও কয়েকটি সাংগঠনিক জেলার কাউন্সিল শেষ হয়েছে। এ মাসের মধ্যে আরও ২০-২৫টি জেলা সম্মেলন শেষ করার টার্গেট নেয়া হয়েছে। মধ্য ফেব্রুয়ারি তৃণমূল পুনর্গঠন শেষ করা হবে।
তবে বারবার নির্দেশ দেয়ার পরও যেসব জেলা কাজই শুরু করেনি সেগুলোর কমিটি ভেঙে দিয়ে কেন্দ্র থেকে আহ্বায়ক কমিটি করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ২৩টি জেলার আহ্বায়ক বা সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি কেন্দ্র থেকে চূড়ান্ত করার কাজ চলছে। পৌরসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যেসব বিভাগীয় কমিটি গঠন করা হয়েছিল, সেগুলোর কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। তৃণমূলের সাংগঠনিক চিত্র তুলে আনতে এসব টিমকে শিগগিরই জেলা সফরে পাঠানো হবে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, এই মুহূর্তে দল গোছানোর দিকেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে দলের কাউন্সিল হচ্ছে না। দ্রুত সময়ে জাতীয় কাউন্সিল করার বিষয়ে আলোচনা চলছে। দলের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আলোচনা করে চেয়ারপারসন দ্রুতই এই ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।
তিনি বলেন, যারা নিষ্ক্রিয় ছিলেন তাদের বাদ দিয়ে ত্যাগীদের মূল্যায়ন করা হবে। বিশেষ করে আগামীতে তরুণদের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব দেয়ার চিন্তাভাবনা চলছে।
জানতে চাইলে পুনর্গঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিএনপি যুগ্ম মহাসচিব মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, এই মুহূর্তে আমাদের প্রধান লক্ষ্য দল গোছানো। পৌরসভা নির্বাচনে অংশ নেয়ার পর দলের সাংগঠনিক অনেক বিষয় আমরা জানতে পেরেছি। সেগুলোকে চিহ্নিত করে নতুনভাবে কাজ শুরু করা হবে।
তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য সংগঠনের কোনো বিকল্প নেই। পুনর্গঠনের কাজ শেষ হওয়ার পর দলের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আলোচনা করে কাউন্সিলের ব্যাপারে চেয়ারপারসন সিদ্ধান্ত নেবেন। - যুগান্তর
১০ জানুয়ারি,২০১৬/এমটিনিউজ/এসএস/এসবি