মঙ্গলবার, ১২ জানুয়ারী, ২০১৬, ০৫:৫৩:২০

সাফল্যের ধারায় সরকারের দুই বছর

সাফল্যের ধারায় সরকারের দুই বছর

আবদুল্লাহ আল মামুন : দুই বছর পূর্তি হল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের। ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি শপথ নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রিসভার সদস্যরা। গত দুই বছরে বেশ কয়েক মাস চরম অস্থিরতার মধ্য দিয়ে পার করতে হয়েছে বর্তমান সরকারকে। কিন্তু ধীরে ধীরে পরিস্থিতি মোকাবেলা করে সাফল্যের মুখ দেখা শুরু করেছে টানা দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকার।

বিশেষ করে গেল বছর বিভিন্ন ক্ষেত্রে পুরস্কারপ্রাপ্তির ভেতর দিয়ে বিশ্ব পর্যায়ে নেতৃত্বে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনে ২০১৫ সালে সেরা চিন্তাবিদের তালিকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রয়েছেন ১৩তম স্থানে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাময়িকী ফোর্বস প্রকাশিত ক্ষমতাধর নারীর তালিকার ৫৯ নম্বরে আছেন তিনি।

এছাড়া ২০১৫ সালে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় গৃহীত পদক্ষেপের স্বীকৃতি হিসেবে জাতিসংঘের ‘চ্যাম্পিয়ন্স অব দ্য আর্থ’ পুরস্কার অর্জন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ‘পলিসি লিডারশিপ’ ক্যাটাগরিতে জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক এ সর্বোচ্চ পুরস্কার অর্জন করেন তিনি। নিউইয়র্কে গত বছর ২৭ সেপ্টেম্বর এক অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনার হাতে এ পুরস্কার তুলে দেয়া হয়।

পাশাপাশি ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন ও তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নে বিশেষ অবদানের জন্য জাতিসংঘ ‘আইসিটি টেকসই উন্নয়ন পুরস্কার’ লাভ করেন তিনি। ২০১৫ সালে জাতিসংঘের ৭০তম অধিবেশনে তার হাতে এই পুরস্কার তুলে দেয়া হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার জন্য এ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ২৭টি পুরস্কার অর্জন করেন শেখ হাসিনা। এর মধ্য দিয়ে বর্তমান সরকারের সাফল্যের ধারা অব্যাহত রয়েছে, যার মাধ্যমে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ।

আওয়ামী লীগের ২০১৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলার অঙ্গীকার করা হয়েছিল। এতে বলা হয়েছে, ‘গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সমুন্নত এবং নিরবচ্ছিন্ন উন্নয়ন নিশ্চিত করার মতো মৌলিক প্রশ্নে সব রাজনৈতিক দল, শ্রেণী ও পেশাজীবী সংগঠন এবং সিভিল সমাজসহ দল-মত নির্বিশেষে জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সরকারের অনেক সফলতার মধ্যে বেশ কিছু ব্যর্থতাও রয়েছে। নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী, গত দুই বছরে প্রকৃত অর্থে কোনো ঐকমত্য গড়ে ওঠেনি। বরং এ দীর্ঘ সময়জুড়ে দেশে অস্থিরতা বিরাজ করেছে। ২০১৫ সালের শেষদিকে জঙ্গিবাদী তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশে ভ্রমণ সতর্কতা জারি করে। কেউ কেউ এ দেশ থেকে তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নেয়। অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট টিম তাদের নির্ধারিত খেলা বাতিল করে।

পাশাপাশি মুক্তবুদ্ধি চর্চার ওপর আঘাত রুখতে না পারাও ছিল সরকারের এক ধরনের ব্যর্থতা। একটির পর একটি হত্যাকাণ্ড বাক স্বাধীনতায় বিশ্বাসী লেখক, প্রকাশক ও ব্লগারদের মধ্যে চরম আতংক তৈরি করেছে। ৫ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচনের জেরে ক্ষমতাসীনদের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে সহাবস্থান সম্ভব না হওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন কোনো কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তবে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের দুই বছর পূর্তিতে দুই দলের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে দেশের মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে।

কোনো ধরনের সংঘাত ছাড়াই একই দিনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করেছে। আগামীতে এ ধারা অব্যাহত থাকলে এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে রাজনৈতিক ঐকমত্য পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

তবে উন্নয়নের ধারায় ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র অপবাদ ঘুচিয়ে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এখন আর উন্নয়নশীল দেশ নয়, বিশ্ব স্বীকৃত নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ। মাথাপিছু জাতীয় আয়ের ভিত্তিতে বাংলাদেশ এ শ্রেণীতে উন্নীত হয়েছে বলে গত বছর জুলাইয়ে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়।

বিশ্বব্যাংকের পাশাপাশি আমেরিকার প্রভাবশালী ম্যাগাজিন ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল দ্রুত মানব উন্নয়নের সাফল্যের জন্য বাংলাদেশকে আখ্যা দিয়েছে ‘দক্ষিণ এশিয়ার মানদণ্ডের ধারক’ হিসেবে। এসব স্বীকৃতির মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে দেশী-বিদেশী নানা ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এ স্বীকৃতিকে ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর বাংলাদেশ। ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ‘মধ্যম আয়ের দেশ’ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ‘উন্নত দেশ’ হিসেবে বিশ্বের বুকে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্য স্থির করেছে এ সরকার।

