কাফি কামাল : কাউন্সিলের মাধ্যমে সাংগঠনিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে চায় বিএনপি। তারই প্রস্তুতি হিসেবে পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে দলটি। সামপ্রতিক বছরগুলোতে কয়েক দফায় উদ্যোগ নিয়েও তারা প্রতিকূল পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে কাউন্সিল আয়োজন করতে পারেনি।
তবে দলের নীতিনির্ধারক ফোরামসহ কেন্দ্রীয় নেতারা জানান, শীর্ষ নেতৃত্বের চিন্তা-ভাবনায় রয়েছে কাউন্সিল আয়োজনের বিষয়টি। কিছু কিছু বিষয়ে প্রস্তুতিও রয়েছে দলটির। এখন সরকারি দল আওয়ামী লীগ কাউন্সিল আয়োজনের ঘোষণা দেয়ায় একটি অনুকূল পরিবেশের প্রত্যাশা করছেন দলটির নেতারা।
গত দুইদিনে কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে এ নিয়ে ব্যক্তিগত পর্যায়ে আলোচনাও শুরু হয়েছে। তারা জানান, শিগগিরই এ ব্যাপারে দলের সিনিয়র নেতা ও নীতিনির্ধারক ফোরামের সঙ্গে মতবিনিময় করতে পারেন চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ফেব্রুয়ারির শেষ থেকে মার্চের প্রথম সপ্তাহ বা আগামী এপ্রিলে অনুষ্ঠিতব্য ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের পর একটি উৎসবমুখর কাউন্সিল আয়োজনের ঘোষণা আসতে পারে।
অন্যথায় তৃণমূল ও জেলা কমিটির চলমান পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শেষে সুবিধাজনক সময়ে সীমিত পরিসরে করা হবে কাউন্সিল আয়োজন। তবে শীর্ষ নেতৃত্বে এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা না হওয়ায় দিন-তারিখ নির্দিষ্ট কিছু বলতে পারছেন না নেতারা।
কাউন্সিলের ব্যাপারে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আসম হান্নান শাহ বলেন, বিএনপি কাউন্সিল আয়োজন করতে চায় কিন্তু সরকার প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে বারবার সেটাকে বাধাগ্রস্ত করে। এখন বিএনপি একটি সাংগঠনিক পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। সেটা সম্পন্ন করা ছাড়াও সামনে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন রয়েছে। এসব বিষয় বিচার-বিবেচনা করেই কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত নেবে বিএনপি। তবে সেটা সম্ভবত মার্চ-এপ্রিলের আগে সম্ভব হবে না।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, বিএনপি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে নিয়মিত কাউন্সিল আয়োজনের মাধ্যমে দলের সাংগঠনিক পুনর্গঠনে বিশ্বাসী। কাউন্সিল আয়োজনের বিষয়টি আমাদের চিন্তা-ভাবনার মধ্যে রয়েছে। আশাকরি শিগগিরই এ বিষয়ে দলের চেয়ারপারসন আলাপ-আলোচনা শুরু করবেন।
তিনি বলেন, সামপ্রতিক বছরগুলোতে একাধিকবার প্রস্তুতি শুরু করেও প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে আমরা কাউন্সিল আয়োজন করতে পারিনি। গত বছর কাউন্সিলের জন্য ৫ লাখ পোস্টার ছাপানো হয়েছিল। এছাড়া কাউন্সিলের জন্য বিভিন্ন স্যুভেনিরসহ অনেক প্রয়োজনীয় জিনিস তৈরি রয়েছে। সেগুলো গোডাউনে নষ্ট হচ্ছে। তিনি বলেন, বিএনপির কাউন্সিল আয়োজনে যে বিষয়টির অভাব তা হলো প্রয়োজনীয় পরিবেশ। সেটা পেলে দ্রুতই কাউন্সিল হবে।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, বিএনপি এখন একটি সাংগঠনিক পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। দলের কাউন্সিল আয়োজনের বিষয়টি বিবেচনায় রেখেই এ পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। যার চূড়ান্ত পরিণতি হতো কাউন্সিল। পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় অবশিষ্ট জেলাগুলোর কমিটি গঠন দ্রুত ও সুচারুভাবে সম্পন্ন করাই এখন আমাদের মূল লক্ষ্য। তবে দলের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায় কোথাও কাউন্সিল আয়োজনের ব্যাপারে দ্বিমত নেই। কিন্তু বিএনপির মতো বড় রাজনৈতিক দলের একটি উৎসবমুখর কাউন্সিল আয়োজনের জন্য যে পরিবেশ দরকার তা পাওয়া যায়নি।
তিনি বলেন, সরকারি দল যে কোনো সময়ে কাউন্সিল আয়োজনের উদ্যোগ নিতে পারে। কারণ সবকিছুই তাদের অনুকূলে থাকে। অন্যদিকে বিরোধী রাজনৈতিক দলের জন্য প্রতিকূল পরিবেশ-পরিস্থিতিতে এ উদ্যোগ নেয়া বেশ কঠিন। আমরা জানি না একটি উৎসবমুখর কাউন্সিল আয়োজনের পরিবেশ পাবো কিনা। এখনও সে ধরনের কোনো লক্ষণ দেখছি না। হয়তো প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেই আমাদের কাউন্সিলের কাজ করতে হবে। ফলে দিন-তারিখ ঠিক করে এখনই কাউন্সিলের কথা বলা মুশকিল। তবে এ বিষয়ে নিশ্চয় শীর্ষ নেতৃত্ব শিগগিরই আলাপ করবেন।
বিএনপির সর্বশেষ পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় ২০০৯ সালে ৮ই ডিসেম্বর। দীর্ঘ ১৬ বছর পর আয়োজিত সে কাউন্সিল ছিল বেশ জাঁকজমকপূর্ণ। এরপর ২০১০ সালের ৩১শে জুলাই ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স মিলনায়তনে, ২০১১ সালের ২৩শে এপ্রিল মহানগর নাট্যমঞ্চ ও ২০১২ সালের ৮ই এপ্রিল ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স মিলনায়তনে দলটির জাতীয় নির্বাহী কমিটির তিনটি সভা হয়।
নির্বাচন কমিশনের বিধি অনুযায়ী তিন বছর পর পর দলের কাউন্সিল করার কথা থাকলেও প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে দীর্ঘ ৬ বছরেও ৬ষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল করতে পারেনি দলটি। এর মধ্যে ২০১৩ সালের ২৭শে জানুয়ারি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সভাপতিত্বে স্থায়ী কমিটির সভায় ওই বছরের মার্চে জাতীয় কাউন্সিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিএনপি। প্রস্তুতির জন্য কিছু সাব কমিটিও গঠন করা হয়েছিল।
কিন্তু ২০১৩ সালের ১২ই মার্চ ১৮ দলীয় জোটের পূর্বঘোষিত বিক্ষোভ-সমাবেশে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিএনপির নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অভিযান চালায় পুলিশ। কার্যালয় থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের গ্রেপ্তার করা হলে সে প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়।
এদিকে ২০১৫ সালের টানা আন্দোলন থেকে সরে আসার পর বছরের মাঝামাঝি সময়ে কাউন্সিল আয়োজনের মাধ্যমে সাংগঠনিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর আগস্টে জেলা ও এর অধীন সব কমিটি পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেয় বিএনপি। অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকেই পৌর নির্বাচনের ডামাডোল বেজে ওঠায় এ প্রক্রিয়াও বাধাগ্রস্ত হয়। তবে নির্বাচন কমিশনের বিধি মেনে ২০১৩ সালের ২৪শে সেপ্টেম্বর নির্বাচন কমিশনে আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়ে ২০১৪ সালের ৩১শে মে পর্যন্ত এবং পরে দ্বিতীয় দফায় চিঠি দিয়ে কাউন্সিল আয়োজনের সময় বাড়িয়ে নেয় দলটি।
বিএনপির একাধিক নেতা জানান, দলের কিছু সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত ঝুলে আছে। বিশেষ করে সামপ্রতিক বছরগুলোতে নানা মতবিনিময় সভায় দেয়া বক্তব্যে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দলের সাংগঠনিক পরিবর্তনের বেশকিছু ইঙ্গিত দিয়েছেন। দলের পূর্ণাঙ্গ মহাসচিব নির্বাচন, স্থায়ী কমিটিসহ জাতীয় নির্বাহী কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে কিছু আলোচনা রয়েছে।
এছাড়া বিভিন্ন সময়ে সিনিয়র নেতা এবং শুভাকাঙক্ষীদের তরফে গঠনতন্ত্রে সংশোধনী এনে দলটির কাঠামো ও পদে পরিবর্তন আনা, গঠনতন্ত্রের বিভিন্ন ধারা ও উপধারায় গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন ও বিয়োজনের কিছু প্রস্তাবনাও এসেছে।
তার মধ্যে রয়েছে- ‘চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদ’-এর বদলে ‘বিএনপির উপদেষ্টা পরিষদ’ গঠন, চেয়ারপারসনকে পরামর্শ দিতে মন্ত্রণালয়ভিত্তিক কিছু ‘উপ-কমিটি’ গঠন, ‘এক নেতার এক পদ’ নীতি বাস্তবায়ন ইত্যাদি। এসব বিষয়ে লন্ডন সফরকালে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মতামতও নিয়েছেন। সেসব বিষয় চূড়ান্ত করতে কেন্দ্রীয় কাউন্সিল আয়োজন জরুরি।
এদিকে বিএনপির বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা ও দলের দপ্তর এবং চেয়ারপারসন কার্যালয় সূত্র জানায়, পৌর নির্বাচন ও ৫ই জানুয়ারি কেন্দ্রিক দলীয় তৎপরতা শেষ হওয়ার পর এখন ফের তৃণমূল গোছানোর দিকে জোর দিচ্ছে দলটি। এ সপ্তাহেই দল পুনর্গঠনের কাজে কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা বৈঠকে বসবেন। দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় একটি টিম বৈঠক করে দল পুনর্গঠনের কার্যক্রম পর্যালোচনা করবেন।
অন্যদিকে চেয়ারপারসন নিজেই সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে বেশির ভাগ জেলা কমিটি গঠন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার টার্গেট ঠিক করেই চলমান পুনর্গঠন কার্যক্রম শুরু হবে। তবে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিলে পুনর্গঠন প্রক্রিয়া অসম্পূর্ণ রেখেও কাউন্সিল আয়োজন করা হতে পারে। -মানবজমিন
১১ জানুয়ারি,২০১৬/এমটিনিউজ/এসএস/এসবি