দুর্নীতির অপবাদ দিয়ে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন না করার ঘোষণা দেয় বিশ্বব্যাংক। শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক এই আর্থিক সংস্থাটি দুর্নীতির প্রমাণ দিতে পারেনি। এর ফলে সংস্থাটির সঙ্গে সরকারের টানাপোড়েন তৈরি হয়। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ সরকার বিশ্বব্যাংককে ছাড়াই পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেয়।

ডিসেম্বর পর্যন্ত এই প্রকল্পের ২৮ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১২ ডিসেম্বর পদ্মা সেতু নির্মাণের মূল কাজ ও নদী শাসন কাজের উদ্বোধন করেন। ফলে পদ্মা সেতু এখন আর রঙিন স্বপ্ন নয়, দৃশ্যমান বাস্তবতা। আর এটা সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়তায়।

আওয়ামী লীগ সরকার টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় তাদের গৃহীত চলমান কর্মসূচিগুলো অব্যাহত রয়েছে। সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে কৃষি খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে। তাই বাংলাদেশ এখন আর খাদ্যশস্য আমদানি নির্ভর দেশ নয়, রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে। গত বছর প্রথমবারের মতো বিদেশে (শ্রীলংকা) চাল রফতানি শুরু করেছে বাংলাদেশ। এটি অব্যাহত থাকবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

প্রবাসীদের রেমিটেন্স আহরণ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বেড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। দেশের সম্ভাবনাময় গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে সরকার মনোযোগ দিচ্ছে। এর ফলে দ্রুত উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হচ্ছে। তথ্য প্রযুক্তি, শিক্ষা খাতে অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। তবে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বিনিয়োগ। এক্ষেত্রে দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখা যায়নি।

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতা দূর করে রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনের সর্বক্ষেত্রে শান্তি, শৃংখলা ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করা হবে। নাগরিক জীবনের নিরাপত্তা বিধান, তাদের চলাফেরার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা হবে। কার্যত সরকারের প্রচেষ্টা থাকলেও নানা অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতার কারণে দেশে পুরোপুরি শান্তি এখন নিশ্চিত করা যায়নি বলে মনে করছেন।

তবে আওয়ামী লীগের প্রতিশ্রুত অঙ্গীকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম এগিয়ে চলেছে। গত বছর তিন যুদ্ধাপরাধী আবদুল কাদের মোল্লা, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। এতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষ সরকারকে সাধুবাদ জানিয়েছে। তাদের বক্তব্য, এ রায় নানা ঘাত-প্রতিঘাতের বিষয়ে তারা অবহিত। কিন্তু সব বাধা উপেক্ষা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আদালতের রায় কার্যকরে তার পাহাড় সমান দৃঢ়তা প্রকাশ করেছেন।

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার বিচার বিভাগ ও আইনের শাসন। এতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও মর্যাদা সংহত করার বিষয়ে অঙ্গীকার করা হয়। প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়, সর্বস্তরে জনগণের বিচার প্রাপ্তি সহজলভ্য এবং মামলাজট মুক্ত করে সম্ভাব্য স্বল্পতম সময়ে বিচার সম্পন্ন করার বিষয়ে। বর্তমান সরকার সে অঙ্গীকারের অনেকাংশই পূরণ করেছে। দেশে দুই আলোচিত শিশু হত্যা মামলা দ্রুততম সময়ে সম্পন্ন করা হয়েছে। যা বিচার বিভাগ ও সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা বৃদ্ধি করেছে।

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে অগ্রাধিকার তালিকায় নির্বাচন ব্যবস্থাকে বিশ্বাসযোগ্য করে গড়ে তোলার অঙ্গীকার করা হয়। এক্ষেত্রে জনগণের আস্থা পুরোপুরি না ফিরলেও সর্বশেষ পৌর নির্বাচনে জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। অতীতে বিভিন্ন নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রসহ তাদের মিত্ররা প্রশ্ন তুললেও এ নির্বাচন সম্পর্কে সরাসরি নেতিবাচক কোনো মন্তব্য করেনি।

তবে সরকারের দুর্নীতি প্রতিরোধে আইনি, রাজনৈতিক, সামাজিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ জোরদারের অঙ্গীকার নিয়ে মানুষের মধ্যে প্রশ্ন রয়েছে।

দুর্নীতি দমন কমিশনের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে প্রতিষ্ঠানটিকে কার্যকর করার উদ্যোগ দেখা যায়নি। বরং দুর্নীতিবাজ হিসেবে পরিচিত সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের সততার সার্টিফিকেট দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি (দুর্নীতি দমন কমিশন) তার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করেছে বলে অনেকেই মনে করছে।

গত বছর ভারতের পার্লামেন্টে স্থলসীমানা চুক্তি অনুমোদিত হয়। ফলে ৫২ হাজার ছিটমহলবাসীর ৬৮ বছরের মানবেতর জীবনের অবসান হয়েছে। ছিটমহল বিনিময়ে ১০ হাজার ৫০ একর জমি বাংলাদেশের ভূখণ্ডে যোগ হয়েছে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে বাংলাদেশ-ভারত-নেপাল-ভুটান এই চার দেশের মধ্যে মোটর ভেহিক্যাল চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমার শান্তিপূর্ণ সমাধান হয়েছে।

এছাড়াও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেল প্রদান সরকারের একটি বড় সাফল্য। এর মাধ্যমে জীবন ধারণের জন্য বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীর আর্থিক সুবিধা নিশ্চিত হয়েছে।  -যুগান্তর
১২ জানুয়ারি,২০১৬/এমটিনিউজ/এসএস/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে